এশিয়ান বাংলা ঢাকা: যুক্তরাষ্ট্র-চীন পাল্টাপাল্টি শুল্কারোপ নিয়ে বিশ্বব্যাপীই হইচই চলছে। যদিও পিউ রিসার্চ সেন্টারের পর্যবেক্ষণ বলছে, মার্কিন প্রশাসনের কর-খড়গের জের টানতে হচ্ছে মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে। বহু বছর ধরেই এসব দেশ থেকে পণ্য আমদানিতে উচ্চশুল্ক আরোপ করে রেখেছে দেশটি। এর মধ্যে সর্বোচ্চ শুল্ক আবার বাংলাদেশী পণ্যের ওপর।
ইউএস ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড কমিশনের (আইটিসি) তথ্য বিশ্লেষণ করে পিউ রিসার্চ সেন্টার বলছে, বিশ্বের ২৩২টি দেশ ও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল থেকে পণ্য আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্র। এসব দেশ থেকে পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্র ধার্যকৃত গড় শুল্ক মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ। যদিও বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশটি শুল্ক আরোপ করে রেখেছে ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। গত বছর বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা ৫৭০ কোটি ডলারের পণ্যে আমদানিকারকদের কাছ থেকে এ হারে শুল্ক আদায় করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
অর্থনৈতিক কূটনীতি ছাড়া এ শুল্কহার কমানো সম্ভব নয় বলে মনে করেন আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি আফতাব-উল ইসলাম। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্ক সুবিধা আদায়ে বহুদিন ধরেই চেষ্টা চলছে। এখন রাজনৈতিক কূটনীতি দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যাবে বলে মনে হয় না। এজন্য প্রয়োজন হবে অর্থনৈতিক কূটনীতি। আমি জানি না, বাংলাদেশ দূতাবাসের ওয়াশিংটন কার্যালয় কী করছে। এখনো শক্তিশালী দরকষাকষির মতো সক্ষমতা আমাদের হয়েছে বলে আমি মনে করি না। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কও বেশ ভালো; তার পরও শুল্ক সুবিধা তাদের কাছ থেকে আদায় করা যায়নি। মুখে অনেক কিছু বললেও দেশটি থেকে সুবিধা আদায়ে প্রকৃত চেষ্টা বাংলাদেশ কখনই করতে পারেনি।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার বলছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি করা পণ্যের ৯৫ শতাংশই পোশাক, জুতা, ক্যাপ ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী। বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা এসব পণ্যে চড়া শুল্ক মার্কিন ভোক্তাদের পকেটেও সবচেয়ে বেশি চাপ ফেলে। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক, জুতা ও অন্যান্য পণ্যের মূল্যের ৮ দশমিক ৬ থেকে ১৬ দশমিক ১ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক পরিশোধ করেন মার্কিন আমদানিকারকরা। শার্ট-প্যান্ট, টি-শার্ট, স্যুট, ট্রাউজার, জুতা-কেডসের মতো পরিধেয় সামগ্রীতে এ হারে শুল্ক পণ্যগুলোর দামে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ উল্লম্ফনের কারণ হয়; যার ভার বইতে হয় সিংহভাগ মার্কিন ক্রেতাকে।
বাংলাদেশের সমপর্যায়ের দেশগুলো থেকে পণ্য আমদানিতেও উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে দুই অংকের ঘরে শুল্ক আরোপ আছে কম্বোডিয়া ও শ্রীলংকা থেকে পণ্য আমদানিতে। কম্বোডিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি শুল্কের হার ১৪ দশমিক ১ ও শ্রীলংকার ক্ষেত্রে ১১ দশমিক ৯ শতাংশ। এছাড়া পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের নির্ধারিত শুল্ক ৮ দশমিক ৯, ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে ৭ দশমিক ২ ও মিয়ানমারের ক্ষেত্রে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। যদিও যে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে এ মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী আলোচনা হচ্ছে, সেই চীন থেকে পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক মাত্র ২ দশমিক ৭ শতাংশ।
তবে বৃহৎ এ দুই অর্থনীতির বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার যথেষ্ট কারণ দেখতে পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বিশ্ব অর্থনীতির দুই পরাশক্তির বিরোধের পরোক্ষ প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশী পণ্যের ওপরও।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির এ প্রসঙ্গে বলেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধ প্রসঙ্গে দুটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ ৩০-৪০ বছর ধরে যতটুকু অর্জন করেছে, তার একটা প্রধান নিয়ামক ছিল উন্মুক্ত বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থা। ওই ব্যবস্থার বড় সুবিধাভোগীর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ যদি তীব্র হয়, তাহলে যে সুযোগ আমরা এতদিন পেতাম, সে বিষয়ে আশঙ্কা তৈরি হবে। চীনের ওপর এখন শুল্কহার বাড়ালে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের উপরেও তা বাড়তে পারে। এতে আমাদের বাণিজ্য সুযোগ কমবে। এ ধারাবাহিকতায় ইউরোপীয় ইউনিয়নও আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দেবে। এতে উন্মুক্ত বিশ্ববাণিজ্যের যে পরিবেশ বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো পেত, তা ঝুঁকির মুখে পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ স্থায়ী রূপ নিলে তার পরোক্ষ প্রভাব বাংলাদেশের ওপরও পড়বে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ইন্টারন্যাশনাল বিজনেসের চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ রাকিব উদ্দিন ভুইয়া। তিনি বলেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার এ সমস্যার সুযোগ নিতে চাইবে ভারত, ব্রাজিল, রাশিয়াসহ অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতি। যুক্তরাষ্ট্রও চাইবে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় আসতে। সমঝোতায় এলে সে দেশগুলোর মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হতে পারে। এখন ভারতের সঙ্গে যদি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হয়, তাহলে তারা পোশাকপণ্যে শুল্ক সুবিধা পাবে। তাহলে বাংলাদেশের পোশাকপণ্যকে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হতে হবে। এ মুহূর্তে ভারত প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিয়েছে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ পরিস্থিতির সুবিধা কীভাবে তারা নিতে পারে। এ প্রস্তুতির মাধ্যমে তারা সর্বোচ্চ সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করবে। কিন্তু বাংলাদেশের এ ধরনের কোনো প্রস্তুতি নেই। আসলে পরোক্ষ প্রভাবগুলো অনেক ধরনের হতে পারে। সুনির্দিষ্ট করে এখনই সে বিষয়ে ধারণা করা যাচ্ছে না। সূত্র : বণিক বার্তা