এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : ঋণখেলাপিদের তালিকা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ওয়েবসাইট, নোটিশ বোর্ড বা অন্যরূপে দৃশ্যমান স্থান টানানোসহ ২৭ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি)। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত সব ব্যাংককে চিঠি পাঠিয়ে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে একশ’ কোটি টাকা বা এর বেশি খেলাপি ঋণ তদারকির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকসহ প্রতিটি ব্যাংকে পৃথক মনিটরিং সেল গঠনের কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি ঋণ অনুমোদনে বিদ্যমান নীতিমালা সংশোধন ও জামানত হিসেবে সম্পত্তি গ্রহণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। চিঠি পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
নির্দেশনায় ব্যাংকের এমডি ও সিইওদের বেঁধে দেয়া লক্ষ্য অর্জনের মূল্যায়ন ও পরিচালকদের কাজ মনিটরিংয়ের কথা বলা হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংককে বিশেষভাবে ব্যাংক একীভূতকরণে যুগোপযোগী গাইডলাইন প্রণয়ন এবং অনলাইন ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
এফআইডির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য শুধু সরকারি ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠির মাধ্যমে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে কর্মশালা ও বৈঠকের মাধ্যমে এসব সুপারিশ তৈরি করে। দীর্ঘ পর্যালোচনার পর সুপারিশগুলো চূড়ান্ত করা হয়।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ঋণখেলাপিদের তালিকা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোতে টানানোর নির্দেশনাটি ভালো। ব্যাংকের দৃশ্যমান একাধিক স্থানে প্রদর্শন করা হলে সেটি আরও ভালো হবে। ঋণখেলাপিদের তালিকা অন্যভাবে প্রচার করতে পারলেও ভালো হবে।’
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্র জানায়, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঋণখেলাপিরা প্রভাবশালী। নাম-ঠিকানা জনসমক্ষে প্রকাশ পাওয়ার ভয়ে তারা পরিশোধে এগিয়ে আসবে। বড় খেলাপিদের তালিকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রকাশ ও নিয়মিত হালনাগাদ করার ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। এরই অংশ হিসেবে হালনাগাদ তালিকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যাংকের ওয়েবসাইট, নোটিশ বোর্ড বা অনুরূপ দৃশ্যমান স্থানে প্রকাশ করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।’
জানা গেছে, ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য স্বল্প (সর্বোচ্চ এক বছর), মধ্যম (১ থেকে ২ বছর) ও দীর্ঘ (২ বছরের ঊর্ধ্বে) মেয়াদ নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর মধ্যে স্বল্প মেয়াদে ১৩টি, মধ্যম মেয়াদে ১২টি এবং দীর্ঘমেয়াদে ২টি সুপারিশ রয়েছে। এসব সুপারিশ চূড়ান্ত করার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের একাধিক বৈঠক হয়। চূড়ান্ত সুপারিশে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অনুমোদন দিলে পরে তা ব্যাংকগুলোতে পাঠানো হয়।
সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- নতুন শাখা খোলার বিপরীতে বিকল্প হিসেবে ‘এজেন্ট’ ও ‘মোবাইল’ ব্যাংকিং সম্প্রসারণ, পরিচালক নিয়োগে প্রার্থীর ‘ফিট অ্যান্ড প্রপার টেস্ট’ করতে পৃথক গাইডলাইন প্রণয়ন, জামানত হিসেবে জমি ও সম্পত্তি গ্রহণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার গঠন।
এছাড়া উচ্চ আদালতে ব্যাংকের ঋণ সংশ্লিষ্ট রিট মামলা নিষ্পত্তির জন্য পৃথক বেঞ্চ গঠন, খেলাপি আদায়ে সফলতা ও ব্যর্থতার জন্য কর্মকর্তাদের প্রণোদনা এবং শাস্তির ব্যবস্থা নীতিমালা প্রণয়ন, তিন মাস অন্তর শাখা অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বেঁধে দেয়া লক্ষ্যমাত্রা (বিভিন্ন সূচকের) অর্জনের মূল্যায়ন, গ্রহককে নন-ফান্ডেড ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা ও এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি গাইডলাইন জারি করতে বলা হয়েছে।
চিঠিতে আগামী এক থেকে দু’বছরের মধ্যে (মধ্য মেয়াদে) ১২টি সুপারিশ বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- ঋণ প্রস্তাব মূল্যায়নে চলতি মূলধন বিষয়টি নিশ্চিত করা, এ সংক্রান্ত বর্তমান নীতিমালা প্রয়োজনে সংশোধন, জামানত হিসেবে জমির মূল্যায়নে সার্ভেয়ার কোম্পানির যোগ্যতা নির্ধারণে গাইডলাইন তৈরি, গ্রাহকদের তথ্য সংরক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্ত্বাবধায়নে সেন্ট্রাল কেওয়াইসি বাস্তবায়ন, ঋণ প্রস্তাব মূল্যায়নে প্রকল্পের নগদ অর্থের প্রবাহ বিশ্লেষণ ও ডিজিটাল প্লাটফর্মে সিস্টেম অডিট পরিচালনার ব্যবস্থা।
এছাড়া ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণে বেসরকারি খাতে শেয়ার ছেড়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করতে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব তৈরি ও ঢাকার বাইরে (একই সিসমিক জোনের বাইরে) ডাটা ডিজাস্টার রিকভারি সাইট স্থাপনের কথা বলা হয়েছে।
সুপারিশমালায় ব্যাংকের চাকরিজীবীদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে আজীবন প্রধান কার্যালয়ে থাকলে নম্বর কর্তন এবং হাওর, বাঁওড় ও পার্বত্য অঞ্চলে কাজের জন্য পৃথক মূল্যায়নের বিদ্যমান প্রবিধানমালা সংশোধন, বৈদেশিক প্রশিক্ষণের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার এবং সামাজিক কর্মসূচি কার্যক্রমে সেবাদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে সার্ভিস চার্জ প্রদানের কথা বলা হয়েছে।
জানা গেছে, বর্তমান ব্যাংকিং খাতে নাজুক অবস্থা চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। এই খেলাপি ঋণের সিংহভাগই রয়েছে ২০ বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির হাতে। বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলো এখন চরম মূলধন সংকটে ভুগছে। এ সংকট কাটাতে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ২ হাজার কোটি টাকা মূলধন দেয়া হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। এর আগে গত চার অর্থবছরে সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি মেটানোর জন্য অর্থ দেয়া হয়েছে ১০ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা।
এছাড়া সোনালী ব্যাংক ‘হলমার্ক’ কেলেঙ্কারির কারণে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বেসিক ব্যাংক ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার মূলধন হারিয়েছে।