এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত এনজিওগুলোর (বেসরকারি সেবা সংস্থা) কার্যক্রম কঠোর নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। এ মাসের শুরুতে ১১টি এনজিওর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। গত নভেম্বরে বন্ধ হয়েছে ১২টি এনজিওর।
দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ বন্ধ, ভোট উপলক্ষে সব ধরনের অপতৎপরতা রোধ, মানি লন্ডারিং এবং জঙ্গি অর্থায়ন যাতে না হয় সে জন্য এসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে প্রথমত বিদেশি তহবিল ছাড় করার ব্যাপারে এনজিও ব্যুরো থেকে প্রকল্পের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
অপরদিকে তহবিল ছাড় করার পর কে কী কাজ করছে, তা তিন ধাপে মনিটরিং করা হচ্ছে। সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা, এনজিও ব্যুরো এবং স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে চলছে তিন স্তরে নজরদারির কাজ। এনজিও ব্যুরো সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
এ প্রসঙ্গে এনজিও ব্যুরোর মহাপরিচালক কেএম আবদুস সালাম বলেন, এনজিওগুলোর কার্যক্রম আমরা মনিটরিং করছি। মাঠপর্যায়ে তৎপরতা বাড়াতে সাম্প্রতিক সময়ে আমার স্বাক্ষরে জেলা প্রশাসককে চিঠি দেয়া হয়েছে। ফলে এনজিওগুলো কী করছে তা স্থানীয় পর্যায়ে মনিটরিং করা হচ্ছে। পাশাপাশি আমাদের কর্মকর্তারাও মাঠে যাচ্ছেন।
অন্যদিকে মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটের সঙ্গে আমরা কাজ করছি। এ ছাড়া সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তৎপর রয়েছে। তারা কোনো রিপোর্ট পেলে আমাদের সঙ্গে শেয়ার করছে। সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা এলাকায় বেশকিছু এনজিও কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, গত বছরের নভেম্বরে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এনজিওগুলোকে কঠোর নজরদারিতে আনার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকে এনজিওর কার্যক্রমে নজরদারি বাড়ানো হয়।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে চলে আসায় সরকারবিরোধী কার্যক্রম রোধে এনজিওর কার্যক্রমে নজরদারির বিষয়ে আরও তৎপর হয় গোয়েন্দা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা বেশকিছু এনজিওর বিষয়ে আপত্তিকর তথ্য পায়।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকাসহ দেশের পিছিয়ে পড়া এলাকায় প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে এরা কাজ শুরু করে। সব সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করা হয়। এরপরই এপ্রিল মাসের শুরুতে ১১টি এনজিওর কার্যক্রম আপাতত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
এসব এনজিও রোহিঙ্গা এলাকায় কোনো ধরনের কার্যক্রম চালাতে পারবে না। পাশাপাশি আগে বিদেশ থেকে অর্থ এনে তারা কোন খাতে ব্যয় করছে, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য এনজিও হল- ঢাকা আহছানিয়া মিশন, ফ্রেন্ডশিপ, একলাব, সোয়াব, আসিয়াব, আসার এবং বাস্তব উল্লেখযোগ্য।
আহছানিয়া মিশনের প্রেসিডেন্ট কাজী রফিকুল আলম বলেন, ৪ থেকে ৫ দিন আগে রোহিঙ্গা এলাকায় আমাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর কোনো কারণ আমরা জানি না। এ বিষয়ে কোনো সংস্থা থেকেই আমাদের কিছু জানানো হয়নি।
একলাবের কক্সবাজারের আঞ্চলিক সমন্বয়ক রাশেদুল হাসান বলেন, আমাদের কার্যক্রম বন্ধ করেছে, কথাটি ঠিক নয়। আমরা ক্রিশ্চিয়ান এইডের কাছ থেকে কিছু তহবিল নিয়ে রোহিঙ্গা এলাকায় কাউন্সিলিংয়ের কাজ করতে চেয়েছিলাম। সরকার সেটি অনুমোদন দেয়নি।
এদিকে গত বছরের নভেম্বরে জঙ্গি অর্থায়ন সন্দেহে আরও ১২টি এনজিওর কার্যক্রম বন্ধ করেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এগুলো হল- সাফজ, কালব, ওফকা, জাগরণ, এমপিডিআর, মানবাধিকার, শেড ওয়াশ, টাই বিডি, এসআরপিবি, লাচুন ও শিলাফ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব সনজীদা শারমিনের স্বাক্ষরে এই পরিপত্র জারি করা হয়েছে। এগুলোর কার্যক্রম এখনও বন্ধ রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে এনজিওগুলোর ওপর নজরদারির কারণে বিদেশি অর্থ ছাড়ের প্রবণতা কিছুটা কমেছে। সংস্থাটির তথ্য অনুসারে চলতি ২০১৭-১৮ বছরের প্রথম ৯ মাসে এনজিও ব্যুরোর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৪ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা অনুদান এসেছে। আগের বছরে এর পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরে অনুদানের বড় একটি অংশই এসেছে রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য। আর রোহিঙ্গাদের অংশ বাদ দিলে অর্থছাড় অনেক কমে যাবে।
তবে এনজিও ব্যুরো সূত্র বলছে, বিষয়টি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। যে কারণে খুবই সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। কারণ একদিকে নজরদারির জন্য সরকারের চাপ রয়েছে। অন্যদিকে একবার কোনো এনজিওর তহবিল বন্ধ করে দেয়া হলে বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো আর টাকা দিতে চায় না।
সূত্রটি আরও বলছে, এ খাতে অনিয়ম রয়েছে। কিন্তু যেসব অর্থ ছাড় হচ্ছে, তা দেশের মধ্যে ব্যবহার হয়। ফলে এটি শুধু অনগ্রসরদের সহায়তা নয়, এ খাতে বিশাল কর্মসংস্থান রয়েছে। বিষয়টি বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তবে মানি লন্ডারিং, জঙ্গি অর্থায়নের ব্যাপারে সব সময়ই সরকার জিরো টলারেন্সে ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে যোগ হয়েছে, সরকারবিরোধী কার্যক্রম। আগে এ বিষয়টিকে এত বেশি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হতো না।
এনজিও ব্যুরোর তথ্য অনুসারে বর্তমানে বাংলাদেশে ২৪৯টি এনজিও কাজ করছে। একক দেশ হিসেবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। বর্তমানে দেশটির (যুক্তরাষ্ট্র) ৭৯টি এনজিও রয়েছে বাংলাদেশে। অন্য দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্য ৪৪টি, ডেনমার্ক ৫, ফ্রান্স ৮, স্পেন ৪, সৌদি আরব ৬, দক্ষিণ কোরিয়া ১৪, নেদারল্যান্ডস ১১, জাপান ১৭, থাইল্যান্ড ১, ফিনল্যান্ড ২, নরওয়ে ৪, অস্ট্রেলিয়া ১১, সুইজারল্যান্ড ৯, ইতালি ৪, বেলজিয়াম ৩, সুইডেন ৫, সুদান ১, হংকং ২, নিউজিল্যান্ড ২, কুয়েত ২, ভারত ২, কাতার ১, তুরস্ক ১ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ১টি এনজিও কাজ করছে। এসব এনজিও সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করছে স্বাস্থ্য খাতে। এরপরেই রয়েছে শিক্ষা। গত ১০ বছরের মধ্যে বিদেশি এনজিওগুলোর নামে প্রতিবছর গড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড় হয়েছে।
দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারের নজরদারির বিষয়টি ইতিবাচক। কারণ আমাদের সামনে বড় একটি চ্যালেঞ্জ হল রোহিঙ্গা ইস্যু।
শুধু বাংলাদেশ নয়, এ অঞ্চলের জন্য এটি অনেক বড় ইস্যু। এখানে জোরালো নজরদারি দরকার। না হয় এখানে জঙ্গিবাদের উত্থান হতে পারে। এ ছাড়া কেউ সরকারবিরোধী কাজ করলে তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া সরকারের দায়িত্ব। তবে এটি সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে। কোনোভাবেই ভালো প্রকল্পে বিদেশি অর্থ ছাড় করার ক্ষেত্রে প্রভাব না পড়ে, বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে।
জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থ ছাড়ে বিদেশি এনজিওগুলোকে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তি নিতে হয়। গত বছরের ২ অক্টোবর পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হকের নেতৃত্বে গঠিত রোহিঙ্গা সংক্রান্ত জাতীয় টাস্কফোর্সের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফলে এনজিওগুলোর ত্রাণ তৎপরতা প্রায় থেমে যায়।
এরপর চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি জাতিসংঘের অর্থায়নে কাজ করা কয়েকটি এনজিও ও বিদেশি দূতাবাস থেকে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করা হয়। পরে মৌখিকভাবে নিয়ম কিছুটা শিথিল করে সরকার। কিন্তু এনজিওগুলোর ব্যাপারে নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।