এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসকেলেটর বা চলন্ত সিঁড়ি স্থাপন প্রকল্প থেকে পিছু হটেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। চলন্ত সিঁড়ি ছাড়াই এ সংক্রান্ত দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শিগগিরই ‘সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের উন্নয়ন’ এবং ‘সরকারি কলেজসমূহের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বিজ্ঞান শিক্ষার সম্প্রসারণ’ নামে দুটি প্রকল্পের জিও বা গভর্মেন্ট অর্ডার জারি করা হচ্ছে। ফলে সরকারের প্রায় ১ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকার সাশ্রয় হচ্ছে।
একনেকের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া অনুশাসনকে পুঁজি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। একের পর এক বৈঠক এবং নানা আলাপ-আলোচনা করেও পরিকল্পনা কমিশনের অবস্থান পরিবর্তন করা যায়নি। পরিকল্পনা কমিশনের কঠোর অবস্থান ও বিরোধিতার কারণেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে কমিশনের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, এখন ১০ তলার পরিবর্তে ছয় তলা ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে থাকছে না এসকেলেটরও। বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসকেলেটর, লিফট স্থাপন ও ব্যবহারের ঝুঁকি এবং বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে প্রস্তাবিত ১০ তলা ভবনের পরিবর্তে ছয়তলা ভবন নির্মাণ করার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) অনুসারে একটি ছোট লিফটের সংস্থান রাখা যেতে পারে। যাতে অধিক বয়সী বা অসুস্থ শিক্ষক, ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড শিক্ষার্থী বা ভারি শিক্ষা সামগ্রী বহনের কাজে ব্যবহার করা যায়। কর্মকর্তারা জানান, পরিকল্পনা কমিশনের সিদ্ধান্ত মেনে অবশেষে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধন করা হয়। অনুমোদন দেয়ার প্রক্রিয়াও শেষ করা হয়েছে। প্রকল্প দুটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, গ্রামের স্কুল ও কলেজ ১০ তলা পর্যন্ত করলে অনেক সমস্যা হতে পারে। বাস্তবতা বিবেচনা করতে হবে। তাছাড়া এসকেলেটর স্থাপন না করার জন্য পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে সুপারিশ দেয়া হয়েছে। এর বেশি কিছু বলতে পারছি না।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. মো. মাহামুদ-উল-হক বলেন, এ বিষয়ে কিছু জানি না। অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. মহিউদ্দীন খানের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি। কিন্তু এর আগে মহিউদ্দীন খান যুগান্তরকে বলেছিলেন, কোনো বিষয়েই তিনি কথা বলতে পারবেন না। কথা বলা নিষেধ রয়েছে।
সূত্র জানায়, ‘সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের উন্নয়ন’ নামের প্রকল্পটির মাধ্যমে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এসকেলেটর (চলন্ত সিঁড়ি) স্থাপনের উচ্চাভিলাষী উদ্যোগ নেয়া হয়। ইতিমধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পাওয়া এ প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৪ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। কিন্তু পরে এসকেলেটরসহ অন্য বিষয় যুক্ত করে সেখান থেকে ১ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা বাড়িয়ে নতুন করে ৬ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়। শুধু চলন্ত সিঁড়ির জন্য ব্যয় ১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা ধরা হয়। এ বিষয়ে অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় এসকেলেটর স্থাপন নিয়ে ভেটো দেয় পরিকল্পনা কমিশন। এর বিপক্ষে চারটি যুক্তি তুলে ধরে কমিশন। এগুলো হল- বিদ্যুৎ অপচয় বাড়বে, মেইনটেনেন্স ঠিক মতো হবে না ও নষ্ট হয়ে পড়ে থাকবে, শিক্ষার্থীদের হাঁটার অভ্যাস নষ্ট হবে এবং অর্থের অপচয় হবে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে ৩৩৫টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের অধীন ১২টি বিদ্যালয়ে অন্য একটি প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়ন করা হয়েছে। অবশিষ্ট ৩২৩টি সরকারি বিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু বেশ কিছু শর্তসাপেক্ষে ওই বৈঠকে অনুমোদন পায় প্রকল্পটি। শর্তগুলো হল- মাল্টিস্টোরেড বিদ্যালয়গুলোর জন্য একটি আদর্শ নকশা প্রণয়ন, নকশায় আবশ্যিকভাবে টানা বারান্দা, খোলামেলা ক্লাস রুম, দরজা-জানালার ওপর লুপ গ্লাসের জানালার সংস্থান, ছাদের পানি যাতে সহজেই নেমে যেতে পারে সেজন্য ছাদ ঢালু করা, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আলাদা কমন রুম ও পর্যাপ্ত পানিসহ আলাদা বাথ রুম, এসেম্বলি ও খেলার মাঠ, প্রতিটি ভবনে দুই পাশে দুটি বের হওয়ার রাস্তা, অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ও লিফটের পরিবর্তে এসকেলেটরের ব্যবস্থা করা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, একনেকের সিদ্ধান্তের আলোকে প্রধানমন্ত্রীকে নকশা দেখিয়ে সম্মতি নেয়া হয়েছে। আর একনেকের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে প্রকল্পের ব্যয় ১ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা, যা আগের ব্যয়ের তুলনায় ৩২ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি। সর্বশেষ পরিকল্পনা কমিশনের বৈঠকে বলা হয়, একনেক সভার দেয়া নির্দেশনা যথাযথভাবে পালন করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী জানান, নির্মিতব্য বিদ্যালয়ে ভবনের জন্য আদর্শ নকশা প্রণয়ন করে প্রধানমন্ত্রীকে দেখিয়ে তার সম্মতি নেয়া হয়েছে। তবে এ ডিজাইনে এসকেলেটরের বিষয়টি ছিল না। সেই সময় পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় নির্মিতব্য ভবনের ডিজাইন পর্যালোচনার সময় পরিকল্পনামন্ত্রী বিভিন্ন সমস্যা বিবেচনা করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভবন ছয় তলার বেশি না হওয়া যৌক্তিক মতো প্রকাশ করেন। তাই ৫-৬ তলা ভবন করা হলে একদিকে যেমন এসকেলেটরের প্রয়োজন হবে না, অন্যদিকে ভবন নির্মাণ ব্যয় না বাড়িয়েই শিক্ষার পরিবেশ ও স্বাস্থ্যকর অবস্থা বজায় রাখা সম্ভব। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ঝুঁকি নিরসন ও সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদির প্রয়োজন হবে না। শুধু তাই নয় ভবনের পেছনের দিকে প্রস্তাবিত প্যাসেজ বাদ দিয়ে একনেকে দেয়া অন্য নির্দেশনার আলোকে ভবনের ডিজাইন পুনর্বিন্যাসের নির্দেশনা দেয়া হয়।
সূত্র জানায়, একই ঘটনা ঘটেছে সরকারি কলেজসমূহে বিজ্ঞান শিক্ষা সম্প্রসারণসংক্রান্ত একটি প্রকল্পের ক্ষেত্রেও। এ প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে ২০০টি সরকারি কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ বাড়ানোর কথা বলা হয়। এর মধ্যে ১৭৬টি কলেজে বিভিন্ন ভিতবিশিষ্ট ভবন, জেলা বা বিভাগীয় পর্যায়ে ১০ তলা ভিতবিশিষ্ট ভবন এবং উপজেলা পর্যায়ে ছয় তলা ভিতের ওপর ৩ থেকে ১০ তলা পর্যন্ত একাডেমিক ভবন নির্মাণের প্রস্তাব করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ প্রকল্পটিও অনুমোদন করে একনেক। কিন্তু ওপরের প্রকল্পটির মতো একই ধরনের শর্ত দেয়া হয়। ফলে প্রকল্পের ব্যয় ১ হাজার ৮০৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৭৯২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে নির্মিতব্য ৬৭টি ভবনে এসকেলেটর স্থাপনে প্রায় ৪৭৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার সংস্থান রাখা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তির মুখে এসকেলেটর বাদ দেয়াসহ প্রকল্পটির নামের সঙ্গে বাস্তব কাজের মূল্য খুব কম থাকায় নাম পরিবর্তন করে সরকারি কলেজসমূহের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বিজ্ঞান শিক্ষার সম্প্রসারণ নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পটিতে ১০ তলার পরিবর্তে ৬ তলা ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।