এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জয়ের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে প্রায় দুই লাখ নতুন ভোটার। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে শ্রমিক, নারী, সংখ্যালঘু এবং ভাসমান ভোটার। এক্ষেত্রে ভোটারদের আঞ্চলিকতাও প্রাধান্য পাচ্ছে। মাদকসহ স্থানীয় সমস্যা সমাধানে বাস্তবসম্মত প্রতিশ্রুতিও অগ্রাধিকার পাচ্ছে। প্রধান দু’দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিরসনের বিষয়টিও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। উভয় সিটিতেই বিভিন্ন পদে বিশেষ করে মেয়র পদে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীর মধ্যে। দু’দলের সব পদের প্রার্থীর জন্যই এসব ফ্যাক্টর কাজ করবে। এসব বিষয় মাথায় রেখেই ভোটের কৌশল নির্ধারণ করছেন প্রার্থীরা। যে দলের প্রার্থী যত দক্ষতার সঙ্গে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে পারবেন সাফল্যের মালা তার গলাতেই শোভা পাবে বলে মনে করেন দুই সিটির সাধারণ বাসিন্দারা।
নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, গাজীপুর এবং খুলনা দুটি সিটি কর্পোরেশনই শ্রমিক অধ্যুষিত। স্বভাবতই এখানকার ভোটারদের বড় অংশ শ্রমিক। সারা দেশ থেকে ছুটে আসা লাখ লাখ মানুষ গাজীপুর এবং খুলনায় আশ্রয় নিয়েছেন জীবন ও জীবিকার তাগিদে। এরাই এখন দুই অঞ্চলের ভোটার। এবার গাজীপুর সিটিতে নতুন ভোটার হয়েছেন এক লাখ ৩৭ হাজার ৪৮৭ জন। খুলনায় নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছেন ৫২ হাজার। দুই সিটিতে এক লাখ ৮৯ হাজার ৪৮৭ নতুন ভোটার যে কোনো পদে জয়ের জন্য অন্যতম নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এদের মধ্যে যেমন আছেন শ্রমিক, তেমনি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীও আছেন। তারা মেয়র এবং কাউন্সিলর নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দুই সিটির শ্রমিকদের মধ্যেই আছে আঞ্চলিক প্রভাব। একদিকে নোয়াখালী-কুমিল্লা। অন্যদিকে বরিশাল-ফরিদপুর-বাগেরহাট। জয় নিশ্চিত করতে হলে সব অঞ্চলের ভোটারদের মন জয় করতে হবে। ভোটের মাঠে জয় নির্ধারণে নতুন এবং শ্রমিক ভোটারের পাশাপাশি ভূমিকা রাখবেন নারী ভোটাররা। দুই সিটিতে মোট ভোটার ১৬ লাখ ৩০ হাজার ২০৫ জন। এর মধ্যে নারী ভোটারের সংখ্যা অর্ধেক। অর্থাৎ ৮ লাখ ১১ হাজার ৯০৮ জন নারী ভোটার। এই অর্ধেক নারী ভোটার যেদিকে ঝুঁকবেন, জয়ের পাল্লা সেদিকেই হেলে পড়বে এটা প্রায় নিশ্চিত। এছাড়া সংখ্যালঘু ভোটার আছে ৬০-৭০ হাজার। বস্তি এলাকায় ভাসমান ভোটার আছে এক লাখের বেশি। জামায়াত-শিবিরের ভোট আছে প্রায় ৪০-৫০ হাজার। এছাড়া বস্তিবাসী-শ্রমজীবী, আঞ্চলিক ও জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকার ভোটারদেরও পক্ষে টানতে হবে। এরা সবাই নির্বাচনে জয়ের ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দুই সিটিতেই মাদকের সমস্যা প্রকট আকার দারণ করেছে। জলাবদ্ধতা, মশার উপদ্রব, রাস্তাঘাটের সমস্যাসহ হাজারও সমস্যায় নিমজ্জিত দুই সিটি। সাধারণ ভোটাররা চান এসব সমস্যা সমাধানের বাস্তবসম্মত প্রতিশ্রুতি।
আগামী ১৫ মে গাজীপুর এবং খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। প্রথমবারের মতো এই দুই সিটিতে দলীয় প্রতীকে মেয়র পদে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। গাজীপুরে মেয়র পদে লড়ছেন মোট ৭ জন। তবে লড়াই হবে মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত দুই প্রার্থীর মধ্যে। এখানে নৌকা নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর আলম। ধানের শীষ নিয়ে ভোট করছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হাসান উদ্দিন সরকার। মেয়র পদ ছাড়াও গাজীপুরে ৫৭টি ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২৫৬ জন এবং মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ১৯টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ভোট করছেন ৮৪ জন। এখানে মোট ভোটার ১১ লাখ ৩৭ হাজার ১১২। এদের মধ্যে পুরুষ ৫ লাখ ৬৯ হাজার ৯৩৫ জন। নারী ৫ লাখ ৬৭ হাজার ৮০১ জন। গাজীপুরে পুরুষ ভোটারের চেয়ে নারী ভোটার মাত্র ২ হাজার ১৩৪ জন কম। অন্যদিকে খুলনায় মোট ভোটার ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৯৩ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৮৬ জন। নারী ভোটার ২ লাখ ৪৪ হাজার ১০৭ জন। এখানে পুরুষের চেয়ে নারী ভোটার বেশি। খুলনায় মেয়র পদে লড়ছেন মোট ৫ জন। খুলনায় ৩১টি ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদের জন্য প্রার্থী হয়েছেন ১৪৮ জন। আর মহিলাদের জন্য ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে প্রার্থী হয়েছেন ৩৮ জন। এখানেও লড়াই হবে মূলত আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি সমর্থিত দুই মেয়র প্রার্থীর মধ্যে।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি এমএ মান্নান। তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ। এবারের নির্বাচনে বিএনপি হাসান উদ্দিন সরকারকে প্রার্থী করে। অন্যদিকে গত সিটি নির্বাচনে মহানগর সভাপতি আজমত উল্লাহ খান ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এবার তাকে মনোনয়ন দেয়নি দলটি। মনোনয়ন না পেয়ে কিছুটা ক্ষুব্ধ আজমত উল্লাহ খান। গত বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে তিনি দলীয় প্রার্থী মো. জাহাঙ্গীর আলমের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় নামেন। এর আগে কয়েকদিন প্রচারে না নামায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় ঐক্য নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত আজমত উল্লাহ খান জাহাঙ্গীর আলমের পক্ষে মাঠে নামায় দৃশ্যত প্রশ্নের উত্তর মিলেছে। অন্যদিকে পূর্ণ শক্তি নিয়ে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন বিএনপির প্রার্থী। দলের নেতাকর্মীরা ধানের শীষের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন। খুলনায় নৌকা নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছেন তালুকদার আবদুল খালেক। সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করে মেয়র পদে লড়ছেন তিনি। এখানে ধানের শীষ নিয়ে ভোট করছেন খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু। এবারই তাকে এ পদে মনোনয়ন দেয় দলটি। এর আগে খুলনা মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনিকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। মেয়র পদে নৌকার তখনকার প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেককে পরাজিত করে ধানের শীষের মনি ভোটযুদ্ধে জয়ী হন।
গাজীপুর ও খুলনার বর্তমান মেয়র পদ বিএনপির দখলে। তারা জয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চান। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গাজীপুর এবং খুলনায় টানা বিজয় সরকারের প্রতি জনগণের অনাস্থার প্রমাণ- এমন বার্তা দিতে চায় বিএনপি। অন্যদিকে শাসক দল আওয়ামী লীগ যে কোনো মূল্যে জয় চায়। এজন্য তারাও বেশ মরিয়া। যদিও স্থানীয় পর্যায়ের ভোটারদের মতে, মেয়র পদে জয়ী হতে হলে দুই প্রধান দলকেই সবার আগে নিজেদের ঐক্য সুসংহত করতে হবে। ঘরের মধ্যে বিরোধ পুষে আর যাই হোক- বিজয় অর্জন করা কঠিন। তাই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংকট ঘোচাতে হবে আগে দুই দলকেই। এর সঙ্গে ভোটারদের মন জয়ে নিতে হবে কার্যকর ও বাস্তবসম্মত কৌশল।
সংশ্লিষ্টদের মতে, দুই সিটি নির্বাচনে প্রার্থীদের জয় নির্ধারণ হবে নারী, শ্রমিক, তরুণ, সংখ্যালঘু, আঞ্চলিক এবং ভাসমান ভোটারদের ভোটে। বিষয়টি মাথায় রেখেই প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকরা ভোটার তালিকা ধরে বিভিন্ন পাড়া ও মহল্লায় গিয়ে ভোটারদের খোঁজ নিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। গাজীপুর ও খুলনা শিল্পাঞ্চল। দুই অঞ্চলে শিল্প-কারখানায় চাকরির সুবাদে অন্য জেলার অনেক মানুষ দুই সিটিতে এসে বসবাস করছেন। এ কারণে এখানে এক এলাকার ঠিকানায় তারা ভোটার হলেও কর্মস্থল পরিবর্তনের কারণে স্থানীয়দের কাছে অপরিচিত। তাদের বাসাবাড়ির ঠিকানাও প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। নির্বাচনে এবারও এ ধরনের ভাসমান ভোটারই বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে বলে স্থানীয়রা মনে করেন।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) খুলনা জেলা কমিটির সম্পাদক অ্যাডভোকেট কুদরত-ই-খুদা বলেন, খুলনায় ভোটের ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে- দলীয় ভোট, জোটগত ভোট। নারী ও শ্রমিক ভোটার। নতুন ভোটার। আর নতুন বা তরুণ ভোটাররা মূলত উন্নয়ন নিয়ে বেশি ভাবছে। ভাসমান ভোটারদের যদি সচেতন করা যায় তবে তারা সঠিক চিন্তার মাধ্যমে ভোট দেবে। আঞ্চলিক ভোটার। এদের মধ্যে বরিশাল, ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জের অনেক ভোটার রয়েছে। তারা আঞ্চলিক দিক বিবেচনা করেই ভোট দেবে। গাজীপুরে শ্রমিকদের পাশাপাশি জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে সংখ্যালঘুদের ভোট। শিল্প অধ্যুষিত এ এলাকায় কয়েক লাখ সংখ্যালঘুর বসবাস হলেও ভোটারের সংখ্যা সোয়া লাখের কিছু বেশি। সংখ্যালঘু ভোটারের ভাগ কাউকে দিতে চায় না শাসক দল আওয়ামী লীগ। বিএনপি এখানে ভাগ বসাতে চেষ্টা করবে। গাজীপুরেও জয় নির্ধারণে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে শ্রমিক ও তরুণ ভোটাররা।