৯৬ লাখ ঋণখেলাপিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে চীন। পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট কালো তালিকাভুক্ত হওয়ায় এয়ার টিকিট ক্রয় থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তারা। কিনতে দেয়া হয়নি হাই-স্পিড ট্রেনের টিকিটও। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে এ কঠোর পদক্ষেপের ফলও পেয়েছে দেশটি। ২ শতাংশেরও নিচে রয়েছে চীনের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়ায় গতি এনে ফল পেয়েছে শ্রীলংকা। এ ধরনের নানা কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশও।
যদিও উল্টোটা ঘটছে বাংলাদেশে। ঋণখেলাপি হয়েও শাস্তি না পাওয়ার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে দেশে। এমনকি আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণও করছেন ঋণখেলাপিদের অনেকে। এতে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে খেলাপি ঋণের হার। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের এটাই সর্বোচ্চ হার। খেলাপি ঋণের হারে বাংলাদেশের প্রায় সমপর্যায়ে আছে কেবল ভারত। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে দেশটির ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ।
গত বছরের ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার এক অংকে নামলেও চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিকেই তা বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে অস্বাভাবিক বেশি রকম ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। নতুন বিতরণকৃত এসব ঋণের পাশাপাশি পুনঃতফসিলকৃত ঋণও মার্চ প্রান্তিক থেকে খেলাপি হতে শুরু করবে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের হার উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি হওয়ার বিষয়টি তারাও অবগত বলে জানান অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. ইউনুসুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, এটা না হলেই আমি খুশি হতাম। এর বেশি কিছু বলার নেই। তবে অর্থমন্ত্রী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলেন, এর আগে আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার আরো বেশি ছিল। সেজন্য খেলাপি ঋণের বিদ্যমান হার অস্বাভাবিক নয়।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে কঠোর পদক্ষেপগুলো নিয়েছে শ্রীলংকা। ৯৫ লাখ ৬০ হাজার ঋণখেলাপির ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলার আমানত জব্দের পাশাপাশি ৬১ লাখ ঋণখেলাপিকে উড়োজাহাজের টিকিট কিনতে দেয়া হয়নি। হাই-স্পিড ট্রেনের টিকিট কিনতে পারেননি ২২ লাখ ঋণখেলাপি। ঋণ ও ক্রেডিট কার্ডের জন্য অযোগ্য ঘোষণার পাশাপাশি ঋণখেলাপিদের সন্তানদের দামি স্কুলে ভর্তির ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এসব কঠোর পদক্ষেপের ফলে চীনের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশে।
খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে আরেক উন্নয়নশীল দেশ ভিয়েতনামের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। নতুন নিয়ম অনুসারে রেমিট্যান্স সেবার জন্য একটি পরিচালন কাঠামো গড়ে তোলার আগে সেখানকার ব্যাংকগুলোকে নিশ্চিত করতে হচ্ছে, তাদের খেলাপি ঋণের হার ৩ শতাংশের কম। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশটিতে রেমিট্যান্স আন্তঃপ্রবাহ যে হারে বেড়েছে, তাতে কোনো ব্যাংকই এ ব্যবসা হাতছাড়া করতে চাইবে না। স্বাভাবিকভাবেই দেশটির ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ভিয়েতনামের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের হার ২ শতাংশের নিচে রেখেছে এশিয়ার দেশ ও ফিলিপাইনও। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর শেষে মালয়েশিয়ার খেলাপি ঋণের হার ১ দশমিক ৬ ও ফিলিপাইনের ১ দশমিক ৯ শতাংশ। খেলাপি ঋণের হার ৩ শতাংশের নিচে রাখতে পেরেছে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া ও শ্রীলংকা। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, থাইল্যান্ডের খেলাপি ঋণের হার ২ দশমিক ৯, ইন্দোনেশিয়ার ২ দশমিক ৯, কম্বোডিয়ার ২ দশমিক ৫ ও শ্রীলংকার ২ দশমিক ৬ শতাংশ।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সার্বভৌম ও শক্তিশালী করার মাধ্যমে বাংলাদেশেও খেলাপি ঋণের হার কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, যেকোনো ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা বাংলাদেশ ব্যাংককে নিতে হবে। কোনো ক্ষেত্রে দুর্বলতা প্রদর্শন মানেই দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা। এছাড়া উচ্চ আদালতে খেলাপি গ্রাহকদের জন্য পৃথক বেঞ্চ গঠন করা দরকার। এটি সম্ভব হলে ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হবেন। ফলে দেশ ঋণখেলাপির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের হারে বাংলাদেশের সমপর্যায়ে আছে ভারত। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে দেশটির ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে খেলাপি এ হার কমিয়ে আনতে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে দেশটি। ‘ফিউজিটিভ ইকোনমিক অফেন্ডারস বিল’ নামে একটি আইন অনুমোদন করেছে দেশটির মন্ত্রিসভা। আইনটির আওতায় কোনো ঋণখেলাপি দেশ ত্যাগ করলে তার সম্পদ জব্দ করা যাবে। এছাড়া বিজয় মালিয়ার মতো ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির পাসপোর্টও প্রত্যাহার করেছে দেশটি।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের খেলাপি ঋণের হারও কিছুটা বেশি। ২০১৭ সাল শেষে পাকিস্তানের খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ২ শতাংশ। যদিও ২০১১ সালে দেশটিতে খেলাপি ঋণের হার ছিল ১৬ শতাংশের বেশি।
বাংলাদেশে ঋণখেলাপি হয়েও শাস্তি না পাওয়ার সংস্কৃতির কারণে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে খেলাপি ঋণের হার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১১ সালে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৬ শতাংশের মতো। কিন্তু ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর শেষে তা ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশে দাঁড়ায়। তবে বছর শেষে তা কিছুটা কমেছে। মূলত বিপুল পরিমাণ ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমেই খেলাপি ঋণের হার এক অংকে নামিয়ে আনা হয়েছে।
খেলাপি ঋণের হার কমাতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের আলাদা করার পক্ষে মত দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় অনুষদের ডিন ও সাধারণ বীমা করপোরেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম। তিনি বলেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করে টাকা উদ্ধারে পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে কোনো গ্রাহকের ঋণ খেলাপি হয়ে গেলে ব্যাংকগুলোর উচিত তাকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখা।
এক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। এরপর ২০১০ ও ২০১১ সালে এ খাতে খেলাপি ঋণ কিছুটা নিয়ন্ত্রিত ছিল। কিন্তু ২০১২ সাল থেকে লাগামহীন হয়ে পড়ে খেলাপি ঋণ। ২০১২ সাল শেষে ৪২ হাজার ৭২৬ কোটি, ২০১৪ সাল শেষে ৫০ হাজার ১৫৫ কোটি, ২০১৫ সাল শেষে ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি ও ২০১৬ সাল শেষে ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা দাঁড়ায় ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ। ২০১৭ সাল শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরো বেড়ে ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকায় ঠেকেছে।
বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা ও আইনি কাঠামোর দুর্বলতার কারণে দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, চাহিদার বিপরীতে দেশে অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা খুবই কম। ফলে এ আদালতগুলোয় মামলা নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হচ্ছে। নিম্ন আদালত থেকে ব্যাংকের পক্ষে আদেশ এলেও উচ্চ আদালতে রিটের কারণে খেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ উদ্ধার প্রক্রিয়া আটকে যাচ্ছে। তবে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পেছনে ব্যাংকারদের দায়ও কম নয়। যাচাই-বাছাই না করে অনেক সময় ব্যাংকাররা ঋণ দিয়েছেন। ফলে সেসব ঋণ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা বেশি। ফলে কিছু ব্যাংক ব্যবসা বাড়ানোর জন্য অনৈতিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে। গুণগত মান নিশ্চিত না করে ঋণ বিতরণের কারণেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।