মাহবুব আলী খানশূরঃ ছাত্রলীগ সম্পর্কে কিছু বলার আগে তাদের গঠনতন্ত একটু পরে নিলাম . যে তিনটি শব্দকে অবলম্বন করে দলটির গঠন তন্ত্র তৈরি হয়েছিল তার বিন্দু মাত্র দলটির কোনো নেতা কর্মী দরে রাখতে পারেনি . শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতি তিন নীতিকে বেবহার করে যে দল ১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে .আজ মনে হয় তারাই শপত নিয়েছে এই তিন নীতির বিপরীতে পথ চলাই হোক দলের মূল মন্ত্র . ছাত্রলীগের প্রথম আহবায়ক ছিলেন নাঈমউদ্দিন আহমেদ। ছাত্রলীগ সাংগঠনিকভাবে কার্যক্রম শুরু করলে সভাপতি মনোনীত করা হয় দবিরুল ইসলামকে। এরপর বর্তমান সময় পর্যন্ত মোট ২৯জন (আহবায়ক ও সভাপতি মিলিয়ে) নেতৃত্ব এসেছেন ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটির। তাদের মধ্যে দুজন বহিস্কৃত হয়েছিলেন। আর কত নেতা যে এম পি , মন্ত্রী হয়েছেন তার ইতিহাস জানতে হলে আমার জন্ম হতে হবে সাত দশক আগে . এতে তাই প্রমান হয় যে , এই দলটির পৃষ্টপোষক সারাসরি দলীয় চেয়ারপারসন অথবা তথাকথিত প্রধানমন্ত্রী .
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজেদের মধ্যে অন্তর্কোন্দল, মারামারি, টেণ্ডারবাজি, সংঘর্ষে জড়ানো, খুনোখুনি, রক্তপাত, যৌন নিপীড়নের অভিযোগে বিতর্কের জন্ম দিয়ে ছাত্রলীগ বহুবার পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে। পত্রিকার সমপাদক সাহেবরা হয়ত একবার ভেবেছিলেন ,ছাত্ত্রলীগের অপকর্ম নিয়ে আলাদা কোনো পত্রিকা বের করা যাই কিনা ।
একটি ছাত্রসংগঠনের যে যে বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার ছাত্রলীগের মাঝে তার অণুপরিমাণ বৈশিষ্ট্যও লক্ষ্য করা যায় না। ছাত্রলীগের নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, পতিতাবৃত্তি, অস্ত্রব্যবসা, আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেকশন, মাদকব্যবসা, সিট ও ভর্তি বাণিজ্য, বিরোধী আদর্শের অনুসারীদের ছাত্রাবাস ও বাসাবাড়িতে হামলা, ভাঙ্চুর ও তা দখল, টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, শিক্ষক লাঞ্ছনা, সাংবাদিক নির্যাতন, সংখ্যালঘু নির্যাতন, চুরিসহ মানবতাবিরোধী বৈশিষ্ট্যগুলো সকালের সূর্যের ন্যয় সত্য হয়ে বিকশিত হচ্ছে। সময় যত গড়াচ্ছে ছাত্রলীগের অপকর্মের রেকর্ডও তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের এই অপকর্মের কারণে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে নিহত হয় .
# ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলের ছাত্রলীগের সভাপতি সৈকত এর হাত পায়ের রগ কেটে দেয় সেক্রেটারী আনুর গ্রূপের কর্মীরা।
# জিয়াহলের ছাত্রলীগ নেতা সাইফুল ইসলাম সোহাগের রগ কেটে দেয় নিজগ্রূপেরই কর্মীরা। যার সুবাদে সে কুমিল্লা জেলা উত্তরের বর্তমান সভাপতি।
# জহরুল হক হলের সেক্রেটারী রাহাত এর হাতের রগ কেটে নেয় সভাপতি সুমন গ্রূপের কর্মীরা।
সিলেট সরকারী কলেজের ছাত্রশিবিরের কয়েদ নামে এক কর্মীর হাতের রগ কেটে নেয় ছাত্রলীগ।
গত বছর ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সিলেটের এমসি কলেজে পরীক্ষা দিতে আসা সরকারি মহিলা কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী খাদিজা বেগম নার্গিসকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করেছেন এক ছাত্রলীগ নেতা। এ ঘটনায় ছাত্রলীগ বিব্রত হয়।
হামলাকারী শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) অর্থনীতি শেষ বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক বদরুল আলমকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে স্থানীয় জনতা। যদিও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ দাবি করে বদরুল ছাত্রলীগের কেউ নন। দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে খাদিজা বর্তমানের সুস্থ হয়ে উঠছেন।বদরুলের রজনৈতিক উত্থানের পিছনে একটা মজার গল্প লুকিয়ে আছে । ছাত্রলীগের নিছকই এক কর্মী ছিল বদরুল মিছিলে-মিটিংয়ে মাঝে মধ্যে হয়তো তার দেখা মিলতো ।২০১২ সালের ১৭ই জানুয়ারির এক ঘটনা বদরুলকে পরবর্তীতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের প্রথম সহ-সম্পাদক পদ বাগাতে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে । ঐ দিন খাদিজাকে উত্ত্যক্ত করতে গিয়ে গণধোলাইয়ের শিকার হয়েছিল বদরুল । যেহেতু ছোট বেলা থকেই লেখাপড়ায় মেধাবী ছিল বদরুল তাই চতুর হওয়াটাই স্বাভাবিক । সেদিনের সেই গণধোলাইকে বদরুল ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে স্বার্থক হয়েছিল । খাদিজাকে উত্ত্যক্ত করতে গিয়ে গণধোলাইকে বদরুল তার উপর শিবিরের হামলা হিসেবে প্রচার করে ই নিজ সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী ছাত্রলীগ সহ দেশের অনেকের মনেই সহানুভূতির জন্ম দিতে পেরেছিল । বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম তখন বদরুলকে নিয়ে সংবাদ শিরোনাম ও করেছিল । ড. জাফর ইকবাল এর মত খ্যাতনামা ব্যক্তি ও বদরুলের জন্য কলম ধরেছিলেন । বদরুলকে শাবি’র টাকায় চিকিৎসা ও করানো হয়, এমন কি প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে ২ লাখ টাকা অনুদান ও দেয়া হয় বদরুলকে।সংগঠনের অনেক উপরের নেতাদের ও দৃষ্টি কারতে সক্ষম হয় বদরুল । আর এতেই বদরুল বনে যায় ছাত্রলীগের বড় নেতা ক্ষমতার দাপটে আরো বকে যায় বদরুল.
পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, বিগতবছরধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও হলে অন্তত দেড় শতাধিক সংঘর্ষ হয়েছে। এতে সাড়ে ৪শ’ শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। লাঞ্ছিত হয়েছে ৩০জন শিক্ষক এবং অর্ধশতাধিক সাংবাদিক। ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছে অন্তত ৪০জন ছাত্রী। চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি হয়েছে কোটি কোটি টাকার। ছাত্রদলসহ বিভিন্ন সংগঠনে যুক্ত থাকার অভিযোগে হল থেকে অন্তত ৫০০ শিক্ষার্থীকে বের করে দেয়া হয়েছে। রাজধানীর শিক্ষাভবন, গণপূর্ত ভবন, খাদ্য ভবন থেকে কোটি টাকার টেন্ডার বাগিয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটিয়েছে তারা। পরে কাজ ও টাকা ভাগাভাগি নিয়ে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষেও লিপ্ত হয়েছে ছাত্রলীগ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে মহাজোট সরকারের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের চেহারাও বদলে যায়। আবাসিক ১৬টি হলে শুরু হয় দখল ও আধিপত্যের লড়াই। হামলা চালিয়ে, পিটিয়ে হল থেকে বের করে দেয়া হয় বিরোধী ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী-সমর্থকদের। এক রাতেই বিভিন্ন হলের অন্তত ৮০ জন ছাত্রদল কর্মীকে বেধড়ক পেটায় ছাত্রলীগের কর্মীরা। প্রায় ১ মাস ধরে এ তা-ব চলতে থাকে। প্রক্টর ও রেজিস্ট্রার অফিস সূত্রে জানা যায়, সে সময় ১৬ হলের ৩২৭টি কক্ষ দখল করে ছাত্রলীগ। ছাত্রদল সমর্থিত অন্তত ৫৩টিরও বেশি কক্ষ ভাংচুর করা হয়। এছাড়া প্রথম দিনই তিন শতাধিক শিক্ষার্থীকে বের করে দেয়া হয় হল থেকে।
গত বছর ২৭ অক্টোবর ২০১৬ গুলিস্তান পাতাল মার্কেট এলাকার ফুটপাত থেকে অবৈধ দোকান উচ্ছেদের সময় হকারদের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের কর্মচারিদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়। ফুটপাতের হকারদের উচ্ছেদের সময় সংঘর্ষের মধ্যে ছাত্রলীগের দুই নেতার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গিয়েছিল। ওই দুইজন হলেন- ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. সাব্বির হোসেন এবং ওয়ারী থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আশিকুর রহমান।
এছাড়া গত বছর ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬ মহান বিজয় দিবসের খাবার নিয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) শাখা ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে ৬ জন আহত হয়েছে। সাদ্দাম হোসেন হলে খাবার বিতরণকালে ইবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী গ্রুপের মধ্যে এ সংঘর্ষ ঘটে।
এছাড়া বিজয় দিবসের রাতে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হলে বিশেষ খাবারের (বিরিয়ানি) ব্যবস্থা করে। খাবার পাওয়া-নাপাওয়া নিয়ে ছাত্রলীগ নেতা আবদুল হামিদ এবং সাজ্জাদ প্রোমেলের অনুসারীদের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা ও হাতাহাতি হয়। এর জের ধরে পরদিন দুপুরে শতাধিক বহিরাগত যুবক অস্ত্র নিয়ে হলে তাণ্ডব চালায়। ওই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ ছাত্রকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।
০৮ ডিসেম্বর ২০১৬ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপু ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বি সুজনের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ১৫ জন আহত হন। তাদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা গুরুতর। বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনে দুই পক্ষের কর্মীদের কথা-কাটাকাটির জের ধরে এ ঘটনা ঘটে। এছাড়া গত বছর ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬ রাতে ঝিনাইদহে সরকারি ভেটেরিনারি কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ১৫ জন আহত হয়।
এর আগে ২০১০ সালের ৫ এপ্রিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইপক্ষের সংঘর্ষের সময় প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীরা পায়ে গুলি করে ও কুপিয়ে আল-বেরুনী হলের চারতলা থেকে ফেলে দিয়েছিলেন এনায়েত কবিরকে। নয় মাস তাকে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান সিআরপিতে হুইলচেয়ারে কাটাতে হয়।
আন্দোলনে কোন ভূমিকা না থাকলেও সরকার দলের সুবিধা নিয়ে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করে যাচ্ছে ছাত্রলীগের নেতারা। ঢাবি শিক্ষকদের ব্যাচেলর কোয়ার্টার নির্মাণের টেন্ডার নিয়ে ছাত্রলীগের কয়েকজন সহ-সভাপতি মিলে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় যুবলীগ নেতাদের সঙ্গে। এর আগে মূলত টেন্ডার নিয়েই বড় ধরনের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। ঢাবি ক্যাম্পাস জুড়ে চলছে নীরব চাঁদাবাজি। পলাশীতে জহুরুল হক হল এলাকায় জাদুঘর নির্মাণ নিয়ে ঘটেছে চাঁদাবাজির ঘটনা।
ভর্তি বাণিজ্য
টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির সঙ্গে যোগ হয়েছে ছাত্রলীগ নেতাদের ভর্তি-বাণিজ্য। রাজধানীর নামিদামি কলেজগুলোতে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি নিয়ে ছাত্রলীগের অবৈধ বাণিজ্যে বিব্রত প্রশাসন। ছাত্রলীগের চাপে টিকতে না পেরে ঢাকা ও বাঙলা কলেজের ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত করেছে কর্তৃপক্ষ। সূত্র জানায়, সরকারি কলেজগুলোতে ১০০ থেকে ৫০০টি আসনে অবৈধভাবে ভর্তির আবদার করছেন ছাত্রলীগের নেতারা। এর মাধ্যমে এরই মধ্যে কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হয়েছে বলে সংশি−ষ্টদের অভিযোগ। ভর্তি-বাণিজ্যের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, মিরপুর বাঙলা কলেজ, তিতুমীর কলেজ, তেজগাঁও কলেজ, সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজ।
হল বাণিজ্য
ভর্তির পর ছাত্র-ছাত্রীদের হলে তুলতে ‘সিট বাণিজ্য’ করে ছাত্রলীগ। প্রতিটি সিটে একজন তোলার বিনিময়ে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। এবার ইডেন ও বদরুননেসা কলেজে অর্থের বিনিময়ে প্রায় ৫০০ ছাত্রীকে সিটে তোলা হয়েছে। আর এই ঘটনার আড়ালেই জঘন্যতম সত্য জাতির সামনে উন্মোচিত হয়েছে।
প্রক্টর ও রেজিস্ট্রার অফিস সূত্রে জানা যায়, সরকার বদলের সাথে সাথেই বিভিন্ন হলের প্রায় ৩২৭টি কক্ষ দখল করে নেয় ছাত্রলীগ। এ সময় হল থেকে বিতাড়িত করা হয় তিন হাজার ৮৮ জনকে। ১৫টি আবাসিক হল দখল করে বিতাড়িত করে আবাসিক ছাত্রদেরকে। ঢাবি শিক্ষকদের ব্যাচেলর কোয়ার্টার নির্মাণের টেন্ডার একটি বিশেষ কোম্পানিকে পাইয়ে দেয়ার বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ছাত্রলীগের কয়েকজন। …. চাঁদাবাজি করার সময় টিএসসির মোড় থেকে ছয়জন ছাত্রলীগ কর্মীকে পুলিশ হাতেনাতে গ্রেফতার করে, যার মধ্যে ঢাবির পাঁচ ছাত্র ও ঢাকা কলেজের এক ছাত্র রয়েছেন।
চাঁদাবাজি ও ছাত্রলীগ
শুধু টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি আর তদবির নয় ছাত্রলীগ নেতারা জড়িয়ে পড়েছেন নানাবিধ আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেকশনে। হত্যাকাণ্ডসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতারা। নিজেদের স্বার্থে, কখনো বা ভাড়ায় অংশ নিচ্ছে নানা কিলিং মিশনে। এদের অনেকেই শীর্ষ সন্ত্রাসী। সূত্র জানায়, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর গিয়ে সে দেশে পালিয়ে থাকা বাংলাদেশের ২০ জন সন্ত্রাসীর তালিকা ভারত সরকারকে দিয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম মিরপুর থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদত। সরকার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীরের সেকেন্ড ইন কমান্ডখ্যাত এই সন্ত্রাসী জীবিতদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্র্ধষ। গার্মেন্টসের ঝুট থেকে তার দৈনিক চাঁদা আদায় হয় ৪ লাখ টাকা। শাহাদতের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করছে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী খোরশেদ। খোরশেদ ছাত্রলীগ ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক। ছাত্রলীগ মহানগর উত্তরের অর্থ বিষয়ক সম্পাদক সরকার ঘোষিত শীর্ষসন্ত্রাসী কিলার আব্বাস। সাইদুর রহমান নিউটন হত্যা মামলাসহ ২ ডজন হত্যা মামলার আসামী সে।
মীরপুর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি বশির আহমেদ। এক সময় টাক বাহিনীর প্রধান এই ৪০ বছর বয়স্ক ছাত্রলীগ নেতা বর্তমানে তার সেকেন্ড ইন কমান্ড সোহেলকে দিয়ে আন্ডার ওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করছে।
ঢাকা মহানগর উত্তরের সহ-সভাপতি হারুনুর রশীদ লিটন। লেদার লিটন নামেই সে সমধিক পরিচিত। সেভেন স্টার গ্র“পের সদস্য এই ছাত্রলীগ নেতা শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকাভূক্ত। এ ছাড়াও মিরপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সভাপতি তৌফিক আলম খান পিয়াল ও মোহাম্মদপুর থানার সাধারণ সম্পাদক তুহিনের বিরুদ্ধে রয়েছে সন্ত্রাস ও হত্যার একাধিক অভিযোগ। মার্চ মাসের ১২ তারিখে পিয়াল ভারতে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের অভিযোগে ভারতীয় পুলিশের কাছে আটক হয়।
তেজগাঁও কলেজের নিয়ন্ত্রক ফরিদুর রহমান খান ইরান পুলিশের তালিকাভূক্ত আসামী। দুর্র্ধষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলামের ঘনিষ্টজন হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে। সুইডেন আসলামের সাথে সে কয়েকবার গ্রেফতারও হয়েছে। তেজগাঁও থানার আহ্বায়ক সায়েম কিলার আশিকের ঘনিষ্ঠজন। কাওরান বাজারের থ্রি-মার্ডারের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার সূত্র পাওয়া যায়।
চারুকলা অনুষদ শাখার সভাপতি হয়েই চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েন জামিরুল ইকবাল আজাদ। সভাপতি হওয়ার মাত্র কয়েক দিন পরই মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে তিনি নিউ মার্কেটের বিপরীতে নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিশ্বাস বিল্ডার্সের কাজ বন্ধ করে দেন।
শেখ হাসিনা, তথা কথিত প্রধানমন্ত্রী ও ছাত্রলীগ
ছাত্রলীগের এতসব মানবতাবিরোধী জঘন্য অপকর্মের বিচার না করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের অপকর্মকে নির্ভিঘে চালিয়ে নেয়ার জন্যে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক পদ থেকে পদত্যাগ করলেন।
এতে হলো কী? বেড়ে গেল ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টি ছাত্রলীগের অন্য সকল কুকীর্তিকে হার মানিয়েছে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিজেদের ভিতর কোন্দলের কারণে নিহত হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রলীগ সেক্রেটারি আবুল কালাম রাজিব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুবকর ছিদ্দিক। বহিরাগত ছাত্রলীগ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীন সংঘাতে নিহত হয় মু. আসাদুজ্জামান। টাকা ভাগাভাগীকে কেন্দ্র করে নিহত হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ফারুক। আভ্যন্তরীন কোন্দলে যশোর সদর উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক রিপন হোসেন ওরফে দাদা রিপন নিহত হয়। টেন্ডার বক্স ছিনতাই করার সময় চাপাতির আঘাতে পঞ্চগড় ছাত্রলীগের কর্মী ফারুক নিজদলের সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়। রাজধানীর আদাবরের ৪৩ নং ওয়ার্ড সভাপতি সৈয়দ ওয়াহিদুজ্জামান রমিজ পহেলা বৈশাখের টাকা ভাগাভাগীতে নিহত হয়। রাজশাহী পলিটেকনিকে ছাত্রলীগের হামলায় নিহত হয় ছাত্রমৈত্রীর নেতা সানি। ছাত্রলীগের হামলায় নিহত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবির সেক্রেটারি শরীফুজ্জামান নোমানী, জামালপুরের ছাত্রশিবির সভাপতি হাফেজ রমজান আলী।
সারকথা
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সোনালি ইতিহাস ছাত্রদের আন্দোলনের কাছে অসাধারণ ঋণী। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীনতার পরে ছাত্ররাজনীতির কোনো স্বচ্ছ এবং গঠনমূলক ধারা গড়ে উঠেনি আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। দলীয় রাজনীতি আর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হয়েছে বারবার যুদ্ধক্ষেত্রে। এর সাথে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তিবাণিজ্য এসব তো আছেই। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের সংঘর্ষে ছাত্রছাত্রী নিহত হওয়ার ঘটনা সারা পৃথিবীতে বিরল হলেও বাংলাদেশে প্রায় নিত্য নৈমিত্যিক ঘটনা। বই-খাতার বদলে হাতে হাতে শোভা পায় মদ-গাঁজা ও ফেন্সিডিলের নীল ছোবল। মেধার লড়াইয়ের পরিবর্তে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে সর্বশক্তি ব্যয় করতে দেখা যায় বিদ্যাপীঠের বিদ্যার্থীদের। পিতা-মাতার স্বপ্ন খুন হয়ে কফিন হয়ে দরজায় কড়া নাড়তে দেখা যায়। যেখান থেকে বেরিয়ে আসবে সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক; যাদের ছোঁয়ায় সমৃদ্ধির উচ্চশিখরে আরোহণ করবে বাংলাদেশ, আজ সেখানে কলমের পরিবর্তে অস্ত্র দেখা যায়।
একটি অন্যায় আরেকটি অন্যায়ের জন্ম দেয়। একটি হত্যাকাণ্ড আরেকটি হত্যাকাণ্ডের পথ প্রস্তুত করে। একটি অবিচার আরেকটি অবিচার আর আইন হাতে তুলে নেয়ার পরিস্থিতি তৈরি করে। তাই ছাত্রলীগ নামক সন্ত্রাসী সংগঠনকে আইনের মাধ্যমে বিলুপ্তি ঘোষণা এখন শুধু সময়ের দাবি ।
লেখক ঃ সাংবাদিক