এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা পাল্টে দিচ্ছেন দেশের অর্থনীতির চিত্র। কৃষিসহ নানা খাতের ব্যবসায় ঝুঁকছেন তারা। সময়ের ব্যবধানে চাকরি করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে তাদের অনেকেই ক্ষুদ্র ব্যবসা-বাণিজ্য অবদান রাখতে শুরু করেছেন। যার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশের আর্থনীতিতে।
যদিও সঠিক পরিসংখ্যান নেই, তবে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তরুণ-তরুণীদের উপস্থিতি বেশ ভালভাবেই অনুভব করা যাচ্ছে। দেশে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক তরুণ-তরুণী উচ্চ শিক্ষা শেষে বেরিয়ে আসছেন। সে অনুযায়ী নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। চেষ্টা করেও সবাই চাকরি পাচ্ছেন না। বস্তুত, এই পরিস্থিতিই তরুণ-তরুণীদের স্ব-উদ্যোগে কিছু করার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সবার সব উদ্যোগ সফল হচ্ছে বিষয়টি এমন নয়। তবে সফলতার দৃষ্টান্তও একেবারে কম নয়। এই সফলতাগুলো অন্যদের উত্সাহিত করছে।
এরকম একজন উদ্যোক্তা হলেন— উচ্চ শিক্ষিত তরুণ সাইফুল ইসলাম। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে অন্য বন্ধুরা চাকরিযুদ্ধে নামলেও নিজে কিছু করার নেশায় সে পথে হাঁটেননি তিনি। সিলেট শহরতলীর বাদাঘাট এলাকায় অ্যাগ্রো ফার্ম গড়ে তুলেছেন। সেখানে প্রাথমিকভাবে দুগ্ধ খামার, ছাগল পালন, পোল্ট্রি খামার ও মাছ চাষ করেছেন এই উদ্যোক্তা। সাইফুলের মতো অনেক তরুণ উদ্যোক্তা গড়ে তুলেছেন কৃষি খামারসহ নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উদ্যোক্তা হওয়ায় ব্যবসায় তাদের সাফল্যের হারও বেশি।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের স্নাতক কে.এম জুলকার নাইন রাদ ও সুলতানা শাম্মীসহ একদল তরুণ-তরুণী গড়ে তুলেছেন স্বপ্নবাংলা নামের একটি গ্রুপ। টুরিজম, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, ফ্যাশন হাউসসহ নানা খাতে বিনিয়োগ করেছেন এই তরুণরা। ব্যবসা প্রশাসন বিভাগের গ্র্যাজুয়েট তফাজ্জল আহমদ, সমাজকর্ম বিভাগের মোঃ জসিম উদ্দিন ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের গ্র্যাজুয়েট মোঃ আব্দুল মজিদসহ ১০ তরুণ মৌলভীবাজারে গড়ে তুলেছেন গ্রীন ট্রাস্ট গ্রুপ। মৌলভীবাজারের বিসিক শিল্পনগরীতে একটি প্লাস্টিকের সামগ্রী তৈরির কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। স্বাস্থ্য-শিক্ষাখাতেও বিনিয়োগ করেছেন এই তরুণ উদ্যোক্তারা।
নৃবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক রুহুল চৌধুরী, ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের রিজওয়ানসহ ১৪ তরুণ-তরুণী মিলে গড়ে তুলেছেন একটি গ্রুপ। সিলেট শহরের বাদাঘাট এলাকায় মাছ চাষ, দুগ্ধ খামার ও পোল্ট্রি খামার গড়ে তোলা হয়েছে। পরিসংখ্যান বিভাগের সোহেল রানা সিলেট শহরতলীর লাখাউড়ায় একটি অ্যাগ্রো ফার্ম গড়ে তুলেছেন। মাছ চাষ, দুগ্ধ খামার ও পোল্ট্রি খামারসহ নানা প্রজাতির ফলও আছে এই খামারে। শুধুমাত্র এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই এমন বহু তরুণ রয়েছেন, যারা চাকরির পেছনে না ঘুরে উদ্যোক্তা হয়েছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষে সোহেল রানা নওগাঁর প্রত্যন্ত এলাকা সাপাহারে ‘রূপগ্রাম অ্যাগ্রো ফার্ম’ নামে গড়ে তুলেছেন একটি সমন্বিত কৃষি খামার। মাছ, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল, দেশি মুরগি, কবুতর, পাখি, আম, লিচু, থাই পেয়ারা, মাল্টা, ড্রাগন, লেবু, প্যাসন ফল, পিচ ফল, জামরুল, খাটো জাতের নারিকেল, শাক-সবজিসহ প্রায় ৪০ জাতের ফলের গাছ আছে সেখানে। এছাড়া বাসক, তুলসী, কালোমেঘ, অর্শগন্ধা, ঘৃতকুমারীসহ নানা জাতের ঔষধি গাছও আছে তার খামারে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগ পেয়ে পড়াশোনা শেষ করেন দেলোয়ার জাহান। মানিকগঞ্জে দেড় একর জায়গায় কৃষি খামার গড়ে তুলেছেন তিনি। দেলোয়ার ও তার কয়েকজন বন্ধু মিলে গড়ে তুলেছেন ‘প্রাকৃতিক কৃষি’ নামে একটি সংগঠন। মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার আমতলী গ্রামে জমি লিজ নিয়ে গ্রীষ্মকালীন সবজি উত্পাদন শুরু করেন। বর্তমানে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার হাজীপুর গ্রামে দেড় একর জমিতে প্রায় ৪০ রকমের সবজি উত্পাদন করছেন এই তারা।
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় ৭ শিক্ষিত তরুণ মিলে গড়ে তুলেছেন অ্যাগ্রো ফার্ম। জিনিয়াস সেভেন গ্রুপের উদ্যোগে নানা খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই ৭ তরুণই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট। তাদের মধ্যে রয়েছেন আ.জ.ম জাকারিয়া, আয়াত মিয়া ও জাকারিয়া আহমদ প্রমুখ। এই গ্রুপ অন্যান্য কয়েকটি খাতেও বিনিয়োগ করেছে।
চুয়াডাঙ্গা সদরের তরুণ আলিমুজ্জামান ও ফিরোজুল হক শিক্ষিত তরুণ। আলিমুজ্জামান ঢাকার নর্দান ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ শেষ করেছেন আর ফিরোজুল হক স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছেন। দুজনে মিলে ১০ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন কৃষি খামার। উত্পাদন করছেন ফল ও শাকসবজি। ঢাকা কলেজে মাস্টার্স পড়ার পাশাপাশি নিজের এলাকা রাজবাড়ীতে কৃষি খামার গড়ে তুলেছেন আমিরুল ইসলাম আমির। নিজের পর্যাপ্ত জমি না থাকায় বর্গা নিয়ে ধানসহ বিভিন্ন রকমের সবজি উত্পাদন করছেন এই তরুণ উদ্যোক্তা। রাজধানীর বাড্ডাতে টার্কি খামার গড়ে তুলে সাড়া ফেলেছেন প্রকৌশলী শাহীন হাওলাদার ও তরুণ উদ্যোক্তা মিরাজ হোসেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মতে তরুণরাই এখন কৃষির প্রাণ। কৃষিকাজে জড়িতদের ৬০-৭০ শতাংশই ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণ।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি ও নীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. জসিম উদ্দিন আহমদ বলেছেন, তরুণদের চাকরি নেয়া নয়, চাকরি দেয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। আর এটা একমাত্র উদ্যোক্তাদের দ্বারাই সম্ভব। যে হারে চাকরির পেছনে তারুণ্যের সময় নষ্ট হচ্ছে, সেই সময় উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে ব্যয় করলে রীতিমত বিপ্লব হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে শিক্ষার্থীদের কাছে একাডেমিক পড়াশুনা মুখ্য বিষয় নয়, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতেই তারা বিসিএসের পড়াশুনা শুরু করে। এটা ভীতিকর একটা বিষয়। তিনি আরো বলেন, দেশে কৃষি ও মাছ চাষের সেক্টরে ব্যবসা করার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য মানসম্পন্ন ইনস্টিটিউট গড়ে ওঠে নাই। এজন্য সরকার প্রযুক্তি নির্ভর একটি আধুনিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করতে পারে। সেখানে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধমে দক্ষ উদ্যোক্তা গড়ে তোলা যাবে। ফলে কৃষি সেক্টরে সত্যিকারের বিপ্লব সাধিত হবে। তিনি বলেন, শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্য সরকার নানা প্রদক্ষেপ নিতে পারে। সফট লোনের ব্যবস্থা করতে পারলে বহু নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে। সুযোগ সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থানের ফলে কমে আসবে বেকারত্বও।