এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে যা কিছু হয়েছে, সব প্রহসন বলে দাবি করেছে বিএনপি। দলটির অভিযোগ, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নির্বাচন কমিশন মিলে খুলনায় কেন্দ্র দখল, কারচুপি ও ভোট জালিয়াতির মহড়া চালিয়েছে। ১৫০টির বেশি কেন্দ্র দখল করে ভোট ডাকাতি করেছে ক্ষমতাসীন দল। খুলনা পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে বেলা আড়াইটা থেকে ৪টায় ভোট শেষ হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রগুলোয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রহরায় নৌকা প্রার্থীর পক্ষে একচেটিয়া সিল মারা হয়েছে। মঙ্গলবার রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে খুলনা সিটি নির্বাচন নিয়ে দলের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী একথা বলেন । অপরদিকে খুলনা সিটি নির্বাচন প্রসঙ্গে জাতিসংঘ বাংলাদেশ সরকারকে অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছে।
খুলনা সিটি নির্বাচন নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে রাতে দলের সিনিয়র নেতারা বৈঠক করেন। দেড় ঘণ্টার বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। যে কারণে বিএনপি সমর্থিতরা ভোট কেন্দ্রে দাঁড়াতেই পারেননি। ৬০ ভাগের বেশি ভোট পড়েছে বলে নির্বাচন কমিশন দাবি করেছেন। অথচ দুপুরের পর ভোট কেন্দ্র কোনো ভোটারই দেখা যায়নি।
এদিকে ভোট গ্রহণ শেষে খুলনার দলীয় কার্যালয়ে বিএনপির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু সাংবাদিকদের কাছে খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ‘ভোট ডাকাতির’ অভিযোগ করেন। একই সঙ্গে একশরও বেশি কেন্দ্রের ফল বাতিল করে নতুন করে ভোট নেয়ারও দাবি জানান।
নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, এখন পর্যন্ত যে ফল আসছে, এটা কাক্সিক্ষত ফল না। খুলনাবাসী ভোট প্রয়োগ করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই সুযোগ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে আওয়ামী লীগের ভোট ডাকাতির কাছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হলে সংসদ ভেঙে দিতে হবে। সেনা মোতায়েন করতে হবে। না হলে সুষ্ঠু ভোট সম্ভব নয়। আজ খুলনায় সেনা মোতায়েন থাকলে ফল যা-ই হোক, ভোট ব্যবস্থা এমন হতো না। বিরোধী দল সুন্দরভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারত।
ফখরুল অভিযোগ করেন, গণমাধ্যমকে সরকার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। সেটা প্রমাণ হয়েছে- খুলনা সিটি নির্বাচন নিয়ে আমরা খবর পেয়েছি একধরনের, সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হচ্ছে অন্য ধরনের। অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলোয় প্রচার হয়েছে আবার ভিন্নভাবে। আসলে সরকার আসল ঘটনা গণমাধ্যমে প্রচার করতে দেয়নি। সংবাদ সম্মেলনে ভোট কারচুপি সংক্রান্ত একটি ভিডিও ফুটেজ সাংবাদিকদের সামনে উপস্থাপন করেন বিএনপি মহাসচিব।
ফখরুল বলেন, যখন সংবাদ পেলাম ১টার মধ্যেই একের পর এক কেন্দ্র দখল হয়েছে, তখন সিইসিকে ফোন করে বললাম খুলনা নির্বাচনে অনিয়মের কথা। তিনি আমাকে বলেন, আপনারা রাজনৈতিক দল। দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিন। কোথাও কোনো অনিয়মের ঘটনা ঘটেনি। আমি যখন বললাম, আমি আপনাকে সোর্স বলছি, তখন সিইসি নুরুল হুদা বলেন, কোনো টিভি চ্যানেলে দেখায়নি। তখন আমি সংবাদমাধ্যমগুলোর নাম বললে তিনি বলেন, আমি দেখছি। এখনও তিনি দেখছেন। এর আগে গাজীপুরের সিটি নির্বাচনে আবদুল্লা আল নোমানকে আটকের বিষয়ে জানালে তিনি তখনও বলেছেন, আমি দেখছি। তিনি শুধুই দেখছেন।
ফখরুল বলেন, সরকার পুলিশকে বিরোধী দলের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বেশিরভাগ জায়গায় পুলিশ দায়িত্ব নিয়ে বিরোধী দলের ওপর চড়াও হচ্ছে। এটা কখনও একটা জাতির জন্য ভালো কিছু ভয়ে আনবে না। কিন্তু এখন দেখি পুলিশ নিজেরা উদ্যোগী হয়ে একটা বিশেষ রাজনৈতিক দলকে প্রটেক্ট করছে।
ফখরুল বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে থাকলে কোনো নির্বাচন হবে না। বিএনপির প্রথম দাবি খালেদা জিয়াকে আগে মুক্তি দিতে হবে। পরে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে হবে। একই সঙ্গে সরকারের আজ্ঞাবহ বর্তমান নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীক পদত্যাগ করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, বরকত উল্লা বুলু প্রমুখ।
এর আগে বিকালে নয়াপল্টনে যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেন, ভোট প্রহসনেরই হবে, তা নৌকা মার্কার প্রার্থী নিশ্চিত ছিলেন বলেই নির্বাচনের দু’দিন আগে ভোটে জেতার জন্য শুভেচ্ছা জানিয়ে পোস্টার ছাপিয়ে দেয়ালে দেয়ালে সেঁটেছেন।
এ সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ, সহ-দফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু, মুনির হোসেন প্রমুখ।
রিজভী বলেন, বর্তমান অবৈধ সরকার ক্ষমতায় থাকলে কোনো দিনই দূষণমুক্ত নির্বাচন হবে না। সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নির্বাচন কমিশন ও আওয়ামী সশস্ত্র ক্যাডাররা একই নৌকার যাত্রী হওয়ায় ভোট ডাকাতির নির্বাচনকেই আদর্শ নির্বাচন হিসেবে তারা প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে। অবৈধ সরকার জনগণ পরিত্যক্ত হলে বেআইনি কাজ করবেই এবং এর জন্য তাদের কোনো লজ্জাবোধ নেই।
রিজভী দাবি করেন, খুলনায় প্রহসনের আরও একটি নিদর্শন হচ্ছে ধানের শীষের মেয়র প্রার্থী একটি কেন্দ্রে গিয়ে দেখেন, গোটা ব্যালট বইটির প্রতিটি পেপার নৌকা মার্কার সিলে ভরা। আরও কয়েকটি কেন্দ্রে সাংবাদিকরা একই ঘটনা সরেজমিন প্রত্যক্ষ করেছেন। আওয়ামী লীগের সব কাজই প্রকৃতপক্ষে প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
নির্বাচনে ব্যাপক ভোট কারচুপির অভিযোগ করে এর সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরেন রিজভী। তিনি বলেন, ২০নং ওয়ার্ডের শেখপাড়া আইয়ুব আলী ভোট কেন্দ্রে ধানের শীষের সব এজেন্ট বের করে দিয়ে নৌকা মার্কায় সিল মেরেছে ক্ষমতাসীন দল। সোনাপতা স্কুলের সামনে ধানের শীষের প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুর নির্বাচনী ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ইউসেফ স্কুল, আবু হানিফ কেরাতুল কোরআন মাদ্রাসা ও ৩১নং ওয়ার্ডের ১৫টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ১৪টি ভোট কেন্দ্রই দখল করে নিয়ে নৌকা প্রতীকে সিল মেরেছে। এছাড়া ৭, ৪, ১১, ১৩, ১৫, ২৪, ২৫ ও ৩১নং ওয়ার্ডের সব কেন্দ্র দখল করে নৌকা প্রতীকে সিল মেরেছে আওয়ামী ক্যাডাররা। ২৯৪টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে সবকটিতেই ক্ষমতাসীন দলের সশস্ত্র ক্যাডাররা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে নির্বাচনের ফলকে নিজেদের পক্ষে নেয়ার জন্য সব অপচেষ্টা চালিয়েছে।
প্রমাণ হয়েছে নির্বাচন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ -নোমান : বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লা আল নোমান বলেন, সরকার এখন উলঙ্গ হয়ে গেছে, তাই তাদের আর লজ্জা-শরমের কোনো বালাই নেই। খুলনার নির্বাচনই প্রমাণ করছে নির্বাচন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ। তারা জনগণের পক্ষে নয়, গণতন্ত্রের পক্ষে নয়। এ নির্বাচনের পর পর্যালোচনা করে বিএনপিকে নতুন কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে হবে। ইসির ওপর কতটা আস্থা রাখা যায়, তা চিন্তা করতে হবে।
মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় তিনি একথা বলেন। খালেদা জিয়ার কারামুক্তির দাবিতে সভার আয়োজন করে জিয়া সাংস্কৃতিক জোট। সংগঠনের সভাপতি মো. হাসানুল ইসলাম রাজার সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন সাবেক মন্ত্রী গৌতম চক্রবর্তী, বাংলাদেশ ন্যাপের মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া, এনডিপি ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মঞ্জুর হোসেন ঈসা প্রমুখ।
অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের তাগিদ জাতিসংঘের : খুলনা সিটি নির্বাচন প্রসঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র ফারহান হক বলেছেন, বাংলাদেশে অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য আমরা বারবার তাগিদ দিয়ে আসছি। আমাদের এ আহ্বান অব্যাহত থাকবে।
মঙ্গলবার জাতিসংঘের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন।
ব্রিফিংয়ে অংশ নিয়ে বাংলাদেশি সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী জানতে চান- আপনি বারবার এ পোডিয়াম থেকে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলে আসছেন। জাতিসংঘ মহাসচিবও চান একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। কিন্তু এ চাওয়াটা কিভাবে বাস্তবায়ন হবে? কেননা, বাংলাদেশে সদ্য সমাপ্ত খুলনার মেয়র নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ পাওয়া গেছে। শাসকদল আওয়ামী লীগ ব্যাপক শক্তি প্রদর্শন করেছে। জালভোট, ব্যালট ছিনতাই, ভোটদানে বাধা প্রদান এবং বিরোধী প্রার্থী বিএনপির এজেন্টদের বের করে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।