আমারদেশ লাইভ এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে শিখন মান কেমন, তা যাচাইয়ে সর্বশেষ ২০১৫ সালে একটি জরিপ চালায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। তাতে দেখা যায়, অষ্টম শ্রেণীর অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীর বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে দক্ষতা কাঙ্ক্ষিত মানের নয়।
বিষয়ভিত্তিক শিখন মান যাচাইয়ে লার্নিং অ্যাসেসমেন্ট অব সেকেন্ডারি ইনস্টিটিউশনস (লাসি) শীর্ষক জরিপটি চালানো হয় দেশের ৩২ জেলার ৫২৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর। এতে অংশ নেয় ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণীর ৩১ হাজার ৬২০ জন শিক্ষার্থী। অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের বাংলা বিষয়ে দক্ষতা যাচাইয়ে যেসব প্রশ্ন করা হয়, তার মধ্যে একটি ছিল ‘সন্ধি’ নিয়ে। ‘মৃৎ+ময়’-এর সন্ধি হলে কী হবে? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারে ৪১ শতাংশ শিক্ষার্থী। অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণীর ৫৯ শতাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যেই বাংলা ব্যাকরণের এ মৌলিক বিষয়ে জ্ঞান নেই।
ইংরেজি ভাষায় শিক্ষার্থীর দক্ষতা পরিমাপে প্রশ্ন করা হয় সর্বনামের ব্যবহার নিয়ে। একটি পূর্ণাঙ্গ বাক্যের যে স্থানে সর্বনাম ব্যবহার হবে, সে স্থানটি শূন্য রাখা হয়। শূন্য স্থান পূরণের জন্য দেয়া হয় চারটি সম্ভাব্য উত্তর। সহজ এ প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারেনি ২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী।
গণিতের দক্ষতা যাচাইয়ে বিভিন্ন দূরত্বের জন্য লাল ও সবুজ রঙের দুটি ট্যাক্সির ভাড়া লেখচিত্র অংকন করে ৫০ কিলোমিটারের জন্য অপেক্ষাকৃত সস্তা ট্যাক্সি নির্বাচন করে কারণ ব্যাখ্যা করতে বলা হয়। এর সঠিক উত্তর দিতে সক্ষম হয় অষ্টম শ্রেণীর মাত্র ২ শতাংশ শিক্ষার্থী। ৯৮ শতাংশ শিক্ষার্থী সঠিক উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়।
এ ধরনের প্রশ্নের ভিত্তিতে পরিচালিত জরিপ প্রতিবেদন বলছে, অষ্টম শ্রেণীর ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থীর ইংরেজিতে প্রয়োজনীয় দক্ষতা রয়েছে। এছাড়া গণিতে দক্ষতা রয়েছে ২২ ও বাংলায় ৫৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর।
অর্থাৎ ৫৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা পাঠ থেকে তথ্য জানতে ও বুঝতে পারে। জটিল বাক্য সহজভাবে বলার সক্ষমতাও তারা দেখিয়েছে। আর ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজিতে অপরিচিত ও জটিল টেক্সট পড়ে তার অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন, বিভিন্ন তথ্যের সংযোগ প্রতিষ্ঠার দক্ষতা দেখাতে পেরেছে। গণিতে পরিচিত টাস্ক সমাধান এবং ওইসব টাস্কে ভুল হলে সেটা সংশোধনের দক্ষতা রয়েছে ২২ শতাংশ শিক্ষার্থীর।
জ্ঞান কাঠামোর এ নিম্নমান তাদের কর্মজীবনেও প্রভাব ফেলছে। বিশ্বব্যাংক মনে করছে, মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার নিম্নমান ও বাস্তবতার সঙ্গে এর ন্যূনতম সম্পৃক্ততার কারণে অপর্যাপ্ত তাত্ত্বিক জ্ঞান নিয়ে তারা কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হচ্ছে। গত ৩১ মার্চ প্রকাশিত “বাংলাদেশ: স্কিলস ফর টুমরো’স জবস” শীর্ষক প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলছে, দক্ষতার অন্যতম ভিত্তি হলো শিক্ষার্থীর অক্ষরজ্ঞান ও গাণিতিক হিসাবের সক্ষমতা। মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার নিম্নমুখী মানের কারণে তাত্ত্বিক বিষয়ে শিক্ষার্থীদের দক্ষতার ভিত্তি দুর্বল হচ্ছে। পরবর্তীতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কার্যকরভাবে দক্ষতা উন্নয়নেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে এ দুর্বল ভিত। অল্প কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের তাত্ত্বিক বিষয়ে দক্ষতা বাড়াতে বিশেষ ব্যবস্থার সুযোগ রেখেছে। তবে দক্ষতা বৃদ্ধির এ সুযোগও পায় না প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে চলে যাওয়া শিক্ষার্থীরা। এমনকি মাধ্যমিক-পরবর্তী শিক্ষা গ্রহণকারীদের মধ্যেও দক্ষতার অভাব থেকে যাচ্ছে। দক্ষতার এ ঘাটতির কারণে চাকরিপ্রার্থীরা চাকরিদাতাকে তুষ্ট করতে পারছেন না।
শিক্ষার এ দুর্বল মান নিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি সম্ভব নয় বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা ভর্তি হচ্ছে, ক্লাস করছে, পাস করে বেরও হচ্ছে। কিন্তু তারা কতটুকু শিখছে? সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। এ শিক্ষায় দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা সম্ভব না হওয়ায় বিদেশীরা এসে বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানের মধ্যে লক্ষ্যগত অসঙ্গতিও রয়েছে। আমাদের চাকরির বাজারে যে ধরনের জনসম্পদ প্রয়োজন, শিক্ষার্থীদের সে আলোকে তৈরি করা প্রয়োজন। যদিও সেটি করা হচ্ছে না।
শিক্ষার্থীদের শিখন মানের অনেকটাই নির্ভর করে শিক্ষকের যোগ্যতার ওপর। যদিও দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের বড় অংশই অপ্রশিক্ষিত। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্যমতে, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় পাঠদানে নিয়োজিত আছেন মোট ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫৫৩ জন শিক্ষক। এর মধ্যে ৭১ হাজার ৭০২ জনের কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ নেই। এ হিসাবে মাধ্যমিক পর্যায়ের ২৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ শিক্ষক প্রশিক্ষণ ছাড়াই পাঠদান করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষকরা যেভাবে পড়ান, তা শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো বুঝতে পারে না। প্রশিক্ষণ না থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে শিক্ষকের পাঠদান। কারণ শিক্ষকরা পাঠদান করেন নম্বরের উদ্দেশ্যে, শেখানোর উদ্দেশ্যে নয়। পরীক্ষাকে কেন্দ্র করেই দেয়া হচ্ছে পাঠদান। অনেক সময় কিছু প্রশ্নকে পরীক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে নির্বাচিত করে সেগুলোই পড়ানো হয়। পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষাক্রম ও শিক্ষক সহায়িকা অনুসরণের কথা বলা হলেও অধিকাংশ শিক্ষকই তা দেখেন না। ফলে ত্রুটিপূর্ণ শিখন পদ্ধতিতে প্রকৃত শিখনফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
নিম্নমানের পাশাপাশি দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার আরেকটি দুর্বল দিক হচ্ছে কর্মসংস্থান নীতিমালার সঙ্গে এর লক্ষ্যগত দূরত্ব। যেমন চাকরির বাজারে চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু বিভাগে অধিক শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। আবার চাহিদা থাকলেও বিজ্ঞান, চিকিৎসা ও প্রকৌশলের মতো বিভাগে আসন বাড়ানো হচ্ছে না। বিশ্বব্যাংকের ‘সাউথ এশিয়া হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট সেক্টর : অ্যান অ্যাসেসমেন্ট অব স্কিলস ইন দ্য ফরমাল সেক্টর লেবার মার্কেট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের মোট শিক্ষার্থীর সবচেয়ে বেশি ৩০ দশমিক ৫ শতাংশ রয়েছে কলা ও মানবিকে। অথচ চাকরির বাজারে এর চাহিদা মাত্র ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ এ শাখায় প্রয়োজনের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হচ্ছে। অন্যদিকে বিজ্ঞানশিক্ষায় ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থীর চাহিদা থাকলেও এতে অধ্যয়নরত মাত্র ৮ শতাংশ। ফলে বিজ্ঞানশিক্ষায় এখনো ঘাটতি রয়েছে ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থীর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, চীন, জাপান ও জার্মানির মতো দেশ তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কারিগরি ও কলকারখানাকেন্দ্রিক শিক্ষিত জনবল তৈরি করেছে। আমাদের দেশেরও চাকরির বাজারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা নীতিমালা গ্রহণ করা উচিত। অন্যথায় শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।