রাখাইন রাজ্যের গ্রাম কোয়ে তান কাউক। এক সময় এখানে ছিলেন রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিবাস। এখন দৃশ্যপট পাল্টেছে। গ্রামের প্রবেশপথে বাঁশের খুঁটিগুলোতে শোভা পাচ্ছে বৌদ্ধদের পতাকা। এখানে বসতি গড়তে আসতে শুরু করেছে জাতিগত রাখাইনরা।
রাখাইন রাজ্যের যেসব স্থান থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিতাড়িত করা হয়েছে সেখানেই থিতু হচ্ছে নতুন আগত বৌদ্ধ রাখাইনরা। রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করে গ্রামের পর গ্রাম মিশিয়ে দেয়া হয়েছে মাটির সঙ্গে।
রোহিঙ্গাদের এসব গ্রামে আসতে থাকা জাতিগত রাখাইন অভিবাসীদের সংখ্যা আপাতত কম। কিন্তু বড় আশা নিয়ে তারা রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছেন। এক সময়ের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার ধর্মভিত্তিক জনসংখ্যা বিন্যাস উল্টে দেয়ার যে ‘রাখাইনিকরণ’ পরিকল্পনা রয়েছে তার অংশ হতে পেরে তৃপ্তি পাচ্ছেন তারা। এই পরিকল্পনার পেছনে রয়েছে দাতাদের অর্থের জোগান।
কোয়ে তান কাউকের একটি কুঁড়েঘরে উঠেছেন ২৮ বছরের চিত সান ইয়ান ও তার স্বামী। মুসলিমদের নির্দেশ করতে মিয়ানমারে ব্যবহৃত অমর্যাদাকর একটি শব্দ ব্যবহার করে চিত এএফপিকে বলেন, ‘আমরা ওই কালারদের অনেক বেশি ভয় পেতাম। কিন্তু এখন যেহেতু তারা আর এখানে নেই আমরা এখানে বসবাসরত স্বজনদের সঙ্গে আবারো দেখা করার সুযোগ পেয়েছি।’ চিতের নতুন বাড়ি থেকে ক কিলোমিটার দূরেই দেখা যায় রোহিঙ্গা স্থাপনার ধ্বংসস্তূপ।
গত বছরের ২৫শে আগস্ট থেকে শুরু করে উত্তর রাখাইন থেকে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়েছে। ‘মুসলিম মিলিট্যান্টদের’ বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানে বিতাড়িত করা হয় তাদের।
সত্তরের দশকের শেষের দিকে দক্ষিণ ও মধ্য রাখাইন থেকে আরো ৩ লাখ রোহিঙ্গাকে সেনা অভিযানে জোরপূর্বক পুশ আউট করা হয়। গেল বছরের
বর্মী সামরিক অভিযানকে জাতি গণ-নিধনযজ্ঞ আখ্যা দিয়েছে জাতিসংঘ। আর শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেছেন ‘গণহত্যার যাবতীয় বৈশিষ্ট’ আছে ওই অভিযানে।
মিয়ানমার জোর গলায় এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। বলছে, শরণার্থীরা ফিরতে চাইলে স্বাগত। কিন্তু, প্রত্যাবাসনের প্রথম ধাপে তাদেরকে দেয়া ৮০০০ শরণার্থীর তালিকার থেকে মাত্র ৩৭৪ জনকে নিতে সম্মত হয়েছে তারা। কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে থাকা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বহু রোহিঙ্গা এখন আর রাখাইনে ফিরতে চান না- যেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে অস্থায়ী শিবির আর বৈরীভাবাপন্ন প্রতিবেশী।
রোহিঙ্গাদের অনুপস্থিতিতে নানা উন্নয়ন প্রকল্পের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। চেহারা পাল্টে যাচ্ছে উত্তর রাখাইনের। সরকারি, সেনা পৃষ্ঠপোষকতা বা বেসরকারি অর্থায়নে চলছে এসব প্রকল্পের কাজ।
রোহিঙ্গাদের রেখে যাওয়া খালি জায়গায় জুড়ে বসাটা পুরনো এক খেলা। এটাকে দেখা হয় ইসলাম প্রসারের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ প্রধান এ দেশের যে লড়াই তার অগ্রভাগ হিসেবে।
মিয়ানমার্স এনিমি উইদিন: ‘বুদ্ধিস্ট ভায়োলেন্স অ্যান্ড দ্য মেকিং অব দ্য মুসলিম আদার’ বইয়ের লেখক ফ্রান্সিস ওয়েড বলেন, ‘৯০ এর দশকের শুরু থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমিয়ে আনার মাধ্যমে উত্তর রাখাইন রাজ্যের সামাজিক চিত্র পাল্টানোর নকশা করে আসছে সেনাবাহিনী। সংখ্যালঘু মুসলিমরা এখানে নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যাত। তাদের বলা হয় ‘বেঙ্গলিস’, মিয়ানমারে প্রচলিত যুক্তিমতে- বহিরাগত এ জনগোষ্ঠীকে সফলভাবে তাদের জন্মোৎসের দেশে ঠেলে পাঠানো গেছে।
মি. ওয়েড বলেন, পশ্চিম তীরে ইসরাইলি দখলদারি প্রকল্পের মতো একই ধাঁচে বৌদ্ধরা মুসলিমদের উৎখাতের পর জায়গা দখলে নিচ্ছে। উল্টে পাল্টে দিচ্ছে আসল বাস্তবতা। আর ধীরে ধীরে ওই ভূখণ্ডে মুসলিমদের অধিকার ঘষে মেজে নিশ্চিহ্ন করে ফেলছে।
তিনি আরো বলেন, ‘সামনে আরো অনেক বৌদ্ধ এখানে থিতু হবে বলে আমার ধারণা। এবং এরপর আমরা ভুলে যাবো এই এলাকা একসময় আসলে কি ছিল। আর মুছে ফেলার প্রক্রিয়া তখন শেষ হবে।’
রোহিঙ্গা আউট, রাখাইন ইন
রিকন্সট্রাকশন অব দ্য রাখাইন ন্যাশনাল টেরিটরি ইন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টায়ারের (সিআরআর) সহায়ক কমিটির সুবিধাপ্রাপ্ত একজন চিত সান ইয়ান। শরণার্থী সংকট শুরু হওয়ার পর পরই এই বেসরকারি স্কিমটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
সেনাবাহিনীর কড়া নজরবন্দি এলাকায় কোনো পুনর্বাসন পরিকল্পনা স্বভাবতই তাদের সম্মতি ছাড়া সম্ভব নয়। জাতিগত রাখাইন দাতাদের অর্থায়নে পরিচালিত সিআরআর-এর লক্ষ্য হলো রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিতওয়ে থেকে মংদু পর্যন্ত প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকা ‘মুসলিম-মুক্ত’ করা। ওই কমিটির পরামর্শক একজন রাখাইন এমপি ও হলা স এমনটাই বলছেন।
এএফপিকে তিনি বলেন, ‘এই পুরো এলাকায় মুসলিমদের প্রভাব ছিল। সামরিক বাহিনীর অভিযানের পর তাদের পালাতে হয়েছে। কাজেই এই এলাকায় আমাদের রাখাইন জনগণ দিয়ে বসতি গড়ে তুলতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, সিআরআর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং বসতি গড়তে অর্থায়ন করবে যেন ছোট্ট এ জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়তে পারে।
এখন পর্যন্ত ৬৪টি পরিবারের আনুমানিক ২৫০ জন এখানে এসেছে সিআরআর-এর মাধ্যমে। তাদের অপেক্ষমান তালিকায় আছে আরো ২০০ পরিবার। ৬০০ কিলোমিটার দক্ষিণ বা সিতওয়ের বহিরাগতদের থেকে তাদের বেছে নেয়া হয়েছে। এদের বেশিরভাগ দিনমজুর।
এই স্কিমের জন্য দুটো গ্রাম বেছে নেয়া হয়েছে। রাথেডাউংয়ের কাছে কোয়ে তান কাউক এবং মংদুর কাছে ইন দিন। নতুন নিবাসীরা স্বপ্ন দেখছেন একদিন এখানকার জমির মালিক হবেন তারা। মিয়ানমারের দ্বিতীয় দরিদ্রতম রাজ্যে এটা আগে কখনই ভাবতে পারেননি তারা।
রাখাইন জাতীয়তাবাদীদের ভাষ্যমতে, সিআরআর হলো ইসলামের বিরুদ্ধে রক্ষাপ্রাচীর। সিআরআর-এর সাধারণ সম্পাদক থান তুন প্রশ্ন রাখেন, ‘রাখাইন রাজ্যে রাখাইন ছাড়া আর কার অগ্রাধিকার থাকা উচিত?’
মিত্র আর সেনা
মিয়ানমার সরকার ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া রাজ্যের পুনর্নির্মাণে ক্ষমতাধর ব্যবসায়ীদের ভিড়িয়েছে। ওদিকে, সেনাবাহিনী অন্যান্য প্রকল্প চালাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা। দৃশ্যত এসব ব্যবস্থা হলো রোহিঙ্গাদের আসার পথ বন্ধ রাখার দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টা।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে এ সপ্তাহে বিস্তারিত উঠে এসেছে যে, কিভাবে রাস্তাঘাট, হেলিপ্যাড ও নিরাপত্তা স্থাপনাগুলো তৈরি করা হচ্ছে। এসবের অনেককিছুই ভস্ম করে দেয়া রোহিঙ্গা স্থাপনাগুলোর ওপরে। অ্যামনেস্টি এসব কর্মকাণ্ডকে বিরাট ‘জমি দখল’ বলে আখ্যা দিয়েছে। এতে করে নৃশংসতা চালানোর যেসব অভিযোগ রয়েছে সেসবের তথ্যপ্রমাণ মুছে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।
সামরিক জান্তা যুগের একই নাগরিকত্ব আইনে ১৯৮২ সালে রোহিঙ্গাদের বৈধ পরিচিতি কেড়ে নেয়া হয়। এখন তাদের পৈতৃক ভিটেমাটি কেড়ে নেয়া হচ্ছে। আইনপ্রণেতা ও হলা স’র মধ্যে এতে করে তাদের ফেরা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, ‘এসব জনগণ চায় রোহিঙ্গা জাতিগত পরিচয় দিয়ে স্বীকৃত হতে। নাগরিকত্ব উপভোগ করতে চায়, নিজেদের আদি জমিতে পুনরায় বসতি গড়তে চায়। এসব দাবি অযৌক্তিক।’
ভয়ংকর এই নতুন পরিবেশেও কোয়ে তান কাউকের নবাগত রাখাইনরা বলছে তারা এখানে থাকতে এসেছে। ৬৯ বছর বয়সী নারী ওসার বলেন, ‘আমার জীবন এখানেই শেষ হবে। আমি অন্য কোথাও যাচ্ছি না।’ এএফপি