এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার প্রথম দিনে কোনো মাধ্যম থেকে প্রশ্নফাঁসের খবর পাওয়া যায়নি। আগের রাতে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক গুজব ছিল। কেউ কেউ কথিত প্রশ্নপত্র ছড়িয়েছে। ভুয়া প্রশ্ন ছড়িয়ে ১১ জন আটকও হয়েছে। সিলেটের কুলাউড়ায় মোবাইল ফোন নিয়ে কেন্দ্রে যাওয়ায় দুই শিক্ষককে জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়া এক বছরের জন্য পরীক্ষার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এভাবে পরীক্ষার ব্যাপারে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন, কঠোর মনিটরিং এবং নতুন তিন পদক্ষেপে প্রশ্নফাঁস ঠেকানো গেছে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ মনে করেন, সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার কারণেই প্রশ্নফাঁস ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। তবে পরীক্ষার শেষদিনটি পর্যন্ত তারা এই সফলতা ধরে রাখতে চান।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক জিয়াউল হক যুগান্তরকে বলেন, প্রথম দিনটি সুষ্ঠুভাবে কাটানোর কৃতিত্ব আমাদের একার নয়। মন্ত্রণালয়ের দক্ষ নেতৃত্বে আমরা শিক্ষা বিভাগ কাজ করেছি। গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা, গণমাধ্যম, শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এটা সম্ভব হয়েছে। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রশ্নফাঁস ঠেকানোর পেছনে এবারের তিনটি নতুন পদক্ষেপ এবং কঠোর মনিটরিং প্রধান ভূমিকা রেখেছে। এবার প্রথমবার দুই প্যাকেটে প্রশ্ন পাঠানো হয়। একটিতে ছিল বিশেষ সিকিউরিটি টেপ লাগানো। এর ভেতরে অপর প্যাকেটে আগের মতো সিলগালা করা প্রশ্ন ছিল। ফলে ট্রেজারি থেকে কেন্দ্রে প্রশ্ন নেয়ার পথে প্যাকেট খোলা সম্ভব হয়নি।
এবার ছাপানো দুই সেট প্রশ্নই কেন্দ্রে পাঠানো হয়। এর মধ্যে কোন সেটে পরীক্ষা হবে, তা (পরীক্ষার) ২৫ মিনিট আগে কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে জানানো হয় বোর্ড থেকে। আগে প্যাকেটের ভেতরেই সেটা উল্লেখ থাকত। ফলে দুষ্টু শিক্ষকরা প্রশ্নফাঁস করার সহজ রাস্তা পেতেন।
তৃতীয় নতুন পদক্ষেপ ছিল মোবাইল ব্যাংকিং নজরদারি। এই সেবায় নিয়োজিত সারা দেশের সাড়ে ৭ লাখ এজেন্টের প্রতি নির্দেশনা ছিল যে, সন্দেহজনক লেনদেন নিকটস্থ থানাকে অবহিত করতে হবে। এ ধরনের লেনদেনকারীদের সরকার পরীক্ষা দিতে দেবে না। পরীক্ষার পর ধরা পড়লে রেজাল্ট প্রকাশ করা হবে না মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
ফাঁস ঠেকাতে আরও কয়েকটি পদক্ষেপ ভূমিকা রেখেছে। ওইগুলোর মধ্যে আছে- পরীক্ষার নির্ধারিত সময়ের ৩০ মিনিট আগে নিজ নিজ আসনে পরীক্ষার্থীদের বসা। পরীক্ষা চলাকালে কেন্দ্রের ২০০ মিটারের মধ্যে মোবাইল ফোনসহ ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা। মোবাইল ফোন বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসে কথিত কোনো প্রশ্ন পেলেই গ্রেফতার। তবে কেন্দ্র সচিব শুধু একটি সাধারণ ফোন ব্যবহার করবেন। ট্যাগ অফিসার (কেন্দ্রে নিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তা) বা ম্যাজিস্ট্রেট, স্থানীয় পুলিশপ্রধান ও কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা তার প্রতিনিধির সহায়তায় ট্রেজারি থেকে প্রশ্নপত্র কেন্দ্রে নিয়ে যাবেন। ট্যাগ অফিসার, কেন্দ্র সচিব বা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তার উপস্থিতিতে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খোলা এবং প্যাকেট অক্ষত ছিল মর্মে সত্যয়ন রাখা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবেন না। ২৯ মার্চ থেকে কোচিং সেন্টার বন্ধ। শিক্ষা বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, নতুনগুলো বাদে বাকি নির্দেশনাগুলো আগেও ছিল। কিন্তু ওইগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হতো না। বাস্তবায়নে মনিটরিং ছিল না। বরং মন্ত্রণালয়ের শীর্ষব্যক্তি ও কর্মকর্তারা বাগাড়ম্বর করেই পার করতেন। গত এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস মহামারী রূপ ধারণ করায় এবার এ ব্যাপারে জোর দেয়া হয়েছে। সে হিসেবে বাস্তবায়ন ও মনিটরিংই প্রশ্নফাঁসমুক্ত পরীক্ষার নেপথ্য কারণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। মনিটরিং ব্যবস্থা এবার এমনই ছিল যে, খোদ শিক্ষামন্ত্রী রাজধানীর একটি কেন্দ্রে গিয়ে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট নিরীক্ষা করেন। তিনি দুই প্যাকেটের মধ্যে একটি খুলে সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন। এভাবে সারা দেশেই ট্যাগ অফিসাররা এবং মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের টিমগুলো প্যাকেট যাচাই করেছে।
তবে এরপরও এবার প্রশ্নফাঁসের গুজবে ফেসবুক সয়লাব হওয়ায় পরীক্ষার্থী-অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ। তারা বলছেন, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) কার্যকর পদক্ষেপ নিলে গুজবও ছড়ানো সম্ভব হতো না।
সোমবার কেন্দ্র পরিদর্শনকালে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে সাংবাদিকদের এ ব্যাপারে প্রশ্ন ছিল। জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বিটিআরসিকে সঙ্গে সঙ্গে তথ্যগুলো জানিয়ে দিই। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিশেষভাবে কাজ করছে এগুলা নিয়ে। আমরাও সব জানি না, জানার দরকারও নেই। এ ধরনের প্রশ্নফাঁসের কাজে যারা নিয়োজিত আছে, তাদের ধরার জন্য সবার সম্পৃক্ততা ও সহযোগিতা দরকার।’
এত কড়াকড়ির পরও যদি প্রশ্নফাঁস হয়, তাহলে দায় কে নেবে- এমন প্রশ্নে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আশা করছি প্রশ্নফাঁস হবে না। যদি হয়, যিনি করবে তাকেই দোষী করব।’
প্রশ্নফাঁসের তথ্য পাওয়া গেলে সরকার এবার কতটা কঠোর হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উঠতেই পারে। যে কেউ চাইলেই অভিযোগ করতে পারেন। আমাদের কাজ অভিযোগের সত্যাসত্য দেখা। পাশাপাশি আইনানুসারে শাস্তির ব্যবস্থা করা, যা আমরা করব।’
ভুয়া প্রশ্নসহ ১১ জন আটক : তিন দিনে ১১ জনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর মধ্যে ঢাকা ও আশপাশ থেকে র্যাব তিন দিনে সাতজনকে আটক করে। সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি জানান, প্রশ্ন বিক্রির আশ্বাস দিয়ে অর্থ আদায়ের দায়ে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে আবদুল্লা আল জামান, আল আমিন ও আরিফ হোসেনকে আটক করা হয়। বগুড়া ব্যুরো জানায়, একই অপরাধে র্যাব-১২ সামিউল ইসলাম নামে এক কিশোরকে গ্রেফতার করেছে।
এমসিকিউ কঠিন হয়েছে : সোমবার প্রথমদিন এইচএসসিতে বাংলা প্রথমপত্র, মাদ্রাসায় আলিমে কোরআন মাজিদ এবং কারিগরিতে বাংলা-২ বিষয়ের পরীক্ষা নেয়া হয়। পরীক্ষা শুরু হয় সকাল ১০টায়। পরীক্ষার পর শিক্ষার্থীদের অনেককেই কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়। রাজধানীর নাজিমউদ্দিন রোডে শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজে পরীক্ষা দিয়েছে বদরুননেসা সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রীরা। আলাপকালে জান্নাতুল ফেরদৌস সুখি বলে, সৃজনশীল অংশের প্রশ্ন ভালো হয়েছে। কিন্তু এমসিকিউ একটু বেশিই কঠিন হয়েছে। সে বলে, এমসিকিউ প্রশ্নও সৃজনশীল অংশের মতো বাইরের উদ্দীপক সেট করে প্রশ্ন করা হয়েছে, সেটা করার কথা নয়।
বহিষ্কার অনুপস্থিতি বেড়েছে : আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি জানিয়েছে, প্রথমদিন সারা দেশে ৮৯ জন শিক্ষার্থী ও ৭ জন শিক্ষকসহ ৯৬ জন বহিষ্কার হয়েছে। গত বছরের প্রথমদিনের পরীক্ষায় এক শিক্ষকসহ ৬৭ জন বহিষ্কার হয়। সে হিসাবে এবার বহিষ্কারের সংখ্যা বেশি। কঠোরভাবে পরীক্ষা নেয়ার কারণেই এমনটি হয়েছে বলে মনে করেন শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজের অধ্যক্ষ মো. আবদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘পরীক্ষায় শৃঙ্খলার ব্যাপারে আমরা খুবই কঠোরতা অবলম্বন করেছি। তবে পরীক্ষার হলের ভেতরে ছাত্রীদের সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও মনোরম পরিবেশ নিশ্চিত করেছি, যাতে ইতিবাচক পরিবেশে নিরুদ্বেগে পরীক্ষা দিতে পারে।’ এদিন মোট ১০ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭ জনের অংশ নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরীক্ষা দেয় ১০ লাখ ৭৯ হাজার ৩৫৯ জন। ১৩ হাজার ৭১৮ জন অনুপস্থিত ছিল। গত বছর প্রথম দিন ১৩ হাজার ৬৯ জন অনুপস্থিত ছিল। সূত্র : যুগান্তর