এশিয়ান বাংলা, চুয়াডাঙ্গা : চুয়াডাঙ্গায় ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল হাসপাতালে ছানি অপারেশনের পর ২০ রোগীর চোখ হারানোর ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। দাবি করা হচ্ছে, অপারেশনের সময় ব্যবহূত আমদানি করা ওষুধের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার কারণেই এই ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার পর গত বৃহস্পতিবার চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জন ডা. খায়রুল আলম হাসপাতালটির চক্ষু বিষয়ক সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে অস্ত্রোপচারকারী চিকিত্সকের একাডেমিক সকল সনদ তলব করা হয়েছে।
চলতি মাসের ৫ মার্চ ওই হাসপাতালে ছানিপড়া ২৪ রোগীর একটি করে চোখ অপারেশন করা হয়। অপারেশনের একদিন পরই ছাড়পত্র দিয়ে রোগীদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বাড়ি ফেরার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ২০ রোগীর চোখে যন্ত্রণা শুরু হয়। পরে তারা একে একে পুনরায় ওই হাসপাতালে ভর্তি হন। প্রাথমিক পরীক্ষায় ২০ রোগীরই চোখে ধরা পড়ে ইনফেকশন। অবস্থা বেগতিক দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গোপনে তাদের ঢাকার ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট ও ভিশন আই হাসপাতালে ভর্তি করান। সেখানে প্রত্যেকের পুনরায় অপারেশন করে ইনফেকশনে নষ্ট হয়ে যাওয়া চোখটি তুলে ফেলা হয়।
ওষুধে ছিল ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া : শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালটিতে রোগীর উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম। চক্ষু সেবার ইনডোর ও আউটডোর চেম্বারসহ অপারেশন থিয়েটারটি ছিল তালাবন্ধ। হাসপাতালের কমিউনিটি হেলথ সেন্টারের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ডা. শফিউল কবির জিপু বলেন, ‘এ ঘটনায় আমরা চরম বিব্রত। অপারেশন করার পর যে ২০ জনের চোখে ইনফেকশন ধরা পড়েছে, সেখানে হাসপাতাল বা চিকিত্সকের কোনো ত্রুটি নেই।’ তিনি দাবি করেন, অপারেশনে ‘ওরাবুলু’ নামের ব্যবহূত ওষুধে ‘গ্রাম নেগেটিভ সিসিলি’ ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আর এ থেকেই রোগীদের চোখে ইনফেকশন হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি।’ অপারেশনে ব্যবহার করা ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কী-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওষুধ কোম্পানিটি ভারতীয়। এ ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণে ম্যানেজমেন্ট দফায় দফায় বৈঠক করেছে।’
চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডা. খায়রুল আলম বলেন, হাসপাতালের চিকিত্সক ও কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতায় স্বাস্থ্য বিভাগ বিব্রত। ইতোমধ্যে হাসপাতাল পরিদর্শনের পাশাপাশি অপারেশনে ব্যবহার করা ওষুধপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়া পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত হাসপাতালটির চক্ষু চিকিত্সা সংক্রান্ত সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে
তদন্ত কমিটি গঠন, চিকিত্সকের সনদ তলব : গত বুধবার সিভিল সার্জনের নির্দেশে সদর হাসপাতালের চক্ষু কনসালটেন্ট ডা. শফিউজ্জামান সুমনকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রধান জানান, ২৪ রোগীর অস্ত্রোপচারকারী ডা. মোহাম্মদ শাহীনের সব একাডেমিক সনদ স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান সিভিল সার্জনের কাছে পেশ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শনিবার (আজ) তদন্ত কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করবে।
চোখ হারালেন যারা : হাসপাতালটিতে চোখের অপারেশন করিয়ে একটি করে চোখ হারিয়েছেন চুয়াডাঙ্গা গাইদঘাটের গোলজার হোসেন, আলুকদিয়ার ওলি মোহাম্মদ, আলমডাঙ্গার বাড়াদী এনায়েতপুরের খন্দকার ইয়াকুব আলী, খাসকররার লাল মোহাম্মদ, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার সোনাপট্টির অবনী দত্ত, মোড়ভাঙ্গার আহমেদ আলী, হারদীর হাওয়াতন, দামুড়হুদার লক্ষ্মীপুরের তৈয়ব আলী, মদনার মধু হালদার, আলমডাঙ্গার নতিডাঙ্গার ফাতেমা খাতুন, খাস-বাগুন্দার খবিরন নেছা, জীবননগরের সিংনগরের আজিজুল হক, দামুড়হুদার চিত্লার নবীছদ্দিন, মজলিশপুরের সাফিকুল ইসলাম, আলমডাঙ্গার রংপুরের ইকলাস, দামুড়হুদার কার্পাসডাঙ্গার গোলজান, সদাবরীর হানিফা, আলমডাঙ্গার স্টেশনপাড়ার কুতলি খাতুন, কুটি পাইকপাড়ার ঊষা রাণী ও দামুড়হুদার বড় বলদিয়ার আয়েশা খাতুন।
ভুক্তভোগী আলমডাঙ্গার সোনাপট্টির আবনী দত্ত আক্ষেপ করে বলেন, ‘বয়সের ভারে এমনিতেই ঠিকমত চলাফেরা করতে পারি না। প্যাকেট বানিয়ে কোনোরকমে সংসার চালাতাম। একটি চোখ উঠানোর পর অন্য চোখটিতেও ঠিকমত দেখতে পাচ্ছি না। এখন কি করে সংসার চালাব- এ ভেবেই রাতে ঘুমাতে পারছি না।’ প্রায় অভিন্ন সুরে বাড়াদী এনায়েতপুরের খন্দকার ইয়াকুব আলী বলেন, ‘হাসপাতালে মানুষ যায় সুস্থ হতে। আর আমরা গিয়ে অন্ধ হলাম।’ চুয়াডাঙ্গা গাইদঘাটের গোলজার হোসেন ছিলেন এমনিতেই প্রতিবন্ধী। দর্জির কাজ করে সংসার চালাতেন। চোখ হারিয়ে এখন ঘোর অন্ধকার দেখছেন তিনি।