এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : নগদ টাকার সংকটে পড়েছে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। গত মৌসুমে কাঙ্ক্ষিত আয় না হওয়ায় আর্থিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। টাকার অভাবে সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ মুহূর্তে ১০০ কোটি টাকার সংস্থান না হলে অন্তত ৬টি উড়োজাহাজের ফ্লাইট বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা আছে। আগামী হজ মৌসুমে বিমানের ফ্লাইটে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
টাকার সংস্থানে রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইন্সটির কর্মকর্তারা দৌড়ঝাঁপ করছেন। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি কোনো ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে না। দুটি ব্যাংক অল্পকিছু টাকা দিতে রাজি হলেও যে শর্ত দিয়েছে তা মেনে নিয়ে বিমানের পক্ষে ঋণ নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ তাদের দুই শাখার দুটি এফডিআর (ফিক্সড ডিপোজিট রিসিভড) ভাঙানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর আপত্তির মুখে সে সিদ্ধান্তও ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসাদ্দিক আহম্মেদের পক্ষে বিমানের মুখপাত্র জেনারেল ম্যানেজার শাকিল মেরাজ বলেন, এ সংকট সাময়িক। বিশ্বজুড়ে এ সময়টা এয়ারলাইন্স ব্যবসায় আয় কম হয়। বিমানেরও আগামী জুন পর্যন্ত আয় কম হবে। কিন্তু এ সময়ে ব্যয় বেড়ে যায়। তাছাড়া হজ ফ্লাইট পরিচালনার জন্য এখনই বিমানের সব এয়ারক্রাফট মেরামত করে প্রস্তুত রাখতে হবে। যাতে হজের সময় কোনো ধরনের টেকনিক্যাল সংকট তৈরি না হয়। মূলত এ কারণে এফডিআর ভাঙাতে হচ্ছে। তার মতে, হজ শুরু হলে এ সংকট আর থাকবে না। তিনি বলেন, প্রতিবছর হজের তিন মাসে বিমানের বড় অঙ্কের অর্থ লাভ হয়। এ বছর লাভের অঙ্ক আরও বাড়তে পারে। ফলে এফডিআরগুলো ভাঙালেও হজের পরে আবারও ওই টাকা দুটি বিভাগকে ফেরত দেয়া যাবে। তার মতে, বিমানের বিএফসিসি ও পোলট্রি বিভাগ দুটির আয় বিমানের মূল অ্যাকাউন্টে যোগ করা হয় না। ওই টাকা বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর করে রাখা হয় যাতে বিমানের জরুরি মুহূর্তে ওই টাকা ব্যবহার করা যায়।
বিমানের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, প্রতিবছর জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিমানের আয় হয় কমপক্ষে ৪৫০ কোটি থেকে ৫০০ কোটি টাকা। বাকি ৬ মাস বিমানের অফপিক মৌসুম। এ সময় বিমানের আয় খুবই কম হয়ে থাকে। ৬ মাসের লাভ দিয়ে অফপিক মৌসুম কাভার দিতে হয়। কিন্তু গত বছর বিমানের জুন-ডিসেম্বর সেশনে আয় হয়েছে মাত্র ১৮০ কোটি টাকার মতো। ফলে এখন বিমানের ফান্ড শূন্য হয়ে পড়েছে। টাকার অভাবে মেরামতের জন্য একাধিক উড়োজাহাজের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ ফেরত আনা যাচ্ছে না।
জানা গেছে, ৭৭৭-৩০০ইআর সিরিজের বিমানের চারটি নিজস্ব বোয়িং ৭৩৭-৮০০ সিরিজের দুই বোয়িংয়ের ইঞ্জিন, ল্যান্ডিং গিয়ারসহ গুরুত্বপূর্ণ পার্টস বিশ্বের বিভিন্ন ওয়ার্কশপে (কারখানা) মেরামতের জন্য পাঠানো হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশগুলো কারখানা থেকে আনতে কমপক্ষে একশ কোটি টাকা প্রয়োজন। বিমান কর্তৃপক্ষ এ টাকাই সংগ্রহ করতে পারছে না। টাকা না থাকায় গুরুত্বপূর্ণ এসব ইকুইপমেন্ট আনা যাচ্ছে না। বিমানের ইঞ্জিনিয়ারিং শাখা সূত্রে জানা গেছে, ইকুইপমেন্টগুলো আনা সম্ভব না হলে আগামী হজ মৌসুমে উড়োজাহাজগুলো চালানো সম্ভব হবে না। এতে হজযাত্রী পরিবহনেও বড় ধরনের সংকট তৈরির আশঙ্কা আছে।
টাকার সংস্থানে ইতিমধ্যে দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের কাছে লোনের আবেদন জানিয়েছে বিমান। কিন্তু সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী কোনো ব্যাংকই বিমানকে লোন দিতে রাজি হয়নি। দুটি ব্যাংক অল্পকিছু টাকা দিতে রাজি হলেও যে শর্ত দিয়েছে তাতে বিমানের পক্ষে এ লোন নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে বিমানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সংস্থার দুটি শাখার গচ্ছিত দুটি এফডিআর ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সূত্র জানায়, বিমানের বিএফসিসি (বিমান ফ্লাইট ক্যাটারিং সেন্টার) ও পোলট্রি বিভাগের মোট একশ’ কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর করা আছে। এর মধ্যে বিএফসিসির ৬০ কোটি ও পোলট্রি বিভাগের ৪০ কোটি টাকা। চলতি মাসের মধ্যে বিমানের কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকার ফান্ড দরকার। এ চাহিদা পূরণে এফডিআর দুটি এখন ভাঙালে তাদের বড় অঙ্কের অর্থ লোকসান হবে। কারণ এখনও ফান্ড দুটির মেয়াদ পূর্ণ হয়নি। এ পরিস্থিতিতে এফডিআর না ভেঙে এর বিপরীতে তাদের ঋণ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বিমান ম্যানেজমেন্ট জানিয়েছে, এফডিআরের বিপরীতে যে টাকা লোন পাওয়া যাবে তা দিয়ে তাদের ক্রাইসিস পিরিয়ড মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। কাজেই পুরো এফডিআর ভাঙানো ছাড়া বিমানের সামনে বিকল্প নেই।
বিমানের পরিকল্পনা শাখা সূত্রে জানা গেছে, দুটি বেসরকারি ব্যাংক বিমানকে শর্তসাপেক্ষে ঋণ দিতে রাজি হয়েছিল। একটি ব্যাংক জানিয়েছে, তারা এ মুহূর্তে সর্বোচ্চ ৩৫ কোটি টাকা ঋণ দিতে পারবে। সুদ দিতে হবে ১২ শতাংশ হারে। বাকি টাকা দিতে হবে বোর্ডের অনুমোদন সাপেক্ষে। কিন্তু বিমানের হাতে বোর্ডের অনুমোদন পাওয়ার মতো পর্যাপ্ত সময় নেই। সে কারণে এ প্রস্তাব রাজি হয়নি বিমান। অপর ব্যাংকটি বলছে, তারা সমপরিমাণ সম্পদ বন্ধক রেখে বিমানকে টাকা দিতে পারবে। একই সঙ্গে বিমানের মাসিক বিক্রি (বিএসপি) তাদের ব্যাংকে জমা রাখতে হবে। কিন্তু বিমানের পক্ষে এ প্রস্তাব মানাও অসম্ভব। কারণ বর্তমানে বিমানের বিএসপি সেল যে ব্যাংকে যাচ্ছে তাদের কাছেও বিমানের ঋণ আছে প্রায় ৬৩৫ কোটি টাকা। এ অবস্থায় ওই ব্যাংকের কাছ থেকেও লোন পাচ্ছে না বিমান।
বর্তমানে বিমানবহরে ১২টি উড়োজাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে ৪টি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজ, দুটি ৭৩৭-৮০০, লিজে আনা দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০, লিজে আনা ২টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনার জন্য আছে দুটি ড্যাস-৮ কিউ৪০০ এয়ারক্রাফট। এর মধ্যে লিজে আনা দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ এয়ারক্রাফটের মধ্যে একটি ফেরত দেয়ার লক্ষ্যে ভিয়েতনামের মেরামত কারখানায় পাঠানো হয়েছে আগের অবস্থায় তৈরি করে দেয়ার জন্য। আগামী মাসে জাহাজটি ইজিপ্ট এয়ারলাইন্সের কাছে ফেরত পাঠানো হতে পারে। ওই জাহাজটি ফেরত পাঠানোর পর দ্বিতীয় বোয়িং ৭০০০-২০০কেও ভিয়েতনামের কারখানায় পাঠানো হবে আগের অবস্থায় নেয়ার জন্য। মেরামত ও আগের অবস্থায় এনে কয়েক মাসের মধ্যে ওই জাহাজটিও ইজিপ্ট এয়ারলাইন্সের কাছে ফেরত পাঠানো হবে। এ অবস্থায় বিমানের বহরে উড়োজাহাজ থাকবে ১০টি।