বিদেশে বাংলাদেশি পাসপোর্টের মান কমেছে। মোটা দাগে এ অভিযোগ আসছে অনেক দিন ধরে। এ জন্য কারণে-অকারণে সাধারণ ও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীরা ভিন দেশে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এয়ারপোর্ট থেকে ফিরতি বিমানে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটছে। ‘পাসপোর্ট কাণ্ড’ নিয়ে বিভিন্ন মহল দালালচক্র ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের দৌরাত্ম্যকে দায়ী করলেও পাসপোর্ট অধিদপ্তর উল্টো গ্রাহকদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। গ্রাহকরা তথ্য পরিবর্তন করায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশি পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা কমছে বলে মন্তব্য করে সমপ্রতি এমআরপি পাসপোর্টে সব ধরনের তথ্য পরিবর্তন বন্ধে আদেশ জারি করা হয়।
আদেশে এও বলা হয়- তথ্য পরিবর্তন করে ভিন্ন তথ্য সংবলিত পাসপোর্ট গ্রহণের ফলে বাহককে বিভিন্ন ইমিগ্রেশনে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাসপোর্ট অধিদপ্তরের আচমকা জারি করা এ আদেশের ফলে সাধারণ লোকজন এবং বিদেশে বাংলাদেশিদের ভোগান্তি ও হয়রানি আরো বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। পররাষ্ট্র দপ্তরের কনস্যুলার সংক্রান্ত বিষয়াবলি দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং দূতাবাসগুলোতে কনস্যুলারে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন কর্মকর্তারা ঢালাও অভিযোগ করে জারি করা এ দেশের মিশনগুলোর কাজে বাড়তি চাপ তৈরি করবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, নানা কারণে এ পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে। এটি যারা দেখভাল করেন শুধু তারাই বোঝেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রাহকদের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং জন্ম নিবন্ধন সনদের তথ্যে গরমিল এবং শিক্ষক বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মনগড়াভাবে একেক পরীক্ষার জন্য একেক জন্ম তারিখ লিখে দেয়ার কারণেও পাসপোর্টধারীদের অনেক সময় তথ্য পরিবর্তন এমনকি বয়স সংশোধন জরুরি হয়ে পড়ে। অবশ্য পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছে, এটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়নি। তারা যৌক্তিক পরিবর্তনগুলো বিবেচনায় রাখছেন। বিদেশে বাংলাদেশি পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো তথা দেশের সুমান বৃদ্ধির জন্যই এই অফিস আদেশ জারি করেছে। বিষয়টি জনগণকে অবহিত করতে পাসপোর্ট অফিসগুলোর পক্ষ থেকে সচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে। তবে ছোটখাটো ভুল সংশোধন অব্যাহত রয়েছে।
মহাপরিচালকের পক্ষে পরিচালক (পাসপোর্ট, ভিসা ও পরিদর্শন) মো. সাইদুর রহমান গত ৭ই মার্চ ওই আদেশ জারি করেন। পররাষ্ট্র, প্রবাসী কল্যাণ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের সচিব এবং পুলিশের অতিরিক্ত মহা-পরিদর্শক (বিশেষ শাখা)কে অবহিত করে বিদেশে বাংলাদেশের সব দূতাবাস ও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসগুলোতে কার্যার্থে পাঠানো অধিদপ্তরের ওই আদেশে বলা হয়েছে- সামপ্রতিক সময়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আবেদনকারী পাসপোর্টে তাদের অনুকূলে ইস্যুকৃত এমআরপি সমর্পন করে নিজের নাম বা পিতা কিংবা মাতার নাম অথবা প্রাক পরিচয় সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করে এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে বয়স পরিবর্তন (সংশোধন) করে পাসপোর্ট রি-ইস্যুর জন্য আবেদন করছেন। এভাবে যত্রতত্র তথ্য পরিবর্তন করে পাসপোর্ট রি-ইস্যু করায় মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি)-এর গ্রহণযোগ্যতা বহির্বিশ্বে নিদারুণভাবে হ্রাস পাচ্ছে। এখন পর্যন্ত তথ্য পরিবর্তন সংবলিত যে সব আবেদনপত্র পাসপোর্ট অফিসগুলো গ্রহণ করেছে তার বিষয়ে অধিদপ্তরের নির্দেশনা সংক্রান্ত আদেশে বলা হয়েছে- সেই সব আবেদনকারীকে কলনোটিশ প্রদান করে আগের তথ্যানুযায়ী পাসপোর্ট প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই অপারেটরের ভুল কিংবা বানান ভুল ব্যতীত রি-ইস্যুতে কোনো রূপ তথ্য পরিবর্তন করা যাবে না। আগামী দিনে এ সংক্রান্ত নতুন আবেদন গ্রহণ না করার বিষয়েও নির্দেশনা দিয়েছে পাসপোর্ট অধিদপ্তর।
উলফা নেতা রাজখোয়া, ধরা পড়া জঙ্গি ও মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহারের প্রমাণ রয়েছে।
উল্লেখ্য, গ্রহণযোগ্যতার বিচারে বাংলাদেশি পাসপোর্টের অবস্থান একেবারে নিম্ন সারিতে। এ পাসপোর্টে বাংলাদেশিদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে বিশ্বের অনেক বিমানবন্দরেই। বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানোর ঘটনাও ঘটছে। তার পরও অভিবাসনের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ওপরের সারিতে। অভিবাসন সংক্রান্ত জাতিসংঘের ২০১৭-এর প্রতিবেদন বলছে, যে পাঁচটি দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অভিবাসন হচ্ছে, তার মধ্যে আছে বাংলাদেশ। এদিকে বিশ্বে ভিসামুক্ত চলাচল স্বাধীনতার ওপর গবেষণা করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা দ্য হ্যানলি অ্যান্ড পার্টনার্স ২০০টি দেশের পাসপোর্টের মান বা অবস্থান নির্ধারণ করে চলতি বছরে যে রিপোর্ট করেছে তাতে বাংলাদেশি পাসপার্টের অবস্থান ৯৭তম। যা আগের বছরে ছিল ৯০তম। বৈশ্বিক ওই সংস্থার রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশি পাসপোর্টের মূল্যায়ন ওজন ৭ ধাপ কমেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে একই সূচকে আছে লেবানন, ইরান, কসোভো। তাদের রিপোর্ট মতে, বিশ্বের সবচেয়ে ওজনদার বা শক্তিশালী পাসপোর্ট হচ্ছে জাপান ও সিঙ্গাপুরের। দুর্বলতম পাসপোর্টের দেশ বোমা হামলায় জর্জরিত আফগানিস্তান। তাদের অবস্থান ১০৫তম। বাংলাদেশি পাসপোর্ট প্রদানের প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে দুর্নীতি নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি)র। প্রতিষ্ঠানটির তরফে পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান পুলিশ ভেরিফিকেশন পদ্ধতির কারণে সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে বৃটিশ আমল থেকে চলে আসা ওই ব্যবস্থা বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে- পাসপোর্টের আবেদনকারীদের তিন-চতুর্থাংশকেই পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় অনিয়ম ও হয়রানির শিকার হয়ে ‘ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত টাকা’ দিতে হয়। গ্রাহক হয়রানি বন্ধে টিআইবি পুলিশ ভেরিফিকেশনের বদলে সকল নাগরিকের জন্য ‘বায়োমেট্রিক ডাটা ব্যাংক’ এবং ‘অপরাধী তথ্য ভাণ্ডার’ তৈরি করে তার সঙ্গে পাসপোর্ট অফিস ও ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের সংযোগ স্থাপন করার সুপারিশ করেছে।