এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : বাজেটের লক্ষ্য পূরণে আগের বছরের সাময়িক আদায়ের তুলনায় ৩৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে চলতি অর্থবছরের জন্য বড় অংকের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ লক্ষ্য অর্জনে এবারো বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে সংস্থাটি।
চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসেই রাজস্ব আহরণে এনবিআরের ঘাটতি ২৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ অবস্থায় রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ৩০ হাজার কোটি টাকা কমানোর আভাস দিয়েছে সংস্থাটি।
আগের অর্থবছরের প্রকৃত আদায় বিবেচনা ছাড়াই উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর না হওয়ায় শুরু থেকেই রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির আশঙ্কা করছিল এনবিআর। অনলাইন পদ্ধতি কার্যকর না হওয়ায় মূল্য সংযোজন করের (মূসক) পাশাপাশি বড় ধরনের ঘাটতিতে পড়েছে আয়কর খাতও। বছরের প্রথম নয় মাসে এ দুই খাতে রাজস্ব ঘাটতি যথাক্রমে ৯ হাজার ৩৯৪ কোটি ও ৯ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে তিন প্রান্তিকে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আহরণ হয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৩১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ নয় মাসে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২৩ হাজার ৭ কোটি টাকা ঘাটতিতে রয়েছে এনবিআর।
রাজস্ব আহরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আগের বছরের সাময়িক হিসাবে ১ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়কে ভিত্তি ধরে ৩৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে বছর শেষে প্রকৃত আদায় ১৪ হাজার কোটি টাকা কমে ১ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকায় নেমে যাওয়ায় এখন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে ৪২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে, যা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অন্যদিকে অনলাইন পদ্ধতির কথা চিন্তা করে ভ্যাট ও আয়কর খাতে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হলেও এ প্রক্রিয়াও ব্যাহত হয়েছে। পাশাপাশি সিগারেট, ব্যাংক, বীমাসহ বৃহৎ খাতগুলো থেকেও রাজস্ব আহরণ কম হয়েছে। মূলত এসব কারণে লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে পড়েছে এনবিআর।
এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, আগের বছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রকৃত আদায় কম হওয়ায় এখন প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে ৪২ শতাংশ। আমাদের জিডিপির তুলনায় কর অনুপাত কম হলেও এত বড় প্রবৃদ্ধি অর্জন রাতারাতি সম্ভব নয়। তাই প্রকৃত আদায়ের সঙ্গে সমন্বয় করে লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করতে হবে। এতে লক্ষ্যমাত্রা ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা কমতে পারে। এটি হলে বছর শেষে রাজস্ব আহরণে ঘাটতি থাকবে না।
এনবিআর ভ্যাট খাতে রজস্ব আহরণে বেশি পিছিয়ে রয়েছে জানিয়ে সংস্থাটির চেয়ারম্যান বলেন, ব্যবসায়ীরা ভ্যাট আহরণ করলেও সরকারি কোষাগারে ঠিকমতো জমা দেন না। এ খাতে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে রয়েছি। সবাই যেন ঠিকমতো ভ্যাট প্রদান করে, সে ব্যবস্থা নিচ্ছি। পাশাপাশি উেস করের পরিধি বাড়িয়ে বেশি মানুষকে কর ও ভ্যাটের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। আমাদের লক্ষ্য— বেশি মানুষকে করজালে নিয়ে আসা ও ব্যবসা করার সুযোগ দিয়ে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে রাজস্ব আহরণে সবচেয়ে বেশি ১৭ দশমিক ৭০ শতাংশ ঘাটতি দেখা দিয়েছে আয়কর ও ভ্রমণ কর খাতে। ৫৩ হাজার ২০৯ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এ সময়ে আদায় হয়েছে ৪৩ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। এ রাজস্ব গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি হলেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা কম। যদিও এ সময়ের মধ্যে আয়কর মেলা, আয়কর সপ্তাহ, আয়কর ক্যাম্প আয়োজনসহ রাজস্ব আহরণ বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর।
অনলাইন কার্যক্রম চালু না হওয়ায় ভ্যাট খাতেও রাজস্ব আহরণে বড় ঘাটতিতে পড়েছে এনবিআর। রাজস্ব আহরণের বৃহৎ খাতটিতে অর্থবছরের নয় মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা পিছিয়ে আছে সংস্থাটি। চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ভ্যাট খাতে ৬৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এনবিআর আহরণ করেছে ৫৫ হাজার ৩৩ কোটি টাকা। এ সময় ভ্যাটে রাজস্ব আহরণে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। যদিও এ সময়ের মধ্যে ভ্যাট-সচেতনতা বাড়াতে ভ্যাট সপ্তাহ, ভ্যাট দিবসসহ নানা কর্মসূচির পাশাপাশি ভ্যাট ফাঁকি রোধে মাঠপর্যায়ে বেশকিছু অভিযান পরিচালনা করেছে এনবিআর। এ সময়ে ভ্যাট রিটার্নের সংখ্যাও ৩২ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৯২ হাজারে উন্নীত করেছে সংস্থাটি।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে ভ্যাট ও আয়করের তুলনায় কিছুটা ভালো অবস্থায় আছে আমদানি-রফতানি পর্যায়ের শুল্ক। অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ৪৯ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে শুল্ক থেকে রাজস্ব এসেছে ৪৫ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ খাতে এনবিআর লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে আছে ৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ। যদিও গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় খাতটি থেকে ১৫ শতাংশ বেশি রাজস্ব পেয়েছে এনবিআর।
বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়ে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করায় এ ঘাটতি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। শেষ মুহূর্তে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন থেকে সরে আসাকেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার জন্য দায়ী করছেন তারা।
উল্লেখ্য, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৮৫ কোটি টাকাকে ভিত্তি হিসাব করে ৩৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে ২ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তবে প্রকৃত আদায় ১ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রায় প্রবৃদ্ধি এখন ৪২ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত ভ্যাট থেকে আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা রয়েছে ৯১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। এছাড়া আয়কর থেকে ৮৭ হাজার ১৯০ কোটি ও শুল্ক বাবদ ৭০ হাজার কোটি টাকা আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে।