প্রাকৃতিক বিপর্যয়, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও সারা বিশ্বে বাড়ছে ভ্রমণ প্রবণতা৷ আগের বছরের তুলনায় ২০১৭ সালে প্রায় ৬ ভাগেরও বেশি মানুষ দেশের বাইরে ভ্রমণ করেছেন, যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ৷
এ বছর ভ্রমণের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশা করছেন পর্যটন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পর্যটন মেলা আইটিবি বার্লিনের ৫২তম আসরে এমনটিই বলা হয়েছে৷
আইটিবি বার্লিন ২০১৮
১৯৬৬ সালে খুব ছোট পরিসরে যাত্রা শুরু করে বার্লিনে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আকর্ষণ করার এই উদ্যোগ৷ সে বছর মিশর, ইরাক, জার্মানি, গিনি ও ব্রাজিলের ৯টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয় এখানে৷ মাত্র ৫৮০ বর্গমিটারের এই আয়োজনে ২৫০ জন বাণিজ্যিক পরিদর্শক অংশ নেন৷
পরের বছর বিভিন্ন কারণে এই আয়োজন অনুষ্ঠিত করা যায়নি৷ তবে তার পরবর্তী বছরগুলোতে আস্তে আস্তে এটি বড় হতে থাকে৷ মাত্র পাঁচটি দেশকে নিয়ে সেই আয়োজন এখন পাঁচটা মহাদেশের ১৮০টিরও বেশি দেশের আয়োজনে পরিণত হয়েছে৷ এ বছর ১০ হাজারেরও বেশি স্টল বসেছে৷ বাণিজ্যিক পরিদর্শক এসেছেন প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার৷
১ হাজারেরও বেশি বিশ্বের শীর্ষ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নিয়েছে৷ মেলার পরিসর এখন ১ লাখ ৬০ হাজার বর্গমিটার৷ গত মঙ্গলবার শুরু হওয়া পাঁচ দিনের এ আয়োজনে আর্থিক লেনদেন হয়েছে প্রায় ৭শ’ কোটি ইউরো বা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকা৷
এবারের আয়োজনে বিশ্বের সব নামকরা টুরিজম এজেন্সি বা অপরেটররা যেমন অংশ নিয়েছে, তেমনি সরকারি বেসরকারি এয়ারলাইন্স, ক্রুজ, বিমানবন্দর, শহর ও রাজ্য কর্তৃপক্ষ, দেশের প্রতিনিধিরা এসেছেন৷ বড় বড় হোটেল, রিসোর্টগুলোও নিজস্ব স্টল নিয়ে এসেছে৷
পর্যটক ও পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সবাই তাদের পর্যটনকেন্দ্রগুলোর সংস্কৃতি, খাবার, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও নৈসর্গিক সৌন্দর্য তুলে ধরেছেন৷ সাধারণ ভ্রমণপিপাসু মানুষও এসেছেন অনেক৷ তারা তাদের পছন্দের জায়গাগুলোতে ভ্রমণ করবার জন্য তথ্য সংগ্রহ ও অপারেটরদের অফারগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেছেন৷ এছাড়া এমন একটি আয়োজনে অনেক দেশ ও অঞ্চল সম্পর্কেও তারা জানতে পেরেছেন৷
এছাড়া এই আয়োজনে বিভিন্ন পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পেপার প্রেজেন্টেশন ও আলোচনা হয়েছে৷ সেগুলোতে পর্যটন খাতের সমস্যা ও সম্ভাবনার নানা দিকও উঠে এসেছে৷
এগিয়ে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা
বিশ্বজুড়ে অনেক জায়গায়তেই সন্ত্রাস, যুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরও মানুষের ভ্রমণ প্রবণতা বাড়ছে৷ যদিও এসব কারণে অনেকেই তুলনামূলক ‘নিরাপদ’ জায়গায় ভ্রমণ করারই পক্ষপাতী৷ ওয়ার্ল্ড ট্র্যাভেল মনিটরের গবেষণা বলছে, ২০১৮ সালে অন্তত ৩৩ ভাগ মানুষ তাদের ভ্রমণের স্থান বদলে নিরাপদ জায়গায় ভ্রমণ করবেন৷
সেখানে পছন্দের তালিকায় উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপই ওপরের দিকে অবস্থান করছে৷
২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত হিসেবে দেখা যায় উত্তর অ্যামেরিকায় মানুষের ভ্রমণ প্রবণতা আগের বছরের তুলনায় সবচেয়ে বেড়েছে, ৭ দশমিক ৫ ভাগ৷ ইউরোপে বেড়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ৷ ল্যাটিন অ্যামেরিকাতেও মানুষের আগ্রহ বেড়েছে ৫ ভাগ৷
ছবি: ডয়চে ভেলে ছবি: ডয়চে ভেলে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও পর্যটকদের আগ্রহ বাড়ছে৷ এখানেও বেড়েছে ৫ ভাগ৷ মূলত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ মালয়শিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ায় পর্যটকদের আগ্রহ বেশি৷ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, ভূটান ও মালদ্বীপে পর্যটকদের আগ্রহ অনেক বেশি৷
পর্যটনের নির্দিষ্ট বাজারের কথা বললে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে রাশিয়ায়৷ ২০১৭ সালে তাদের পর্যটকের সংখ্যা বেড়েছে আগের বছরের তুলনায় ১৮ ভাগ৷ অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অস্থিরতার কারণে মেক্সিকোতে পর্যটকের সংখ্যা কমেছে সবচেয়ে বেশি, ৫ ভাগ৷
তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রগুলোর মধ্যে স্পেনে পর্যটকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে৷ গত বছর প্রবৃদ্ধির হার ১১ ভাগ৷
গড়ে ৮ রাত
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সালে ভ্রমণের সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ৬ ভাগ বেড়েছে৷ এমনকি একজন পর্যটক এখন একটি জায়গায় আগের চেয়ে বেশিদিন থাকছেন৷ গড়ে প্রতিজনে তা ৮ রাত বলে জানিয়েছে ওয়ার্ল্ড ট্র্যাভেল মনিটর৷
এ বিষয়ে পর্যটন ডেটা নিয়ে কাজ করে এমন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইপিকে ইন্টারনেশনালের সিইও রলফ ফ্রাইটাগ বলেন, ‘‘এ এক অসাধারণ অগ্রগতি৷ বিশ্ব জিডিপির চেয়েও তিনগুণ বেশি আয় এখন পর্যটন খাতে৷ বিশ্ব অর্থনীতিতে এখন পর্যটন একটি বিরাট খাত৷”
তিনি মনে করেন, যদিও ভ্রমণকারীরা নিরাপত্তার কথাও বিবেচনা রাখেন, তবে তাদের কাছে খরচ ও পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে কী পাচ্ছেন তা এখনো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ৷
তবে ২০১৮ সালে পর্যটকদের সংখ্যা বাড়লেও তা ২০১৭ সালের মতো এতটা নাও হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে৷
শহর ভ্রমণে আগ্রহ বেশি
অনেকেরই একটা ধারণা আছে যে, ভ্রমণ মানেই সমুদ্র সৈকত, পাহাড় বা বিভিন্ন হলিডে স্পট৷ কিন্তু পরিসংখ্যান বলে, সাধারণ পর্যটকদের মধ্যে শহর ভ্রমণের আগ্রহই বেশি৷
ছবি: ডয়চে ভেলে ছবি: ডয়চে ভেলে সারাবিশ্বে পর্যটন প্রবণতা বাড়তে থাকার একটি বড় নিয়ামক শহর ভ্রমণ৷ আগের বছরের তুলনায় ২০১৭ সালে শহর ভ্রমণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ ভাগ, যেখানে সমুদ্র সৈকত ও সূর্যস্নানের জায়গাগুলোতে পর্যটকদের আগ্রহ বেড়েছে ৯ ভাগ৷
বিস্ময়ের ব্যাপার অন্যান্য ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতে পর্যটকদের আগ্রহ বরং কমেছে ২ ভাগের মতো৷ বন্ধু ও আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে আগের বছরের তুলনায় মানুষ দেখা করতে গেছেন ৮ ভাগ বেশি৷
ব্যবসার কাজে ভ্রমণের হার বেড়েছে ৬০ ভাগ৷
‘মিলেনিয়াল’রাই চাবিকাঠি
মিলেনিয়াল বা যাদের জন্ম ১৯৮০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে তারাই পর্যটন খাতের চাবিকাঠি৷ সারাবিশ্বে এরাই সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করছেন এবং এ খাতের অর্থনীতি চালু রাখছেন৷ বিশেষ করে মুসলিম পর্যটকদের মধ্যে এই বয়সীদের সংখ্যা বেশি৷
পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন মুসলিম জনগোষ্ঠীর ৬০ ভাগের বয়স ত্রিশের নিচে৷ সিঙ্গাপুরভিত্তিক ক্রিসেস্ট রেটিং অ্যান্ড হালাল ট্রিপের প্রধান নির্বাহী ফজল বাহারদীন বলেন, ‘‘এরাই পর্যটনের ভবিষ্যৎ বাজার৷”
তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী হলো, ২০১৬ সালে মুসলিমরা প্রায় ১২১ বিলিয়ন ডলার পর্যটনে ব্যয় করেছেন, যা ২০২০ সাল নাগাদ ২২০ বিলিয়নে পৌঁছাবে৷
তাঁর মতে, এদের একটা বড় অংশ এশিয়াতেই ভ্রমণ করছেন৷ মালয়শিয়া ও ইন্দোনেশিয়াকে ভবিষ্যৎ পর্যটনের বড় বাজার বলে মনে করেন তিনি৷ ইউরোপে তিনি জানান, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্সে ১০ থেকে ১২ শতাংশ মুসলিম ভ্রমণ করছেন৷ এছাড়া তুরস্ক ও ইরানও মুসলিম পর্যটকদের জন্য বড় বাজার৷
সব মিলিয়ে আইটিবি বার্লিন ২০১৮ বরবারের মতোই আগামীর পর্যটনকে পথ দেখাচ্ছে৷ এখান থেকেই হয়তো গড়ে উঠছে এ খাতের ভবিষ্যৎ কর্ণধাররা৷ একইসঙ্গে নীতিনির্ধারকদের সুযোগ করে দিচ্ছে পর্যটনের নতুন নতুন ভাবনাকে একীভূত করে সামনে পথ চলার৷ ডয়চে ভেলে বাংলা