এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : ফোনে আড়ি পেতে বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজন ও তালিকাভুক্ত দুর্নীতিবাজের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এক্ষেত্রে তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও কথোপকথন রেকর্ড এবং পলাতকদের অবস্থান শনাক্ত করা হচ্ছে।
ফেব্রুয়ারিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতির পর ২৭ মার্চ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে এ কার্যক্রম শুরু করেছে দুদকের স্বতন্ত্র গোয়েন্দা ইউনিট। এ কাজে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সহায়তা নেয়া হচ্ছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
আরও জানা গেছে, দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজে ভয়েজ রেকর্ড, ডাটা সার্ভিস ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর তথ্য সংগ্রহ করতে সংস্থাটির সিস্টেম এনালিস্ট মো. রাজিব হাসানকে ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের ফোনে আড়ি পাতার কার্যক্রম প্রসঙ্গে দুদকের একজন কর্মকর্তা মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, একটি বিশেষ টিমের মাধ্যমে সন্দেহভাজন ও তালিকাভুক্ত দুর্নীতিবাজদের ওপর নজরদারি শুরু করা হয়েছে। তাদের সবকিছু (কথোপকথন, গতিবিধি, অবস্থান ইত্যাদি) ট্র্যাকিং করে সার্ভারে ধারণ করা হচ্ছে। প্রথম দফায় দুই সরকারি কর্মকর্তাসহ ৯ ব্যক্তিকে অনুসরণ করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সোমবার বলেন, কারও কথা বলার স্বাধীনতা যেন খর্ব না হয়, সেটা আমি নিজে নিশ্চিত করতে চাই। তবে যাদের বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ আছে, তারা এর আওতায় পড়বেন। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে যাদের দুর্নীতির বিষয়ে জনশ্র“তি আছে, যাদের দুর্নীতির বিষয়টি সবাই জানে, তাদের ব্যাপারে গোপনে আমরা তথ্য সংগ্রহ করব।
ইকবাল মাহমুদ বলেন, মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের কার্যক্রমটি পুরোপুরিভাবে শুরু করতে হলে আরেকটু সময় লাগবে। আমরা এর জন্য একটি নীতিমালাও করার চিন্তাভাবনা করছি। কেউ কমিশনের অনুমোদন ছাড়া এ কাজ করতে পারবে না।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ কয়েক মাস ধরে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের সতর্ক করে আসছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, তালিকা করে বড় বড় দুর্নীতিবাজকে ধরা হবে। সরকারি সেক্টরের দুর্নীতিবাজদের বিশেষ নজরদারির আওতায় আনা হবে।
সর্বশেষ ২৬ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল পর্যন্ত দুদকের দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহের প্রায় সব অনুষ্ঠানে কথা বলতে গিয়ে ইকবাল মাহমুদ দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদকের কঠোর অবস্থানের কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন। এক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের সতর্ক করেছেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুদক চেয়ারম্যান তার দায়িত্ব গ্রহণের তৃতীয় বছরের শুরু থেকেই (মার্চ ২০১৮) কী করবেন, তার ধারণা আগেই জানিয়েছেন এবং সেভাবেই কমিশন তার পরিকল্পনার ছক চূড়ান্ত করেছে। যার মধ্যে মোবাইল ট্র্যাকিং কার্যক্রম অন্যতম।
দুদক চায়, সংস্থাটির কার্যক্রম যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) ও ভারতের সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (সিবিআই) আদলে পরিচালনা করতে। আর সেভাবেই নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিটের মাধ্যমে রাঘববোয়ালদের দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ শুরু করা হচ্ছে।
দুদকের পঞ্চবার্ষিক কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা (২০১৭-২০২১) বাস্তবায়নের অগ্রাধিকার তালিকায়ও আছে গোয়েন্দা ইউনিটের কার্যক্রম। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, যাচাই-বাছাই, অভিযোগের অনুসন্ধান ও মামলা তদন্ত করতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হয় দুদককে।
দুদক এখন চাচ্ছে নির্ভুল অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করতে নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিটের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে রাখতে। এরই অংশ হিসেবে আড়ি পাতার কাজ শুরু হয়েছে।
দুদকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের কার্যক্রম চালু হওয়ায় দুদকের তালিকাভুক্ত কোনো সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজ বা কোনো আসামি দেশ ত্যাগের পরিকল্পনা করছে কি না, সেটি আগেভাগে জানা যাবে। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে কিছু আগাম তথ্য পাওয়াও গেছে।
আর এ কারণেই একাধিক দুর্নীতির ঘটনায় অনুসন্ধান পর্যায়ে সন্দেহভাজনদের বিদেশ গমনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কাজটি করতে পেরেছে দুদক। সর্বশেষ ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে জড়িত ব্যাংকটির অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান বাবুল চিশতীসহ ১৭ জনের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা চায় সংস্থাটি।
আর এ পর্যায়ে ১৬০ কোটি টাকা আÍসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধে বাবুল চিশতীসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। মামলার পর চারজনকে গ্রেফতারও করা হয়। আগাম তথ্যের ভিত্তিতে এ কাজটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে বলে দাবি করেন ওই কর্মকর্তা।
এদিকে সম্প্রতি সরকারদলীয় চার সংসদ সদস্য ও বিএনপির শীর্ষ ৮ নেতার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক জানান দিয়েছে, সংস্থাটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে অত্যন্ত শক্ত অবস্থান নিয়েছে। নানা আলোচনা-সমালোচনার পর ধীরে ধীরে প্রভাবশালীদের দিকে নজর দেয়া শুরু করেছে দুদক।
গোপনে অনুসন্ধান চলছে শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। এর মধ্যে আছেন সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ট্রেড ইউনিয়নের নেতা, চোরাচালানি, মাদক ব্যবসায়ী, কোচিং সেন্টারের মালিক, সরকারি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। এর মধ্যে বিএনপির ৮ শীর্ষ নেতাসহ ১০ ব্যক্তি রয়েছেন।
১২৫ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেন, অর্থ পাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। ২ এপ্রিল তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়। ২২ এপ্রিলের মধ্যে তাদের ব্যাংক হিসাব চেয়ে সংশ্লিষ্ট ৮টি ব্যাংকে চিঠি পাঠান অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা। অন্যদিকে বিএনপির এই ৮ নেতার অনুসন্ধান শুরুর পরপরই সরকারদলীয় একাধিক এমপির বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, বিএনপি নেতা ও সরকারদলীয় এমপিদের বাইরেও বেশকিছু অনুসন্ধান ও তদন্ত চলছে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে। এ তালিকায় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার নামও আছে। এছাড়া দুই সচিব আছেন এ তালিকায়। আছেন একজন কাস্টম কর্মকর্তা, পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমানসহ তিন পদস্থ পুলিশ অফিসার।
এছাড়া মাদক ব্যবসায় জড়িত ও গডফাদার হিসিবে চিহ্নিত অন্তত দুই ডজন ব্যক্তিকে ‘তারকা চিহ্নিত’ করে অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুদক। অচিরেই তাদের সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ করা হবে।
চলমান অনুসন্ধানের বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, আমরা কারও মুখ দেখে অনুসন্ধান তদন্ত করি না। দুর্নীতির অভিযোগ যার বিরুদ্ধে আছে, সেই অভিযোগ আমরা যে মাধ্যম থেকেই পাই না কেন, তা অনুসন্ধান করব। অনুসন্ধান ও তদন্তে দুদক স্বাধীনভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করবে।