পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। মাঝে মধ্যে সম্পর্কে জোড়াতালি দেয়ার কিছু কিছু খবর প্রকাশিত হলেও আসলে কিছুই হচ্ছে না। আর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক যত নাজুক হচ্ছে, চীন ও রাশিয়ার সাথে তার ঘনিষ্ঠতা তত বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ব্যাপকভাবে অবনতি ঘটার মতো একমাত্র দেশ কিন্তু পাকিস্তান নয়। হোয়াইট হাউজে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগমনের পর থেকে বেশ কয়েকটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক অক্ষ থেকে সরে গেছে মূলত ট্রাম্পের ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) বাতিল করার সিদ্ধান্তের কারণে। এই টিপিপি ছিল চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে এশিয়া ও প্যাসিফিকে মার্কিন সামরিক বাহিনীর জন্য ভারসাম্য পুনঃস্থাপনে ওবামা প্রশাসনের ‘এশিয়া ভরকেন্দ্র’ কৌশলের মূল বিষয়। কিন্তু ওবামার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। পরিণামে মার্কিন বৈশ্বিক প্রভাব হ্রাস পেয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া ও চীনের প্রভাব বেড়েছে।
অবশ্য, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পাকিস্তানের সরে যাওয়া টিপিপির কারণে নয়। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই, পাকিস্তান যদি চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর তথা সিপিইসির মাধ্যমে চীনা শিবিরে জোরালোভাবে শামিল না হতো এবং সাংহাই সহযোগিতা সংস্থায় (এসসিও) যোগ নাও দিত, তবুও ওয়াশিংটনের ব্যাপারে ইসলামাবাদ অনেক বেশি সতর্ক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতো।
আফগানিস্তানে এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিকভাবে প্রবলভাবে উপস্থিত থাকায় এবং পূর্ণ প্রত্যাহারের কোনো উদ্দেশ্য না থাকায় পাকিস্তানের নিজস্ব কৌশলের কারণে ওয়াশিংটনের কাছ থেকে পাকিস্তানের সরে যাওয়ার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তানে রাশিয়া ও চীনের সাথে পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান হারে সম্পৃক্ত হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আর এই তিন দেশ চাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র যেন কোনোভাবেই আফগানিস্তানে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও কৌশলগত উদ্দেশ্য হাসিল করতে না পারে।
আফগান তালেবানকে পাকিস্তানের কথিত সহায়তার কারণেই কেবল ইসলামাবাদ-ওয়াশিংটনের সম্পর্কে অবনতি ঘটেছে বিষয়টি এমন নয়। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের কথিত এক দশক ধরে পাকিস্তানের তালেবানকে সহায়তা করা দুই দেশের মধ্যকার বিরোধের প্রধান বিষয়। তবে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে পাকিস্তান যেভাবে ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যটির কোপানলে পড়ে বিধ্বস্ত হওয়া আঞ্চলটির সমীকরণ বদলে দিচ্ছে কিংবা নতুন খেলায় পাকিস্তান যেভাবে একটি পক্ষে পরিণত হয়েছে তা।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত দুই-তিন বছর ধরে রাশিয়া চাচ্ছে আফগানিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হতে কিংবা অন্তত ভারসাম্য প্রতিষ্ঠাকারী হতে। কিন্তু রাশিয়ার প্রায় সব উদ্যোগের বিরোধিতা করছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু রাশিয়াকে স্বাগত জানাচ্ছে পাকিস্তান, মস্কোর সব উদ্যোগে অংশ নিচ্ছে, আফগান যুদ্ধের রাজনৈতিক সমাধানকে সমর্থন করছে।
কৌশলগত ও রাজনৈতিক উভয় পরিভাষাতেই এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, সব আঞ্চলিক খেলোয়াড়কে আলোচনার টেবিলে সমবেত করতে পারে দেশটি। এর মাধ্যমে আবারো যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বাসযোগ্য প্রভাব বিস্তারে অক্ষম একটি দুর্বল শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে।
তালেবানের বিরুদ্ধে ইসলামাবাদ কিছু করছে না। এ কারণে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষেপেনি যুক্তরাষ্ট্র, আসল কথা হলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আফগানিস্তানে প্রবল রুশ উপস্থিতির সম্ভাবনাতেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে ওয়াশিংটন। তার মনে হচ্ছে, আফগানিস্তানে অপরিহার্য পক্ষে পরিণত হতে যাচ্ছে রাশিয়া।
অন্য কথায় বলা যায়, আফগানিস্তানে সফলভাবে আলোচনা আয়োজন করে রাশিয়া নিশ্চিত করেছে, তারা ভবিষ্যতের যেকোনো ধরনের নিষ্পত্তিতে অংশ হবে। আর মাঠ পর্যায়ের পরিস্থিতি সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে রাশিয়া সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এবং আফগানিস্তানে তার ভূমিকা স্বীকার করে নিতে যুক্তরাষ্ট্রকে বাধ্য করা নিশ্চিত করতে চায়।
আর রুশ উদ্দেশ্য হাসিলে পাকিস্তান হলো প্রধান হাতিয়ার। যুক্তরাষ্ট্রের এ যাবৎকালের দীর্ঘতম যুদ্ধেও ওয়াশিংটনের হয়ে পাকিস্তান একই ভূমিকায় ছিল।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে পাকিস্তানের অংশগ্রহণের ফলে গত ১৬ বছর ধরে আফগানিস্তানকে যে দৃষ্টিতে দেখেছিল ইসলামাবাদ, সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। চীনের মতো পাকিস্তানের কাছেও মৌলিকভাবে স্পষ্ট হয়ে গেছে, সিপিইসির সাফল্য নিশ্চিত করতে আফগানিস্তানের অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর দেশটি যত দিন মার্কিন দখলদারিত্বে থাকবে, তত দিন সে সিপিইসিতে যোগ দেবে না। এই উপলব্ধি থেকেই পাকিস্তান ধীরে ধীরে মার্কিন বলয় থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।
গত ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহেই পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও চীনা কর্মকর্তারা চীনে বৈঠক করে ঘোষণা করেছেন, চীন ও পাকিস্তান পরিকল্পনা করছে আফগানিস্তানে সিপিইসি সম্প্রসারণ করতে। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, দীর্ঘ মেয়াদে আফগানিস্তানের মাধ্যমে আমরা সিপিইসিকে চীন-মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া অর্থনৈতিক করিডোরের সাথে সংযুক্ত করব।
এই প্রেক্ষাপটে দেয়ালের লেখা পরিষ্কার যে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র আর একমাত্র খেলোয়াড় থাকছে না। শিগগিরই রাশিয়া ও চীনের কাছ থেকে অনেক প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে সে এবং ওয়াশিংটনের নীতি মস্কো ও বেইজিংয়ের কাছ থেকে মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। আফগানিস্তান নিশ্চিতভাবেই বড় ধরনের পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে থাকবে।
পাকিস্তানের কূটনৈাতিক সূত্রগুলোর মতে, রাশিয়ার কাছ থেকে টেলিফোনে আশ্বাস পেয়েছে পাকিস্তান। পাকিস্তান যে ‘নিঃসঙ্গ’ হয়ে পড়েনি, সে আশ্বাসই রাশিয়া তাকে দিয়েছে। মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী মস্কোর সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, ‘ট্রাম্পের বিবৃতির পর রাশিয়ার সাথে যোগাযোগ হওয়াটা উৎসাহজনক। তারা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করে এবং আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো বাড়াতে এবং প্রতিরক্ষা খাতে আরো বেশি সম্পৃক্ত হতে রাশিয়া আগ্রহী। ওয়াশিংটন যখন পাকিস্তানকে চাপ দিচ্ছে, তখন আমরা দু’টি বৃহৎ শক্তিকে পাশে পাচ্ছি।
পাকিস্তানের প্রতি বেইজিংয়ের সরকারি দৃষ্টিভঙ্গিও একই রকমের। ওয়াশিংটন-ইসলামাবাদ দ্বন্দ্বের পর চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সংশ্লিষ্ট পত্রিকা গ্লোবাল টাইমসে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে আফগানিস্তানে মার্কিন নীতির সমালোচনা এবং পাকিস্তানের অবস্থানের প্রশংসা করা হয়। এতে স্পষ্টভাবে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্ক ভেঙে গেলে ইসলামাবাদ তখন বাধ্য হবে চীন ও রাশিয়ার আরো ঘনিষ্ঠ হতে। আর চীন ও পাকিস্তান যেহেতু সহযোগিতা প্রশ্নে সব সময়ের কৌশলগত অংশীদারিত্বের বন্ধনে আবদ্ধ, তাই ইসলামাবাদকে যে বেইজিং ত্যাগ করবে না, সে ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই।
এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানকে নিজের ব্লকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের করার আছে সামান্যই। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পাকিস্তান অর্থনৈতিক চাপে পড়তে পারে, পাকিস্তানে যে আবার সরাসরি ড্রোন হামলা যুক্তরাষ্ট্র শুরু করতে পারে তা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ আছে কম। তবে পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক হতে পারে যা তা হলো দেশটি এখনো মার্কিন সামরিক সরবরাহের সর্বোত্তম ভূখণ্ডগত রুট হিসেবে বহাল রয়েছে। দুই দেশের মধ্যকার চলমান অস্থিরতা প্রশমিত হওয়ার পর তারা যখন আবার কর্মপন্থা নির্ধারণ করার আলোচনায় বসবে, তখন পাকিস্তানকে অবশ্যই এ সুবিধাটিই কাজে লাগানোর কাজটি করতে হবে।
অর্থাৎ সমীকরণ সবসময় একই রকম থাকবে না। কী ঘটছে, তা জানার জন্য সবসময় এ দিকে নজর রাখতে হবে।
আসিফ হাসান