এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ৫ সিটি নির্বাচন সরকার, রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন কমিশনের জন্য এসিড টেস্ট। এসব নির্বাচনে নিরপেক্ষতার প্রমাণ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে নির্বাচন কমিশনকে পরীক্ষা দিতে হবে।
নির্বাচনের সময় সরকারকেও প্রতিষ্ঠিত করতে হবে তাদের শাসনামলে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট সম্ভব। জাতীয় নির্বাচনের আগে সর্বশেষ ৫ সিটির ভোটই এটা প্রমাণের উপযুক্ত সময়। শাসক ও মাঠের বিরোধী দলকে প্রমাণ করতে হবে তারা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়।
তাদের নেতাকর্মীরা কেন্দ্র দখল করবে না। জাল ভোটের মাধ্যমে প্রার্থীর জয়-পরাজয় নির্ধারণ করবে না। সামান্য অজুহাতে ভোট বর্জনের মতো কর্মসূচি দেবে না। মাঠে থেকে জনতার ভোটে দলীয় প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করবে। জয়-পরাজয় যাই হোক ভোটের ফল মেনে নেবে। এসবের ব্যত্যয় ঘটলেই জনতার বিচারে তাদের অনুত্তীর্ণ হওয়ার আশঙ্কা আছে বলে মনে করেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে আসন্ন পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। তাদের মতে, খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ৫ সিটির ভোট হতে যাচ্ছে।
এসব নির্বাচনে নেতা, কর্মী-সমর্থকরা যে ধরনের আচরণ করবেন আগামী জাতীয় নির্বাচনে তার প্রভাব পড়বে। কাজেই সিটিগুলোয় যে দল জয়ী হবে, তারাই জাতীয় নির্বাচনে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকার সুযোগ পাবে। অন্যদিকে কোনো দলের কেউ নেতিবাচক বা ভাবমূর্তি নষ্ট করার মতো কোনো কাজ করলে জাতীয় নির্বাচনের আগে তা সংশোধনের জন্য সময় পাবে না। কারণ সংসদ নির্বাচনের আগে আর বড় কোনো ভোট নেই। সব মিলিয়ে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনগুলো সংসদ নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যারোমিটার হিসেবে কাজ করবে।
তারা বলেন, শুধু রাজনৈতিক দল নয় এসব নির্বাচন ইসির জন্যও এসিড টেস্ট। নির্বাচন কমিশন যতই বলুক তাদের অধীনে আগের নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু হয়েছে, এটা খুব বেশি কাজে আসবে না। গাজীপুর এবং খুলনা সিটির পর রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি নির্বাচনে যা ঘটবে মানুষ সেটা মনে রাখবে। এসব নির্বাচন কতটা অবাধ ও গ্রহণযোগ্য করতে পারে তার ওপর ইসির ভাবমূর্তি অনেকটাই নির্ভর করবে। এ লক্ষ্যে নির্বাচনী প্রচার, ভোট গ্রহণ ও ফল প্রকাশের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
যে কোনো দিকে হেলে পড়লে প্রশ্নবিদ্ধ হবে সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা। এমনকি এ কমিশনের অধীনে আগামী নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করবে কিনা- সেই প্রশ্নও সামনে চলে আসবে।
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। কাজেই সরকার নিজ দলের পক্ষে ভোটার টানার জন্য কোনো প্রক্রিয়া করবে কিনা সে বিষয়টিও নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন সাধারণ মানুষ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং বিদেশিরা। কাজেই ৫ সিটির নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সবাইকে খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে। দুই ধাপে পাঁচ সিটির নির্বাচন করার পরিকল্পনা নিয়েছে ইসি। প্রথম ধাপে ১৫ মে গাজীপুর ও খুলনা সিটির নির্বাচন হবে। দ্বিতীয় ধাপে জুলাই মাসে রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন করার বিষয়ে ইসির প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানা গেছে।
আসন্ন পাঁচ সিটি নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে নির্বাচন কমিশনও। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা বলেছেন, স্থানীয় সরকারের কয়েকটি নির্বাচনে কিছু কিছু কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তিনি বলেন, সংসদ নির্বাচন অতি সন্নিকটে। তাই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে কমিশন অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে।
নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, সংসদ নির্বাচনের আগে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ইসির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনে কোনো অনিয়ম ও দায়িত্বে অবহেলা পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ক্ষমতাসীনদের জন্য পরীক্ষাটা একটু ভিন্ন। সরকারকে একদিকে প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষ নির্বাচন করার প্রমাণ দিতে হবে। অপরদিকে জয়ও নিজেদের ঘরে তুলতে হবে। এ নির্বাচন যদি সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে বিতর্কিত হয়ে পড়ে এবং ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ দৃশ্যত প্রমাণিত হয় সে ক্ষেত্রে সরকারকে দেশে ও বিদেশে সমালোচনার মুখে পড়তে হবে। তখন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে কিনা তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠবে। অন্যদিকে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে থাকা বিএনপির জন্য এসব নির্বাচন আরও কঠিন পরীক্ষা। পরাজিত হলে অনেকটা অস্তিত্ব সংকটে পড়বে দলটি। জয়ী হলে নতুন উদ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবেন নেতাকর্মীরা। তখন সবার কাছে এটাই প্রমাণ হবে যে, সরকারের ওপর জনসমর্থন কমে গেছে। একই সঙ্গে সুশীল সমাজসহ বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে বিএনপির আন্দোলন যৌক্তিক বলে প্রতীয়মান হবে।
সার্বিক বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং পরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো বিতর্কিত হওয়ায় সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্য এখন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন একটি অগ্নিপরীক্ষা। কারণ এ নির্বাচনই ইঙ্গিত দেবে আগামী সংসদ নির্বাচন কেমন হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন করবে বলে সরকার যে দাবি করছে তা এ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণ করে দেখাতে হবে। একই সঙ্গে বিএনপি যে দাবি করছে- সরকার জনবিচ্ছিন্ন, সেটাও এ নির্বাচনে প্রমাণ করতে হবে। সব মিলিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ৫ সিটি নির্বাচন নিঃসন্দেহে বড় দল ও ইসির জন্য এসিড টেস্ট। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে জনপ্রিয় দল তা প্রমাণে দুই দলই সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে- এটাই স্বাভাবিক।
আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংসদ নির্বাচনের আগে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে অগ্নিপরীক্ষা ও অস্তিত্বের লড়াই হিসেবেই মনে করছেন তারা। ক্ষমতাসীনরা ইতিমধ্যে পুরোদমে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গঠন করা হয়েছে কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটিও। মাঠপর্যায়ে সম্ভাব্য প্রার্থীরা ভোটারদের মন জয়ে ব্যস্ত। সরকারের নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ভোটারদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আসছে সিটি নির্বাচন। এতে জয়লাভের মাধ্যমে আরও এক ধাপ এগিয়ে যেতে চায় দলটি। সিটিতে জয়ী হলে দল আরও বেশি উজ্জীবিত হবে। এ জয়ের ধাক্কা জাতীয় নির্বাচনে কাজে লাগবে। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে ভোটাররা আবারও আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থাশীল বলে প্রমাণিত হবে। তবে সিটিগুলোয় দলীয় প্রার্থীরা পরাজিত হলে ক্ষমতাসীনরা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। জনসমর্থন নেই বলে মাঠের বিরোধী দল যে অভিযোগ করছে তা প্রমাণিত হবে। দলটির নেতাকর্মীরা এ ইস্যুটি সামনে এনে সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাবে। যা আগামী নির্বাচনে দলের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রতিটি নির্বাচনই গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, নির্বাচনগুলোয় সরকার ও নির্বাচন কমিশন তাদের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের চেষ্টা করে। আর এ বছর জাতীয় নির্বাচনের বছর হওয়ায় সিটির ভোট থেকে শুরু করে সব ইলেকশন বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে বর্তমান ইসি তাদের দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে। সামনের নির্বাচনগুলোয় সরকার এবং ইসি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্নে বদ্ধপরিকর।
এদিকে বিএনপিও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে অস্তিত্ব রক্ষার চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে। এ জন্য বিএনপিসহ ২০ দল জোটগতভাবে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গাজীপুর ও খুলনা সিটিতে তারা জোটগতভাবে প্রার্থী দিয়েছে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারামুক্তি ও সব দলের অংশগ্রহণে আগামী সংসদ নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবেই তারা নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মতে, এটা স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও এর ফলাফল দেশে-বিদেশে দুই দলের জনপ্রিয়তার মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হবে। এ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা পরাজিত হলে চলমান আন্দোলন ও সার্বিক কর্মকাণ্ডে বড় ধাক্কা লাগার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এ নির্বাচনে জয়লাভ ছাড়া আপাতত বিকল্প কোনো চিন্তা নেই তাদের। তারা মনে করেন, চলমান আন্দোলনে ভয়ভীতি, দমন-পীড়নের কারণে রাজপথে নেতাকর্মী, সমর্থক ও সাধারণ মানুষ নামতে ভয় পায়। কিন্তু সিটি নির্বাচনে তারা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারলে সরকারের বিরুদ্ধেই রায় দেবে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আন্দোলনের পরিপূরক হিসেবে তারা সিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ নির্বাচনে তাদের মনোনীত প্রার্থীর জয় মানে আন্দোলনেরও জয়। এ জয়ের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিকে আরও বেগবান করবে। তিনি বলেন, যে কোনো নির্বাচনকেই বিএনপি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়। কারণ, তারা নির্বাচনে বিশ্বাসী। সুষ্ঠু ভোট হলে ভোটাররা তাদের প্রার্থীকেই ভোট দেবেন।