ঘাম, রক্ত, এমনকি জীবন দিয়েও পরিবার ও দেশের ভাগ্য পরিবর্তনে ভূমিকা রাখেন তাঁরা৷ গত চল্লিশ বছরে বিদেশ থেকে তাঁরা ১০ লাখ ৪৬ হাজার ৩২ কোটিরও বেশি টাকা পাঠিয়েছেন বাংলাদেশে৷ সরকার কি তাঁদের জন্য বেশি কিছু করেছে?
প্রবাসী শ্রমিক
সরকারি হিসেব অনুযায়ী গত ৪০ বছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা কমপক্ষে ১০ লাখ ৪৬ হাজার ৩২ কোটি টাকা পাঠিয়েছেন বাংলাদেশে৷ প্রকৃত অঙ্কটি নিঃসন্দেহে অনেক বেশি হবে৷ পরিবার ও দেশের জন্য এমন অবদান রাখতে গিয়ে অকাতরে জীবনও দিচ্ছেন অনেকে৷ একটি জাতীয় দৈনিকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ থেকে ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত মোট ৯৮ লাখ ৮৯ হাজার ৫৫৫ জন বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে কাজ করতে গিয়েছেন৷
ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বাংলাদেশিদের বিদেশে পাড়ি জমানোর প্রবণতা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে৷ এর পাশাপাশি প্রবাসে নির্যাতনও বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে৷ প্রায় নিয়মিতই আসছে মৃত্যুর খবর৷ পরিবারে সুদিন ফেরানোর আশায় বিদেশে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরছেন অনেকে৷ গত এক দশকে ২৫ হাজার ২২৯ জন ফিরেছেন লাশ হয়ে৷ গত বছর, অর্থাৎ ২০১৫ সালেও বাংলাদেশে এসেছে মোট ৩ হাজার ৩০৭ জন প্রবাসীর লাশ!
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসে ২২০ জন প্রবাসীর লাশ৷ তাদের মধ্যে ১৮২ জনের মৃত্যুকেই খুব স্বাভাবিক বলা যায় না৷ অধিকাংশেরই মৃত্যুর কারণ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, হৃদরোগ, কর্মক্ষেত্র বা সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা ক্যানসারের মতো জটিল কোনো রোগ৷
প্রবাসে একা থাকা, নিজের ও পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা, খারাপ পরিবেশে কাজ করা ইত্যাদি কারণে হৃদরোগ বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বয়স ৩৫ হওয়ার আগেই অনেকের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিচ্ছে৷
সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৯০ লাখ বাংলাদেশি কাজ করছেন৷ এর মধ্যে প্রায় ৫০ লক্ষই আছেন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে৷ ওই দেশগুলোতে কাজের সার্বিক পরিবেশ খারাপ, শ্রমিক নির্যাতনও বেশি৷
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড জানাচ্ছে, গত এক দশকে বিদেশ থেকে ২২ হাজার ৬৫১ জনের লাশ ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে বাংলাদেশে এসেছে৷ এর মধ্যে ১২ হাজার ৫৫৭ জনই কাজ করতেন মধ্যপ্রাচ্যের কোনো-না-কোনো দেশে৷ ৫ হাজার ৭৩১ জন ছিলেন সৌদি আরবে, ২ হাজার ৫২০ জন সংযুক্ত আরব আমিরাতে, ২ হাজার ১৮৪ জন কুয়েতে, ১ হাজার ১০২ জন ওমানে, ৫৩৪ জন বাহরাইনে এবং ৪৮৬ জন কাতারে ভাগ্যান্বেষণে গিয়ে লাশ হয়ে ফেরেন৷
গত কয়েক বছরে নারীদের বিদেশ গমনও বেড়েছে৷ বিদেশে তাঁদের জীবন আরো কঠিন৷ দৈনিক ১৮ ঘণ্টা কাজ করেও অনেকে প্রাপ্য পারিশ্রমিক পান না৷ শারীরিক, মানসিক নির্যাতন তো আছেই, যৌন নিপীড়ন, এমনকি ধর্ষণের শিকারও হন অনেকে৷ নিয়োগকর্তা স্বজনহীন পরিবেশে অসহায়ত্বের সুযোগে নারীদের দেহ ব্যবসায় বাধ্য করছেন – এমন খবরও নতুন কিছু নয়৷
তবুও ভাগ্যান্বেষণে দেশ ছাড়তে হয়৷ তারপরও বৃদ্ধ বাবা-মা, বেকার, ঋণগ্রস্ত স্বামী বা প্রিয় সন্তানের জন্য বহু দূরের অচেনা দেশে যেতেই হয়৷ এক ইউটিউব ভিডিওতে এমনই কয়েকজন নারীর বাস্তব কাহিনি দেখানো হয়েছে, যাঁদের মধ্যে একজন দেশ ছেড়েছিলেন স্বামীর ঋণ পরিশোধ করতে৷ তবে ৪ বছর ৮ মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করেও প্রায় শুন্য হাতে ফিরতে হয়েছে তাঁকে৷ ভোর চারটায় উঠে শুরু করতেন থালাবাসন ধোয়া৷ তারপর বিশাল বাড়ির সব মেঝে ধোয়া-মোছা শেষে শুরু হতো একে একে আটটি টয়লেট সাফ করার কাজ৷ একটু বিশ্রাম নেবেন সেই সুযোগ নেই৷ কাপড় শুকাতে দিয়েই যেতে হতো মালিকের মেয়ের বাড়িতে৷ সেখানেও রাজ্যের কাজ৷ মেয়ের বাড়ির কাজ শেষে মালিকের নতুন নির্দেশ – এবার যেতে হবে ভাইয়ের বাড়ির ছাগলের ঘর পরিষ্কার করতে৷ চুক্তির বাইরে এত অতিরিক্ত কাজের জন্য বাড়তি পারিশ্রমিক চাইলেও বিপদ৷ মালিক তখন রেগেমেগে বলত, ‘‘মেরে লাশ ফেলে দেব পাহাড়ে৷”
কোনো সরকার কি ঘাম, রক্ত, এমনকি জীবন দিয়েও পরিবার ও দেশের সুন্দর আগামী নির্মাণে ভূমিকা রেখে যাওয়া এই প্রবাসী বাংলাদেশিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পর্যাপ্ত উদ্যোগ নিয়েছে?