এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের কাছে তিন হাজারের বেশি আগ্নেয়াস্ত্র আছে। সেখানে পুরনো অস্ত্রের পাশাপাশি নতুন এবং অত্যাধুনিক কিছু অস্ত্র আছে বলে জানা যায়। এসবের মধ্যে আছে এম ১৬ রাইফেল, মিয়ানমারে তৈরি এম ১ রাইফেল, একে ৪৭ রাইফেল, একে ২২ রাইফেল এবং এলএমজি (লাইট মেশিনগান)।
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির সময় জমা না হওয়া অস্ত্রের সঙ্গে সীমান্তের ওপার থেকে দুর্গম পাহাড়ি পথে আসছে ওইসব অস্ত্রের চালান। সশস্ত্র গ্রুপগুলোর চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার এবং নির্বাচনের বছরে রাজনৈতিক কারণে হানাহানিতে এসব অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। প্রায় একই কারণে সাম্প্রতিক সময়ে খুন, অপহরণসহ নানা ধরনের অপরাধের ঘটনায় অশান্ত হচ্ছে পাহাড়ি জনপদ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের গ্রুপগুলোর সশস্ত্র ক্যাডার, সেমি-আর্মড ক্যাডারের সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি হতে পারে। জেএসএস ও ইউপিডিএফ বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে খুন ও অপহরণ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পাহাড়ি বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত আরও রক্তপাতের আশঙ্কা রয়েছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে ২১৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ৪০৪টি।
সূত্রমতে, সাম্প্রতিক সময়ে হানাহানির আরেক কারণ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার। নানিয়ারচরের উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা ওই অঞ্চলে এমপি নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন বলে জানা যায়। তার প্রতিপক্ষ তাকে সরিয়ে দিয়েছে। শক্তিমানের শেষকৃত্যে যোগ দিতে যাওয়ার সময় ওতপেতে থেকে হামলা চালিয়ে সংস্কারপন্থী ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক গ্রুপের প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মাকে হত্যা করা হয়। বর্মাও ওই অঞ্চলে এমপি নির্বাচনের একজন প্রার্থী ছিলেন বলে জানা যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রধান দুই সশস্ত্র আঞ্চলিক গোষ্ঠী জেএসএস এবং শান্তিচুক্তিবিরোধী ইউপিডিএফ বিভক্ত হয়ে যাওয়ায় হানাহানির সংখ্যা বেড়েছে। জেএসএস বর্তমানে মূলধারার জেএসএস ও জেএসএস (এমএন লারমা) এবং ইউপিডিএফ বর্তমানে মূল ইউপিডিএফ ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে বিভক্ত। সূত্রমতে, পাহাড়ি সশস্ত্র গ্রুপগুলোর মধ্যে একটা সমঝোতা ছিল। সে কারণে এক গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলে অন্য গ্রুপ আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেনি। কিন্তু ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর ইউপিডিএফ বিভক্ত হয়ে গণতান্ত্রিক গ্রুপের জš§ হলে হানাহানির মাত্রা বেড়ে যায়।
বর্তমানে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় জেএসএস এবং খাগড়াছড়ি জেলায় ইউপিডিএফের আধিপত্য রয়েছে। তবে নানিয়ারচরসহ কিছু কিছু স্থানে জেএসএস ও ইউপিডিএফের বিদ্রোহী গ্রুপগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠায় ওইসব স্থানে হানাহানি হচ্ছে। এসব হানাহানির অন্যতম কারণ চাঁদাবাজি। এক হিসাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী বছরে প্রায় চারশ’ কোটি টাকা চাঁদাবাজি করে থাকে। এসবের ভাগাভাগি নিয়ে গ্রুপগুলোর মধ্যে বিরোধের জন্ম হচ্ছে।
শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সশস্ত্রগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সঙ্গে সরকারের শান্তিচুক্তি সই হয়। চুক্তির শর্ত মোতাবেক ওই সময়ে জেএসএস সদস্যরা তাদের অস্ত্র জমা দেন। এর বিনিময়ে তাদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। কিন্তু এখন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওই সময়ে অনেক অস্ত্র জমা পড়েনি। সেগুলো এখন পাহাড়কে অশান্ত করতে ব্যবহার হচ্ছে। তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে সীমান্তের ওপার থেকে আসা নতুন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে অনেক উন্মুক্ত সীমান্ত রয়েছে। সেখানে পাহারার ব্যবস্থা নেই।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সীমান্তের ৮৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো সীমান্তচৌকি (বর্ডার আউটপোস্ট-বিওপি) নেই। ফলে সেখানে বাধাহীনভাবে অস্ত্র ঢুকতে পারে। তাছাড়া শান্তিচুক্তি সই করার পর চুক্তি বাস্তবায়নের শর্ত মোতাবেক বেশকিছু নিরাপত্তা ফাঁড়ি প্রত্যাহার করা হয়। শান্তিচুক্তির আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৫৫২টি নিরাপত্তা ফাঁড়ি ছিল। চুক্তির পর অনেকগুলো প্রত্যাহারের পর বর্তমানে সেখানে ২১৮টি নিরাপত্তা ফাঁড়ি রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাহাড়ি সীমান্তে পর্যাপ্ত রাস্তা না থাকায় উন্মুক্ত সীমান্তে বিওপি স্থাপন করা যাচ্ছে না। কেননা বিওপি স্থাপন করতে হলে তার নিরাপত্তার প্রয়োজনে যোগাযোগ জরুরি। বর্তমান অবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন দুর্গম স্থানও রয়েছে, যেখানে কোনো সশস্ত্র হামলা হলে নিরাপত্তা বাহিনীর পৌঁছতে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগে যায়।