এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : জাতিসংঘে নিযুক্ত নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী প্রতিনিধিদের বাংলাদেশ সফর শুরু হচ্ছে কাল। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের অনাগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে এ সফরকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদের কঠিন পদক্ষেপ ছাড়া রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো কঠিন বলে অনেকে মনে করেন। ফলে নিরাপত্তা পরিষদ এ ব্যাপারে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয় তা জানার জন্য পরিষদের সদস্যদের সফরের দিকে সবাই তাকিয়ে আছেন। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানা গেছে।
রোহিঙ্গারা তাদের ওপর রাখাইনে যে নিষ্ঠুরতা চালানো হয়েছে তার বর্ণনা দেবেন। পাশাপাশি নিরাপদে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার লক্ষ্যে নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপ কামনা করতে পারেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারাও মনে করেন, নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপই রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব।
রোববার নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করবেন। সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা মিয়ানমার সফরে যাবেন। সেখানে দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠক করবেন।
নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দলটি রাখাইন রাজ্যেও যাবে বলে জানা গেছে। এদিকে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আসন্ন বৈঠকের আগে দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করবেন। ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রস্তাব পাস হতে পারে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এবং ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের কাছে রোহিঙ্গা সংক্রান্ত বর্তমান পরিস্থিতির বিস্তারিত তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হবে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে একাধিক বৈঠক করেছে। তবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণের বিরোধিতা করছে নিরাপত্তা পরিষদের দুই স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়া। তবে এবারের সফরকালে এ দুটি দেশের প্রতিনিধিরাও যোগ দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিরা কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলবেন। তারপর নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদের বক্তব্য কী হবে সেদিকে সবার দৃষ্টি থাকবে। কেননা রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মিয়ানমারের ওপর কার্যকর চাপপ্রয়োগ করতে পারে নিরাপত্তা পরিষদ।
জাতিসংঘের এই শক্তিশালী সংস্থা দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এমনকি সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা রাখে। তবে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশের মধ্যে চীন ও রাশিয়া বরাবরই মিয়ানমারের ওপর বলপ্রয়োগের বিরোধী হওয়ায় শক্ত পদক্ষেপ নেয়া যাচ্ছে না।
সম্প্রতি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফর করেছেন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গা সংকট দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের জন্য বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানানোর পর মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে ২৩ জানুয়ারি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর কথা থাকলেও এখন মিয়ানমার সংখ্যালঘু এই মুসলমানদের ফিরিয়ে নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে ভেস্তে যেতে পারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ। মিয়ানমারে যে ধরনের নিষ্ঠুর নিপীড়ন চলেছে তা গণহত্যার শামিল। কিন্তু মিয়ানমার গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংক্রান্ত রোম চুক্তিতে সই না করায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) সাধারণভাবে অপরাধীদের বিচার করা যাবে না। তবে নিরাপত্তা পরিষদ চাইলে আইসিসিতে তাদের বিচার করা সম্ভব। ফলে রোহিঙ্গা সংকটের কার্যকর সমাধানের ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদই উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ বলে অনেকে মনে করেন।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ১৫টি দেশ সদস্য। তাদের মধ্যে পাঁটি স্থায়ী সদস্য হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন। এই পাঁচ দেশের ভেটো ক্ষমতা আছে। অস্থায়ী সদস্য দেশগুলো হল বলিভিয়া, ইকুটোরিয়াল গিনি, ইথিওপিয়া, কাজাকস্তান, কুয়েত, নেদারল্যান্ডস, পেরু, পোল্যান্ড, সুইডেন এবং আইভরি কোস্ট। নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান প্রেসিডেন্ট হল পেরু।
নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে যাওয়ার সময়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (সমুদ্রসীমা) রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) খোরশেদ আলম, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব অনুবিভাগের মহাপরিচালক তারেক মাহমুদসহ উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে যাবেন।
নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের কাছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে পর্যাপ্ত কাগজপত্র ও ডকুমেন্ট হস্তান্তর করা হয়েছে। রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনের পর সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। তারপরই তারা মিয়ানমারের প্রশাসনিক রাজধানী নেপিদো যাবেন।
নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্য দেশের এভাবে একসঙ্গে কোনো সংকট পরিদর্শনে যাওয়ার ঘটনা বিরল। ফলে এ সফরকে ঘিরে বাংলাদেশের প্রস্তুতির পাশাপাশি মিয়ানমারও ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মিয়ানমার নানা ধরনের প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে থাকে। কিছুদিন আগে শূন্যরেখার ওপারে মিয়ানমার অংশ থেকে একটি পরিবারকে রাখাইনে নিয়ে প্রত্যাবাসন শুরু হয়েছে বলে প্রচার শুরু করে। অথচ রোহিঙ্গারা যাতে রাখাইনে নিরাপদে ফিরে যেতে পারে তার উপযুক্ত পরিবেশও সৃষ্টি করেনি মিয়ানমার।
সার্বিক অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, মিয়ানমার নানা অজুহাতে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চায় না। মিয়ানমারকে বাধ্য করা না হলে তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে না। এ পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপ জরুরি।
এদিকে আগামী ৫ ও ৬ মে ঢাকায় ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ৪৫তম বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এ বৈঠকের আগে আগামী ৪ মে সংস্থার সদস্য দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের কক্সবাজারে নিয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দেয়া হবে। ৫৭ জাতির ওআইসি গ্রুপের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট অন্যতম প্রধান এজেন্ডা।
কর্মকর্তারা বলছেন, এ বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে একটি প্রস্তাব পাস হতে পারে। ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে ৭০টি প্রতিনিধি দল অংশ নেবে। এতে ৪০০ থেকে ৫০০ বিদেশি অতিথি আসবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনী ও স্থানীয় উগ্র বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নিষ্ঠুর নিপীড়নের কারণে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। বাংলাদেশে আগে থেকে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ও তার বাইরে ছিল। ফলে সব মিলিয়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচারে হত্যা, রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগসহ নানা ধরনের নিষ্ঠুরতা চালানো হয়।