এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : টানা দুই দশকের বেশি সময় দেশ চালানোর পর সম্মানের সঙ্গে অবসরে চলে গিয়েছিলেন। ১৫ বছর অবসর কাটানোর পর আবার যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে এলেন, তখন তাঁর বয়স ৯২ বছর। এই বয়সেও তিনি প্রাণবন্ত। তিনি মাহাথির মোহাম্মদ। বিশ্বের সবচেয়ে বর্ষীয়ান সরকারপ্রধান।
বৃহস্পতিবার রাতে শপথ নেওয়ার পর প্রথমবারের মতো মাহাথির সংবাদ সম্মেলনে এসে পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, অর্থনৈতিক সংস্কার এবং এর মাধ্যমে মালয়েশিয়ার অগ্রগতির ধারা এগিয়ে নেওয়াই তাঁর সরকারের মূল কাজ হবে। তাঁর সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ চালাবে। ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন করার জন্য প্রণীত আইনকানুন সব ছুড়ে ফেলে দেবে। মধ্যরাতের প্রাক্কালে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মাহাথির সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা সংবিধান সমুন্নত রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাই। আইনের শাসনমতে দেশ চালাতে চাই।’
বৃহস্পতিবার ভোরে সিঙ্গাপুরের একটি টেলিভিশনের খবরে বলা হয়, মাহাথিরকে রাজা শপথ পড়াতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। দিনভর গুঞ্জন চলতে থাকে। গুজব ছড়িয়ে পড়ে, নাজিব রাজাক প্রধানমন্ত্রীর পদ ধরে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছেন। মাহাথিরের শপথ পড়া বিলম্বিত হওয়ায় গুজব আরও বেশি ঘনীভূত হয়েছিল।
পরাজয় মেনে নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার সময় নাজিব রাজাক কিছু ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলেছিলেন। সেটিই জনমনে সন্দেহ তৈরি করেছিল। নাজিব বলেছিলেন, তিনি জনগণের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মাহাথিরকে নিয়োগ করা আইনসিদ্ধ কি না, তা নিয়ে তাঁর সন্দেহ আছে। তাঁর দাবি, মাহাথির চারদলীয় জোট পাকাতান হারাপানের প্রতিনিধি। জোটগতভাবে তারা বেশি আসন পেলেও দল হিসেবে কেউই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। সে জন্য দেশের জন্য যোগ্য নেতা কে হবেন, তা রাজা পঞ্চম সুলতান মাহমুদই ঠিক করবেন।
মাহাথির বৃহস্পতিবার সকালেই সুলতানকে জনগণের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে বিকেল পাঁচটার মধ্যে ক্ষমতা বুঝিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান। বিকেলে আনুষ্ঠানিক পোশাক পরে রাজপ্রাসাদে যান। বাইরে অগণিত সমর্থক অপেক্ষমাণ ছিলেন। অবশেষে নির্ধারিত সময়ের কয়েক ঘণ্টা পর তাঁর শপথ নেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।
শপথ শেষে মধ্যরাতে মাহাথির সংবাদ সম্মেলনে আসেন। ঠান্ডা অথচ দৃঢ়কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘একটু বেশি সময় লেগে গেল। প্রায় ছয় ঘণ্টা বেশি লাগল। তবে সব প্রতীক্ষারই তো শেষ আছে।’ তিনি তাঁর সহজাত মেজাজে সাংবাদিকদের প্রশ্ন করতে বললেন। ঠাট্টা করে বললেন, ‘প্রশ্ন করার সময় ভুলে যাবেন না কিন্তু, আমি একজন স্বৈরশাসক।’
সবার আগে যে কাজ করবেন বলে মাহাথির জানিয়েছেন সেটি হলো, অর্থনীতি ও বাণিজ্য খাত সংস্কার। তিনি বলেছেন, এই খাত ‘ভয়ানক অবস্থায়’ চলে এসেছে। তিনি বলেন, ‘আমি বাড়িয়ে বলছি না, আমরা এক ট্রিলিয়ন রিঙ্গিত (২৫৩ বিলিয়ন ডলার) দেনায় ডুবে আছি।’
ওয়ান মালয়েশিয়া ডেভেলপমেন্ট বেরহাদ (ওয়ানএমডিবি) নামে পরিচিত হয়ে ওঠা রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ তহবিল থেকে চুরি যাওয়া সাড়ে চার শ কোটি ডলারের বেশির ভাগই ফিরিয়ে আনা যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। বলা হয়ে থাকে, এই অর্থের একটি বড় অংশ নাজিব রাজাক নিজের ব্যাংক হিসাবে সরিয়ে ফেলেছেন।
মাহাথির বলেছেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, এয়ানএমডিবির বেশির ভাগ অর্থ ফেরত আনতে পারব।’ তাঁর কথায় বোঝা যাচ্ছে, নাজিব রাজাকের সামনে ভয়াবহ দিন। তাঁকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে যেকোনো সময় গ্রেপ্তার করা হতে পারে। এ বিষয়ে মাহাথিরের কাছ থেকে তিনি কোনো ছাড় পাবেন বলে মনে হয় না।
নাজিব রাজাকের সরকার এমন কিছু আইন পাস করেছে, যা বিরোধীদের দমন-পীড়ন করার জন্য বানানো হয়েছে বলে বলা হয়। তাদের একটি হলো ফেক নিউজ ল। এই আইনের আওতায় সরকারের সমালোচনাকারী সাংবাদিকদের দমন করে রাখা হয়েছে। মাহাথির বলেছেন, জনগণকে নির্যাতন করার জন্য তৈরি করা কোনো আইন রাখা হবে না।
মাহাথিরের ২২ বছরের নিরবচ্ছিন্ন ক্ষমতাকালের প্রথম দিকে তাঁর বিরুদ্ধে বিচার বিভাগকে দুর্বল করে দেওয়া, সমালোচকদের জেলে ঢোকানো এবং সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। মাহাথিরের রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের মধ্যে যে নিয়তির পরিহাস আছে, সেটি পর্যবেক্ষকদের নজর এড়িয়ে যায়নি। জন ক্যাবোট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক ব্রিগেট ওয়েলশ বলেছেন, ‘যে মাহাথির মালয়েশিয়ার বহু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিলেন, সেই মাহাথিরই গণতন্ত্রের উদ্ধারকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হলেন।’
মাহাথির নিজেও স্বীকার করেছেন, একটি প্রজন্ম আগে সিস্টেম ঠিক রাখার স্বার্থে তাঁকে অপ্রিয় কাজ করতে হয়েছে। এ জন্য তিনি সবার কাছে ক্ষমাও চান। তবে তিনি বলেন, ‘আমাদের ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করতে হবে। পেছনের আবর্জনা ঘাঁটার সময় আমাদের হাতে নেই।’
লেখক : লেইজনি ব্যারোন, টাইম পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক