এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের সঙ্গে ঋণ চুক্তি নিয়ে দীর্ঘ টানাপোড়েনের অবসান হচ্ছে। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহেই এ বিষয়ে সই হতে পারে চুক্তি। তবে এজন্য ৬ শর্ত পরিপালনে রাজি হতে হয়েছে বাংলাদেশকে। সরকারকে এ ঋণ নিতে হবে প্রিফারেনশিয়াল বায়ার্স ক্রেডিটে (অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে)। সুদ ২ শতাংশ। তবে এর সঙ্গে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ হারে দিতে হবে প্রতিশ্র“তি ও ব্যবস্থাপনা ফি (দুটি মিলে ০.৫ শতাংশ)। এর মধ্যে ব্যবস্থাপনা ফি (৬৬ লাখ ৬৯ হাজার ৮৪৩ ডলার) পরিশোধ করতে হবে চুক্তি হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে। ঋণ পরিশোধ করতে হবে ২০ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে রেয়াতকাল ৬ বছর। পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয় ২০১৬ সালে। কিন্তু এরপরই বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়। চিঠি চালাচালিতে কেটে যায় দেড় বছরেরও বেশি সময়। ফলে একই দিনে পদ্মা সেতুতে বাসের সঙ্গে ট্রেন চলাচলের স্বপ্ন একরকম মিলিয়েই গেছে।
তবে রেলপথমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক মঙ্গলবার বলেন, আগামী সপ্তাহেই চীনের সঙ্গে চুক্তি হবে। পদ্মা সেতুর অন্যান্য কাজের সঙ্গে রেল সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু না হলেও বাকি সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ হবে। সরকারের প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী একই দিন পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেন ও সড়কযান চলাচল করবে।
অবশ্য রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ‘প্রকল্প যাচাই কমিটি’র ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত সভার কার্যবিবরণী বলছে ভিন্ন কথা। এতে উঠে আসে- রেলপথ মন্ত্রণালয় ‘পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প’ সংশোধন করতে চায়। এতে (পুনর্গঠিত ১ম সংশোধিত প্রকল্পপ্রস্তাব) সম্ভাব্য প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ২৫৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা। যার মধ্যে ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা মিলবে চীনের কাছ থেকে। বাকিটা (১৮ হাজার ২২১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা) বাংলাদেশকে দিতে হবে। আর প্রকল্প সমাপ্তির সময় ধরা হয়েছে ৩০ জুন ২০২৪। বিপরীতে বর্তমান সরকার ২০১৯ সালের মধ্যেই পদ্মা সেতু উদ্বোধন করতে চাইছে। সংশোধিত প্রকল্পে বাড়ছে ব্যয়ও। আগের প্রকল্পপ্রস্তাব অনুযায়ী এতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, যার মধ্যে চীনের ঋণ ২৪ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা। ১০ হাজার ২৩৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা সরকারের তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে। প্রকল্প শেষের সময় নির্ধারিত ছিল ২০২২। সূত্র বলছে, এ (মূল) প্রকল্পপ্রস্তাব অনুযায়ীই চীনের সঙ্গে চুক্তিও হওয়ার কথা চলছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের প্রথম ‘ধাক্কা’ বাংলাদেশ পাচ্ছে এ খাতেই। গভর্নমেন্ট কনসেশনাল লোনের পরিবর্তে ঋণ নিতে হচ্ছে প্রিফারেনশিয়াল বায়ার্স ক্রেডিটে। ইআরডির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গভর্নমেন্ট কনসেশনাল লোন চীন সরকারের নিজস্ব অর্থ থেকে দেয়া হয়। তা দেয়া হয় চীনা মুদ্রায় অর্থাৎ আরএবি ইয়ানে। এ ঋণ চীন ইচ্ছে করলে মওকুফও করে দিতে পারে। যেমন ঢাকায় চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র (বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র) নির্মাণে এমন ঋণ ছিল। পরে চীন সরকার তা মওকুফ করে দিয়েছে। বিপরীতে প্রিফারেনশিয়াল বায়ার্স ক্রেডিটের ক্ষেত্রে চীন সরকারের অর্থ হলেও সেটি দেয়া হয় চায়না এক্সিম ব্যাংকের মাধ্যমে মার্কিন ডলারে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের চার্জ বাড়তি গুনতে হয়। এ ঋণ মওকুফের কোনো সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া বায়ার্স ক্রেডিটে ৮৫ শতাংশ অর্থ চীন দেবে, বাকিটা সরকার বা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে দিতে হবে। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, আগে শাহজালাল ফার্টিলাইজার প্রকল্পসহ কয়েকটি প্রকল্পে বায়ার্স ক্রেডিট এবং কনসেশনাল ঋণ মিলিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি তৈরি করা চীনের নতুন ঋণ পদ্ধতিও প্রিফারেনশিয়াল বায়ার্স ঋণ নিতে বাংলাদেশকে বাধ্য করেছে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী ৩০ কোটি মার্কিন ডলারের ছোট ঋণ হলে কনসেশনালে, এর ওপরে হলে বায়ার্স ক্রেডিটে নিতে হবে। এতে সুদহার যেমন বেশি, রয়েছে বিভিন্ন ফিও।
ইআরডির অতিরিক্ত সচিব মো. জাহিদুল হক মঙ্গলবার বলেন, পদ্মা সেতুতে ঋণ চুক্তির ক্ষেত্রে এখন আর কোনো বাধা নেই। আইন মন্ত্রণালয় থেকে ভেটিং সম্পন্ন হয়েছে, অন্যান্য প্রক্রিয়াও শেষ। ২/১ দিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য সারসংক্ষেপ পাঠানো হচ্ছে। অনুমোদন হয়ে আসলে আমরা চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত হব। চীনের প্রস্তাব রয়েছে তাদের দেশে গিয়ে যেন চুক্তিটি স্বাক্ষর করা হয়। আশা করছি, শিগগিরই ঋণ চুক্তি হবে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য তৈরি সারসংক্ষেপে ঋণের শর্তগুলো জানিয়ে বলা হয়েছে, চীনের অর্থায়নে বাস্তবায়িতব্য একটি অগ্রাধিকার প্রকল্প তালিকা গত বছরের ৩০ মার্চ ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসে পাঠানো হয়েছে। ওই তালিকার এক নম্বর ক্রমিকে রয়েছে পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্প। এটি চীন সরকারের অর্থায়নে জি টু জি পদ্ধতিতে বাস্তবায়িত হবে। প্রকল্পের নির্মাণকাজের জন্য চীন সরকারের মনোনীত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এম/এস চায়না রেলওয়ে গ্র“প লিমিটেডের সঙ্গে ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট বাণিজ্যিক চুক্তি হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় রয়েছে- ভূমি অধিগ্রহণ, ১৬৯ কিলোমিটার মেইন লাইন নির্মাণ, ৪৩ দশমিক ২২ কিলোমিটার লুপ ও সাইডিং ও ৩ কিলোমিটার ডবলসহ ২১৫ দশমিক ২২ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেল ট্র্যাক নির্মাণ, ২৩ দশমিক ৩৭ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট, এক দশমিক ৯৮ কিলোমিটার র্যাম্প, ৬৬টি ব্রিজ, ২৪৪ কালভার্ট, একটি হাইওয়ে ওভারপাস, ২৯টি লেভেল ক্রসিং, ৪০ আন্ডারপাস, ১৪টি নতুন স্টেশন বিল্ডিং নির্মাণ, বিদ্যমান ছয়টি স্টেশনের উন্নয়ন, ২০ স্টেশনে টেলিযোগাযোগসহ কম্পিউটারভিত্তিক রেলওয়ে ইন্টারলক সিস্টেম সিগন্যালিং ব্যবস্থা এবং ১০০টি ব্রডগেজ যাত্রীবাহী গাড়ি সংগ্রহ।
সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের সময়ই পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পে অর্থায়নে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। কিন্তু নানা কারণে অর্থায়ন নিয়ে দেখা দেয় জটিলতা। এজন্য চুক্তি স্বাক্ষরে দেরি হতে থাকে। অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদের হস্তক্ষেপে সুদ ও শর্ত সংক্রান্ত জটিলতা কেটে যায়। এ ঋণ বিষয়ে ফেব্র“য়ারিতে চীনের স্টেট কাউন্সিল ও প্রেসিডেন্টের অনুমোদন মিলেছে।
প্রকল্প পরিচালক গোলাম ফখরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী মঙ্গলবার জানান, সব জটিলতা কেটে গেছে। প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী একই দিন পদ্মা সেতু দিয়ে সড়কযানের সঙ্গে ট্রেনও চালানো হবে। জায়গা অধিগ্রহণসহ প্রকল্পের কাজ চলছে। ঋণচুক্তির পর সেই কাজ পুরোদমে চলবে।
রেলওয়ে মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন মঙ্গলবার জানান, ১৪ থেকে ১৬ এপ্রিলের মধ্যে চীনের সঙ্গে ঋণচুক্তি হচ্ছে। এর পরপর পুরো প্রকল্পে পুরোদমে কাজ শুরু হবে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পুরোদমে কাজ শুরু করতে প্রস্তুত রয়েছে। রেলপথমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক যুগান্তরকে জানান, রেলওয়ের ইতিহাসে এটিই সবেচেয়ে বড় প্রকল্প। এ প্রকল্প সমাপ্ত হলে ২৩ জেলা নতুন করে রেলওয়ের আওতায় আসবে। সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশনের সদস্য দেশগুলোয় আন্তঃদেশীয় যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের লক্ষ্যে সুষ্ঠু রেলওয়ের কানেকটিভিটি স্থাপন হবে। সূত্র : যুগান্তর