রাশিয়ায় আগামী রোববার অনুষ্ঠিত হবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ওই নির্বাচনে কে জয়ী হবেন—তা নিয়ে তেমন একটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। বিশ্ব গণমাধ্যমেও এ নিয়ে শোরগোল নেই। রুশ সরকারও ফলাফল বাদ দিয়ে, ভাবছে ভোটারের সংখ্যা নিয়ে। কিন্তু নির্বাচনে জয়ী হলেও, আর কত দিন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন ভ্লাদিমির পুতিন?
এই প্রশ্ন পড়ে মনে করার কারণ নেই যে, পুতিন বিরোধীরা রাশিয়ায় শক্তিশালী হয়ে গেছে! তবে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ও বয়স বলে তো একটা বিষয় আছে। সেটি নিয়েই আলোচনা চলছে। বলা হচ্ছে, কীভাবে শেষ হবে পুতিন যুগ?
দ্য টাইমসের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ২০০০ সালের পর থেকে রাশিয়ায় নির্বাচনে আর জয়-পরাজয় নিয়ে ভাবা হয় না। তখন থেকে নির্বাচনের মূল লক্ষ্য হলো, পুতিনের রাজত্বের ভিত আরও শক্ত করা। নেতা বাছাই করা নয়।
ইউরো নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবারের নির্বাচনে জিতলে চতুর্থ মেয়াদে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হবেন ভ্লাদিমির পুতিন। ২০১২ সাল পর্যন্ত দুই দফায় প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। তখন প্রেসিডেন্টের মেয়াদ ছিল ৪ বছর করে। এরপর সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে নেমে প্রধানমন্ত্রী হন পুতিন। দিমিত্রি মেদভেদেভ তখন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তবে ওই এক মেয়াদেই। এরপর আবার প্রেসিডেন্টের পদে ফিরে যান পুতিন। তখনই আইনপ্রণেতাদের দিয়ে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ ২ বছর বাড়িয়ে ৬ বছর করান তিনি। এরই মধ্যে তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব শেষ করেছেন। এবার চতুর্থ মেয়াদের অপেক্ষা। আর তা হলে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা সংহত থাকবে পুতিনের। অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ২৪ বছর ক্ষমতায় থাকা হয়ে যাবে পুতিনের। সোভিয়েত ইউনিয়ন পরবর্তী সময়ে এটিই সর্বোচ্চ। কিন্তু তারপর?
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, পুতিনের পর কে রাশিয়ার হাল ধরবেন—এ নিয়ে দেশটির হর্তাকর্তাদের ভাবা উচিত। কারণ ২০২৪ সালে চতুর্থ মেয়াদ শেষে পুতিনের বয়স হবে ৭১ বছর। ওই সময় সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মানতে হলে আবার প্রধানমন্ত্রী হতে হবে পুতিনকে। কারণ টানা তিনবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার নিয়ম নেই রাশিয়ায়। তখন পুতিনের হাতে বিকল্প থাকবে তিনটি। প্রথমত, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং-এর মতো আজীবন ক্ষমতায় থাকার বিধান আনতে পারেন। দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী পদে এক মেয়াদ থেকে আবার প্রেসিডেন্ট হতে পারেন। তৃতীয়ত, একজন উত্তরসূরির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সাধারণ মানুষের জীবনে ফিরে আসতে পারেন।
তৃতীয় বিকল্পটি আদৌ সাবেক কেজিবি কর্মকর্তা পছন্দ করবেন কিনা—তা নিয়ে নিন্দুকদের সন্দেহ আছে। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর যেভাবে নিজের ক্ষমতা সুসংহত করেছেন পুতিন, তাতে এ নিয়ে সন্দিহান হওয়াটা অযৌক্তিক নয়। রয়টার্সের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ক্রেমলিনের ঘনিষ্ঠ দুটি সরকারি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছে, পুতিনের বিকল্প হিসেবে এখনো কারও কথা ভাবা হচ্ছে না।
বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, রাশিয়ার শাসন কাঠামোতে বেশ ঐক্য আছে। আদতে সেখানে আছে বিভক্তির নানা সুর। বিশেষ করে নিরাপত্তা ও আর্থিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে। একইভাবে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীদের মধ্যেও আছে বিভক্তি। আর এই সব বিষয়গুলোর মধ্যে সাম্যাবস্থা বজায় রাখছে ভ্লাদিমির পুতিনের ব্যক্তিত্ব।
রুশ নির্বাচনের খুঁটিনাটি
রাশিয়ায় প্রায় ১০৯ মিলিয়ন যোগ্য ভোটার আছে। সারা দেশে ভোটকেন্দ্র আছে ৯৪ হাজার ৫০০ টি। রাশিয়ার বাইরে থাকেন দেশটির আরও ১৮ লাখ ভোটার। নির্বাচন উপলক্ষে বিদেশের মাটিতে রাশিয়া ৩৬৯টি ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। বর্তমান ব্যবস্থায় নিজেদের পছন্দের প্রার্থীর পাশের বাক্স চিহ্নিত করতে হবে ভোটারদের। এরপর জমা দিতে হবে ব্যালট। নির্বাচনের প্রার্থীদের সরাসরি বিজয়ী হতে হলে, মোট ভোটের অর্ধেক পেতে হবে। তা না হলে, ভোটপ্রাপ্তির দিক থেকে শীর্ষ দুই প্রার্থীর মধ্যে ফের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। তিন সপ্তাহ পর দ্বিতীয় দফায় ভোটগ্রহণ করা হবে। তাতেই নির্বাচিত হবেন প্রেসিডেন্ট।
লিথুয়ানিয়ার কোনাস ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির ইনস্টিটিউট অব ইউরোপের পরিচালক ভিগোদেস উসাৎকাস বলেন, রাশিয়ায় পুতিনকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ঘোরাফেরা করে। পুরো রুশ শাসন ব্যবস্থাই এখন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। পুতিন পরবর্তী শাসনেও পুতিনের প্রভাব কীভাবে সংহত করা যায়—তা নিয়েই ভাবছে অভিজাত শাসকগোষ্ঠী। পুতিনের উত্তরসূরি বাছাই করার দিকে নজর নেই তাদের।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, পুতিন পুরো রুশ শাসন ব্যবস্থার সমার্থক হয়ে উঠেছেন। অনেকই পুতিন বাদে অন্য কোনো নেতাকে সেখানে কল্পনাও করতে পারেন না। এখন চতুর্থ মেয়াদ শেষ করার আগে পুতিন সংবিধান সংশোধন করার পদক্ষেপ নিতেই পারেন। সে ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ আইনপ্রণেতার সমর্থন প্রয়োজন হবে তাঁর। পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের তিন-চতুর্থাংশের সমর্থন লাগবে। একই সঙ্গে আঞ্চলিক আইন পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের অনুমোদন প্রয়োজন হবে।
অর্থাৎ সংবিধান সংশোধন করতে হলে এই সবগুলো সংস্থায় পুতিনের দল ইউনাইটেড রাশিয়া ও তার মিত্রদের প্রয়োজনের বেশি আসন থাকতে হবে। কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিন এরই মধ্যে বলে দিয়েছেন, ক্ষমতায় টিকে থাকতে সংবিধান সংশোধনের ইচ্ছা নেই তাঁর।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, পুতিনের জন্য বয়স বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১২ সালের মতো আবার প্রধানমন্ত্রী হলে, ফের প্রেসিডেন্ট হতে হতে পুতিনের বয়স হবে ৭৭। ক্রেমলিনের কিছু বিশ্বস্ত সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সকে জানিয়েছে, সাম্প্রতিককালে মাঝে মাঝেই বেশ ক্লান্ত অনুভব করার কথা বলেন রাশিয়ার এই নতুন ‘জার’। ২০১৬ সালে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেংকোর সঙ্গে আলাপচারিতায় পুতিন বলেছিলেন, ‘আমি প্রয়োজনীয় ঘুমটুকুও পাই না। গত পরশুদিন মাত্র ৪ ঘণ্টা ঘুমিয়েছিলাম। আর গতকাল রাতে ঘুমানোর সময় পেয়েছি ৫ ঘণ্টা।’
এই একটি কারণেই উত্তরসূরি নির্বাচনের পথে হাঁটতে চাইতে পারেন পুতিন। ক্রেমলিনের ঘনিষ্ঠ কিছু সূত্র জানিয়েছে, পুতিন এখনো কাউকে নির্বাচন করেননি। সুতরাং দিমিত্রি মেদভেদেভসহ যে নামগুলো আলোচনার টেবিলে ঝড় তুলছে, সেগুলোর খুব একটা ভিত্তি নেই। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, পুতিন এমন উত্তরসূরি নির্বাচন করতে চাইবেন, যিনি তাঁর তৈরি ক্ষমতার বলয় টিকিয়ে রাখবেন এবং তাঁকে রক্ষা করবেন।
কার্নেগি মস্কো সেন্টারের জ্যেষ্ঠ ফেলো আন্দ্রেই কালিসনিকভ বলেন, ‘যত দিন তিনি ক্ষমতা ধরে থাকবেন, তাঁর বের হওয়ার পথ তত কঠিন হবে। এই পুরো শাসন কাঠামোটি তাঁর ব্যক্তিগত প্রকল্প। নিজেই তৈরি করেছেন। এমন একটি জটিল ব্যবস্থা থেকে কীভাবে বের হবেন পুতিন?’