এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : সম্প্রতি পরপর কয়েকটি অভিযানে ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াত চক্রের কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতারের পর বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। চক্রটি নিয়োগ পরীক্ষায় ডিভাইস ব্যবহার করে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র সমাধান করে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকে কমপক্ষে ২৬ জন কর্মকর্তার চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরিপ্রাপ্তরাও পরে চক্রের সদস্য হিসেবে কাজ করে। গত ১৮ এপ্রিল ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ‘ডিভাইস জালিয়াতি’র মূল হোতা পুলকেশ দাস ওরফে বাচ্চুসহ ওই চক্রের ৬ সদস্যের দেয়া জবানবন্দিসহ গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য।
এ জালিয়াত চক্রের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক আবু জাফর মজুমদারের নাম বেরিয়ে আসার পর থেকে তার আর খোঁজ মিলছে না। এছাড়া জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরিপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের এডিসি গোলাম সাকলায়েন বলেন, চক্রটিতে ব্যাংক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অনেকেই জড়িত। জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তারাও এভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরি পেয়েছিল। ওই সিন্ডিকেটে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক আবু জাফর মজুমদারসহ আরও বেশ কয়েকজনের নাম উঠে এসেছে। একাধিকবার অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করা যায়নি।
তিনি বলেন, গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে আরও অনেকের নাম উঠে এসেছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। চক্রের সবাইকে গ্রেফতার করা গেলে নিয়োগ পরীক্ষায় এ ধরনের জালিয়াতি বন্ধ করা যাবে।
জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরিপ্রাপ্তদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে বলে জানান এডিসি গোলাম সাকলায়েন। চাকরিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কারও নাম-পরিচয় শনাক্ত করা গেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি তদন্তের স্বার্থে তা প্রকাশ করতে চাননি।
চক্রটি কীভাবে ডিভাইসের মাধ্যমে জালিয়াতি করে জানতে চাইলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলেন, সিন্ডিকেটের সদস্যরা কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে কাজ করে। চক্রের রয়েছে একটি বিশেষজ্ঞ দল। রাজধানীর ফার্মগেটে রয়েছে চক্রের একটি সার্ভিস সেন্টার। পরীক্ষা চলাকালে এ সার্ভিস সেন্টারের বসে চক্রের বিশেষজ্ঞ দল ডিভাইসের মাধ্যমে হলে থাকা পরীক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্রের সমাধান করে দেয়।
পুলিশ সূত্র জানায়, গত ৭ এপ্রিল নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি করার ঘটনায় গ্রেফতার করা হয় ৩ ব্যাংক কর্মকর্তাসহ ১০ জনকে।
গ্রেফতার তিন ব্যাংক কর্মকর্তা হল- পূবালী ব্যাংকের মনিরুল ইসলাম ওরফে সুমন, সোনালী ব্যাংকের অসীম কুমার দাস ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সোহেল আকন্দ। এদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে গত ১৭ এপ্রিল রাজধানীর রমনাসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় সিন্ডিকেট চক্রের মূল হোতা পুলকেশ দাস ওরফে বাচ্চু, তার সহযোগী মনিরুল ইসলাম (২৩) ও ফিরোজ আহমেদকে (২৬)।
এ সময় তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয় ৮টি বিশেষ ডিভাইস ও ১১টি ব্লুটুথ, ইয়ারপিস। আর সর্বশেষ ২০ এপ্রিল সোনালী ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষা চলার সময় রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজ, লালমাটিয়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় এবং তেজগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ৫ জনকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ।
তারা হল- আহসানুজ্জামান, মমিনুল ইসলাম ওরফে মমিন (২৯), রিয়াশদ হোসেন সেতু (৩০), রাশিদুল ইসলাম ওরফে তাজুল (৩১) ও শামসুজ্জামান ওরফে পলাশ (২৯)।
পুলকেশ দাস ওরফে বাচ্চু কীভাবে এই ‘ডিভাইস জালিয়াত চক্র’ গড়ে তোলেন তা উঠে এসেছে আদালতে তার দেয়া জবানবন্দিতে।
পুলকেশ জবানবন্দিতে বলেন, ২০০৫ সালে এইচএসসি পাসের পর ভর্তি হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে ২০১২ সালে অনার্স সম্পন্ন করেন। এ সময় পরিচিত এক বড় ভাইয়ের সহায়তায় মোবাইলে এসএমএস জালিয়াতির মাধ্যমে একটি সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন।
ওই পরীক্ষায় তিনি না টিকলেও টিকে যান তার সঙ্গেই জালিয়াতি করে পরীক্ষায় অংশ নেয়া তার এক বন্ধু। এরপর জালিয়াতি করে আরও কয়েকবার নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন পুলকেশ। কিন্তু কোনোবারই তিনি সফল হননি।
এরপর থেকে তিনি নিজেকে কখনও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আবার কখনও রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পরিচয় দিতেন। আর জালিয়াতির নতুন পথ খুঁজতে থাকেন।
২০১৫ সালের শেষদিকে পুলকেশের সঙ্গে পরিচয় হয় মোহাম্মদ কার্জন নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। একপর্যায়ে তারা দু’জন মিলে নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতির ফন্দি করে।
২০১৬ সালের প্রথমদিকে কার্জনের কাছ থেকে ১৭ হাজার টাকা করে তিনটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস কেনেন পুলকেশ। পরে চীন থেকে এক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে আরও ডিভাইস নিয়ে আসেন তিনি।
এরপর পুলকেশ, জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরিপ্রাপ্ত তার এক বন্ধু ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরিফুর রহমান শাহীনকে নিয়ে বিভিন্ন সরকারি নিয়োগ পরীক্ষার্থী সংগ্রহ করতে শুরু করেন।
পরীক্ষার্থী সংগ্রহের পর পুলকেশ তার সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যদের মাধ্যমে ডিভাইসগুলো পরীক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ ও পরীক্ষার্থীদের শরীরে ডিভাইস স্থাপনসহ সংরক্ষণের কাজ করাতে থাকেন। আর এভাবেই ধীরে ধীরে নিয়োগ পরীক্ষায় ডিভাইস জালিয়াতির একটি বড় সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন।
জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংকে কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পাইয়ে দেন কমপক্ষে ২৬ জনকে। হাতিয়ে নেন মোটা অঙ্কের অর্থ। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক আবু জাফর মজুমদারও রয়েছেন। ডিভাইস জালিয়াত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তারা পরে এ সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে কাজ করেন।