মাহবুব আলী খানশূর ঃ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) কর্তৃক ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ হাজার ৫৮৮ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। ইলিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোস ফ্রম ডেভেলাপিং কান্ট্রিজ ঃ ২০০৪-২০১৩ শীর্ষক প্রতিবেদনটি কয়েকদিন আগে প্রকাশিত হয়। এসব অর্থ বাংলাদেশীরা পাচার করেছে। যদি ১ ডলারের গড় মূল্য ৭৫ টাকায় হিসাব করা হয়, তাহলে এ ১০ বছরে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ বাংলাদেশী টাকায় ৪ লাখ ১৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা। প্রতিবেদন অনুযায়ী যেহেতু প্রতিবছরই অর্থ পাচার হয়েছে, সুতরাং অর্থ পাচারের এ ধারা ২০১৪-২০১৫ সালেও অব্যাহত ছিল এবং ২০১৬ সালেও অব্যাহত থাকাটা স্বাভাবিক। সুতরাং বাংলাদেশ থেকে কি পরিমাণ অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয় এবং এর ফলে এ দেশের কি পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে, সেটাও সহজেই পরিমেয়। আর বিদেশে অর্থ পাচারের সাথে জড়িত মূলত ক্ষমতাসীন দলের এমপি ,মন্ত্রী ও শীর্ষ নেতারাই।
প্রতিবেদন দুটি অনুযায়ী আমরা দেখতে পেলাম আমাদের দেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। এ কারণেই আমাদের দেশ অনুন্নত রয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে এসব অর্থ উন্নত দেশে জমা হওয়ায় সেসব দেশ উন্নতই রয়ে যাচ্ছে। ফলে উন্নত দেশগুলো আমাদের মতো অনুন্নত দেশগুলোর ওপর খবরদারি করে। জিএফআইর তথ্য অনুযায়ী যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, তা যদি পাচার না হয়ে এ দেশে বিনিয়োগ হতো, তাহলে বাংলাদেশ আজ অনেক বেশি উন্নত হতো। আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতাম। এখন আমাদের মাথাপিছু বার্ষিক আয় মাত্র ১ হাজার ৩১৬ ডলার। পাচারকৃত অর্থ এ দেশে বিনিয়োগ হলে আমাদের গড় আয় আজ কমপক্ষে দ্বিগুণ হতো। আমরা জাতিসংঘের লিস্ট ডেভেলপমেন্ট কান্ট্রিজের দল থেকে বের হতে পারতাম। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিশ্বের কাছে এদেশকে মিথ্যা ভাবে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত করে। একদিকে তারা দেশের সম্পদ ও অর্থ লুট করে বিদেশে পাচার করছে অন্যদিকে বিদেশীদের কাছে নানাভাবে প্রচার করছে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে। আর এভাবেই তারা ক্ষমতায় টিকে আছে।
এই যে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে, তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও এমপিরাই বেশি জড়িত। আওয়ামী লীগের বড় বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি তারা আজ অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঋণের একটি অংশ উন্নত দেশে পাচার করছে। সেখানে বাড়ি কিনছে, গাড়ি কিনছে এবং সম্পত্তি কিনছে। সেখানেই তারা ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তুলছে। ফলে আমাদের অর্থে বিদেশ উন্নত হচ্ছে। এ অর্থ পাচারের প্রধান অংশ সম্পাদিত হচ্ছে আমদানি-রফতানির মাধ্যমে। বিদেশে পাচারকৃত অর্থের অর্ধেকেরও বেশি অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলকে ব্যবহার করে পাচার হচ্ছে। এদিকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঋণের একটি অংশ বিদেশে পাচার করার কারণে অনেক ঋণগ্রহীতা ঠিকমতো ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারে না বা পরিশোধ করে না। ফলে ঋণখেলাপি বাড়ছে। ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের একটি অংশ আদায় হচ্ছে না এবং এতে ব্যাংকিং সেক্টর সমস্যায় পড়ছে। আর এসব অনৈতিক অর্থ পাচার ও জনগনের অর্থ আতœসাতের সাথে জড়িত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও কর্মীরা। এসব রোধ করতে ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আরো বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার বন্ধের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি অর্থ পাচারে জড়িত এবং এর সহযোগীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি দুদক এবং এনবিআরসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঠিক এবং যথাযথ নজরদারি বাড়াতে হবে। কারণ দেশকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।
এখন কথা হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে কিছু ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতি অর্থ পাচার করছে কেন? আর সেই অর্থ দিয়ে তারা উন্নত দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তুলছে কেন? প্রকৃতপক্ষে এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে নিজ দেশের প্রতি ভালোবাসার ঘাটতি। যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত তারা কখনো দেশপ্রেমিক হতে পারে না। দেশপ্রেম না থাকলে দেশের অর্থই যে জনগনের অর্থ না অনুধাবন করা যায় না। আর আরো কিছু কারনে বিদেশে অর্থ পাচার করছে অন্যান্য সম্পদশালী ব্যক্তিরা। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ভিন্ন মতাবলম্বী হওয়ার কারণে দেশে নিজেকে এবং নিজের বিনিয়োগকে নিরাপদ মনে না করা। দেশে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ না থাকা, বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং উপাদান যেমন বিদ্যুৎ, গ্যাস সহজলভ্য না হওয়া। এছাড়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং দুর্নীতিও রয়েছে। কিন্তু এসব সমাধানের কোন চেষ্টা করছে না আওয়ামী সরকার। উপরন্তু সরকারের উচ্চমহলের নির্দেশে বিরোধী দলের নেতাদের মালিকানাধীন ব্যাংক ও অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নিজেদের অধীনে নিচ্ছে আওয়ামী সরকারের নেতা ও কর্মীরা।
ব্যাংক লুটের টাকাই সুইস ব্যাংকে জমা হচ্ছে। এর প্রমান হচ্ছে কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, ‘ব্যাংকিং খাত অত্যন্ত নাজুক। লালবাতি জ্বলার উপক্রম হয়েছে’। সেই ব্যাংক লুটের টাকাই সুইস ব্যাংকে পাচার হয়েছে বলে সবাই বিশ্বাস করে। এছাড়া আরেক রিপোর্টে জানা যায়, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ আরো বেড়েছে। আর এই টাকা পাচারের পেছনে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায়ের লোকরা জড়িত। তা না হলে অর্থমন্ত্রী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অসহায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন না। সত্যিকারার্থে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। এছাড়া সুশাসনের অভাবে বিনিয়োগ পরিবেশের ঘাটতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে দেশ থেকে বিদেশে অর্থ নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা আরও বাড়ছে। কিন্তু সরকার এদিকে কোন ভ্রুক্ষেপও করছে না নিজের স্বার্থেই ।
বর্তমান ভোটারবিহীন সরকার জোর করে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দেশকে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। লুটপাটের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সমস্ত আর্থিকখাত ধ্বংস করে দিয়েছে। যা অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে কিছুটা ফুটে উঠেছে। তাছাড়া বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, সোনালী ব্যাংক কেলেঙ্কারি, অগ্রণী ব্যাংক কেলেঙ্কারি, রুপালি ব্যাংক কেলেঙ্কারির মতো বড় বড় ঘটনা ঘটেছে। অথচ একটিরও বিচার হয়নি বা সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি এবং হওয়ার কোন লক্ষনও দেখা যাচ্ছে না।
অবৈধ ভোটারবিহীন সরকার কেলেঙ্কারি ছাড়া জনগণকে আর কিছুই উপহার দিতে পারেনি। অর্থ পাচারের পেছনে কারা জড়িত তা সরকার ভালো করেই জানে। জনগণও জানে। কারা সুইস ব্যাংকে টাকা পাচার করছে, কারা কানাডায় বেগমপল্লী গড়ে তুলেছে, কারা মালয়েশিয়ায় সেকেন্ডহোম বানাচ্ছে। আর সেজন্যই জনগণকে এত ভয় অবৈধ আওয়ামী সরকারের নেতা কর্মীরা। তাই কী করে ভোটছাড়া আরেকটি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখা যায় সে পৈশাচিক ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা সুইসব্যাংকসহ বিদেশে পাচারের জন্য দায়ীদের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করার ব্যবস্থা করা দরকার। তবেই দেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটবে।
লেখকঃ যুক্তরাজ্য প্রবাসী দৈনিক আমার দেশের সাবেক সহ সম্পাদক