এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : সরকারের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন রাজনৈতিক দল নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য হচ্ছে। এতে থাকছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট ও আরও ১২টি দল। এ ঐক্য নির্বাচনকালের জন্য নাকি দীর্ঘমেয়াদি হবে তা নিয়ে আলোচনা চলছে। জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামী নিয়ে ওঠা আপত্তি নিষ্পত্তির চেষ্টাও চলছে। তবে দলগুলো দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে একমত পোষণ করেছে। সেই সূত্র ধরেই এগোচ্ছে আলোচনা। সবকিছু ঠিকঠাক হলে বৃহত্তর ঐক্য গঠনের বিষয়ে অক্টোবরে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয়া হতে পারে। সংশ্লিষ্ট দলগুলোর নীতিনির্ধারণী সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছি। এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। আজকে বাংলাদেশে যারা জাতীয় নেতা ২০-দলীয় জোটের বাইরে আছেন- তারাও গণতন্ত্রের এই সংকটে চিন্তিত। তারাও গণতন্ত্রকে সুসংহত করার জন্য জাতীয় ঐক্যের কথা বলছেন।’ তিনি বলেন, ‘রাজনীতির প্রত্যেকটি জায়গার একটা সময় আছে। আমরা কথা বলছি, কথা চলছে। সবাইকে দেশের ও গণতন্ত্রের স্বার্থে একটা জায়গায় আসতে হবে।’
২০ দলীয় জোটের বাইরে যে ১২ দল এ ঐক্যে থাকছে সেগুলো হল : গণফোরাম, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি, রব), নাগরিক ঐক্য, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বাম-গণতান্ত্রিক ধারার ৩টি দল, ধর্মভিত্তিক ২টি দল ও নিবন্ধিত ২টি ছোট দল।
সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যের বিষয়ে সরকারবিরোধী দলগুলোর কাছে প্রস্তাব দেয় বিএনপি। কিন্তু সে সময় তারা বৃহত্তর ঐক্য গঠন করতে পারেনি। তবে অধিকাংশ দল ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করায় বিএনপি এটিকে তাদের সফলতা হিসেবে দেখে। পরে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্দেশে আবারও সরকারবিরোধী দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র নেতারা। পাশাপাশি বিভিন্ন সভা-সমাবেশেও জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে জোর দেন দলটির চেয়ারপারসনসহ সিনিয়র নেতারা। এ নিয়ে প্রায় আড়াই বছর ধরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে দলটি। একাধিকবার অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন বিএনপি নেতারা।
সূত্র জানায়, সরকারবিরোধী দলগুলোর বৃহত্তর ঐক্য গঠন প্রক্রিয়ার ব্যাপারে কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সংকেতও পেয়েছে দলটি। এক সিনিয়র নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার পর এ বিষয়টি নিয়ে লন্ডনে থাকা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এই ঐক্যের ভিত্তি ও কৌশল কি হবে তা আলোচনা করে ঠিক করতে দলের হাইকমান্ড থেকে সিনিয়র নেতাদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
ঐক্যে আগ্রহী দলগুলোর নেতারা বলছেন, দেশে সত্যিকার অর্থে কোনো গণতন্ত্র নেই। এখানে বিরোধী কোনো দলকে তাদের মতপ্রকাশ করতে দেয়া হচ্ছে না। কোনো নির্দিষ্ট দলের বিরুদ্ধে এ ঐক্য নয়, এটি হবে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও দেশের স্বার্থের জন্য। পাশাপাশি তারা মনে করছেন, জাতীয় নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে সর্বদলীয় ঐক্যের বিকল্প দেখছেন না তারা।
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয় কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কাছে। তিনি বলেন, ‘দেশে জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই। জাতীয় ঐক্য গঠনের চেষ্টা চলছে।’ জেএসডি সভাপতি আসম আবদুর রব বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের দরকার। এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। তবে এ ব্যাপারে দল ও যুক্তফ্রন্টের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘বর্তমান সরকার যে রকম সর্বগ্রাসী হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য হওয়া দরকার। এজন্য বিএনপিকেই উদ্যোগ নিতে হবে। জনগণ যখন দেখবে দলগুলো এক হয়েছে, তখন সরকার এমনিতেই দুর্বল হয়ে যাবে। তবে এক্ষেত্রে বিএনপি যত বেশি উদার এবং কৌশলী হতে পারবে তত বেশি জয়ের সম্ভাবনা থাকবে।’ বিকল্পধারার সভাপতি সাবেক রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, ঐক্যের বিষয়টি নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলতে দেশের দুই বিশিষ্ট নাগরিকসহ কয়েকজন সিনিয়র নেতার ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বিরোধী যেসব দলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে তারা সবাই একমত- দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই। তবে দুটি দল জামায়াত সঙ্গে থাকলে ঐক্য গঠনে রাজি না থাকার কথা বলেছে। তারা জামায়াতকে ঐক্যের বাইরে রাখার পরামর্শও দিয়েছে।
গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘ঐক্য প্রক্রিয়ার মধ্যেই আমরা আছি। সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে আমরা সবাইকে বলেছি ’৭২-এর সংবিধানের মূলনীতি মেনে নিয়ে এটি হতে হবে। এর মধ্যে জামায়াত বাদ পড়ে। কারণ তারা মূলনীতির মধ্যে থাকে না।’ ড. কামাল বলেন, ঐক্যের বিষয়টি শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে দলের বর্ধিত সভায় নেতাকর্মীদের জানানো হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, জামায়াতকে রাখা না রাখার বিষয়টি নিয়ে বিএনপি দলগুলোর কাছে সময় নিয়েছে। আলোচনার মাধ্যমেই এর সমাধান হবে। তিনি আশা করেন, অক্টোবরে বৃহত্তর ঐক্যের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হতে পারে।
সূত্র জানায়, নির্বাচনকালীন ঐক্য হলে জাতীয় নির্বাচনে দলগুলোর মধ্যে আসন ভাগাভাগির বিষয়টি থাকবে। সেক্ষেত্রে বিএনপিকে কিছুটা ছাড় দেয়ার ব্যাপারে এরই মধ্যে দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। বিএনপিও এ ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। আলোচনার অগ্রগতি জানানো হচ্ছে লন্ডনে থাকা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে। আর ঐক্য দীর্ঘমেয়াদি হলে সেক্ষেত্রে ভিত্তি ও কাঠামো কি হবে তা ঠিক করতে দলগুলো আলোচনা শুরু করেছে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে এসব চূড়ান্ত করা হবে। এরপরই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে চায় দলগুলো।
তবে বামপন্থী বড় দলগুলো এ ঐক্যের ব্যাপারে তেমন আগ্রহী নয়। তারা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের বাইরে আলাদা জোট হলে সেখানে যেতে রাজি। তবে তারা এ-ও বলছে, আলাদাভাবেই সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাঠে থাকতে চায় তারা।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘বিএনপি আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে। আমরাও বিরোধিতা করি। কিন্তু বিএনপি প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থী অবস্থানে থেকে বিরোধিতা করছে। আর আমরা প্রগতিশীল বামপন্থী অবস্থানে। সুতরাং অবস্থানগত নীতি-আদর্শের দিক থেকে বিপরীত।’ তিনি বলেন, ‘জাতীয় ঐক্য সমমনা দলের মধ্যে হয়। বিএনপি-আওয়ামী লীগ সমমনা দল। তাদের কোনো দলের সঙ্গেই আমাদের ঐক্য হতে পারে না। ঐক্যের একটি নীতিগত ভিত্তি থাকতে হয়। এই নীতিগত ভিত্তি যাদের সঙ্গে মিলবে তাদের সঙ্গেই ঐক্য হবে।’
বৃহত্তর ঐক্য প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘বৃহত্তর ঐক্য গঠনে জামায়াত বাধা হতে পারে। আর জামায়াতকে হঠাৎ বিএনপির ছেড়ে দেয়াটাও ঠিক হবে না। বিএনপি জামায়াতকে কেনই বা বাইরে রাখবে। জামায়াত ২০-দলীয় জোটের মধ্যে ফ্যাক্টর।’ তিনি বলেন, ‘২০-দলীয় জোটের বাইরে গণফোরাম, বিকল্পধারা, নাগরিক ঐক্য, সিপিবি, বাসদসহ আরও কয়েকটি দল মিলে ঐক্য গঠন করতে পারে। সেক্ষেত্রে একদিকে ২০-দলীয় জোট, অন্যদিকে ওই দলগুলো নিয়ে আরেকটি স্বতন্ত্র জোট- এ দুই জোট মিলে আলাদাভাবেই অগ্রসর হলে ভালো হবে। তারা দাবি আদায়ে সফল হলে একসঙ্গে বসে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’