এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছিল এই শহরের মানুষের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামা না বাধিয়ে কেবল সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রেখে এবং প্রতিপক্ষকে চেপে ধরে ভোট নেওয়ার এমন দৃশ্য এই শহরের মানুষ আগে দেখেনি।
নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার সব ব্যবস্থাই ছিল-পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, ম্যাজিস্ট্রেট ও টহল। এর মধ্যেই প্রতিপক্ষের এজেন্ট বের করে দেওয়া, দল বেঁধে বুথে ঢুকে ব্যালটে সিল মারা, বাবার সঙ্গে শিশুর ভোট দেওয়া, দল বেঁধে জাল ভোট দেওয়া, ভোটারদের প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল মারতে বাধ্য করা, দুপুরের আগেই ব্যালট শেষ হওয়াসহ নানা ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। কোথাও কোথাও ছিল আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কর্মীদের সহযোগিতার ভূমিকায়।
এই নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতাও বেশ স্পষ্ট হয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকলেও তারা সেভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ফলে বিভিন্ন প্রার্থী ভোটের আগে ও ভোটের দিন নানা অভিযোগ করলেও কমিশন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।
মঙ্গলবার সকালে ভোট শুরুর পরপর বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে এজেন্ট বের করে দেওয়ার খবর আসতে থাকলেও কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি ছিল ভালো। বিক্ষিপ্ত কিছু কেন্দ্র ছাড়া পরিবেশও ভালো ছিল। মূলত বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ভোটের পরিবেশ পাল্টাতে থাকে। বিভিন্ন কেন্দ্রে সরকারি দলের কর্মীরা ঢুকে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করে। যেসব কেন্দ্রে এসব হয়েছে, তা আধঘণ্টার বেশি স্থায়ী ছিল না। এরপর তারা সটকে পড়ে, সুযোগ বুঝে আবার ফিরে আসে। তারা ফিরে যাওয়ার পরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সক্রিয় হয় শৃঙ্খলা রক্ষার নামে। ততক্ষণে সাধারণ ভোটার আতঙ্কিত হয়ে কেন্দ্র ছাড়েন। আর, এসব চলে বেলা সাড়ে ১১ থেকে দুপুর সাড়ে ১২টায় সবচেয়ে বেশি। তবে শেষ সময় পর্যন্ত এ ধরনের খবর আসতে থাকে। ফলে দুপুরের পর ওই সব কেন্দ্রে তেমন ভোটার দেখা যায়নি।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকারি দলের কাউন্সিলর প্রার্থীর লোকজন দলীয় মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের ব্যালটেই সিল মারে। সিল মারা ব্যালট বিভিন্ন কেন্দ্রে পড়ে থাকতেও দেখা গেছে। যা পরে সংবাদকর্মীরা ক্যামেরায় ধারণ করেন।
প্রথম আলোর আটজন সংবাদকর্মী দিনভর ৮০টি কেন্দ্র ঘুরেছেন। প্রায় সব কেন্দ্রের সামনে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের জটলা দেখা যায়। তাঁরা কার্যত কেন্দ্রের প্রবেশমুখ নিয়ন্ত্রণ করেন। ভোটার, পর্যবেক্ষক যে-ই আসুন, তাঁরা নজরদারি করেন।
১৫ মের নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, অন্তত ৫৪টি কেন্দ্রে অস্বাভাবিক ভোট পড়েছে। খুলনার খালিশপুরের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের নয়াবাটি হাজি শরীয়তউল্লাহ বিদ্যাপীঠ কেন্দ্রে মোট ভোটার ১৮১৭ জন। ভোট গণনা শেষে দেখা গেল, এই কেন্দ্রে মাত্র একজন ছাড়া বাকি সবাই ভোট দিয়েছেন। এর মধ্যে নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী পেয়েছেন ১ হাজার ১১৪ ভোট। ধানের শীষ পেয়েছে ৩৭৩ ভোট। ভোটের হার ৯৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
এ রকম অস্বাভাবিক হারে ভোট পড়েছে আরও একটি ভোটকেন্দ্রে। খালিশপুরেরই ১০ নম্বর ওয়ার্ডের মাওলানা ভাসানী বিদ্যাপীঠ কেন্দ্রে (স্কুলভবনের দ্বিতীয় তলা) মোট ভোটার ১ হাজার ৫০৩ জন। ভোট পড়েছে ১ হাজার ৪৬৭টি। এর মধ্যে নৌকা পেয়েছে ৯৯৭ ভোট। ধানের শীষের পক্ষে পড়েছে ৩৯০। ভোটের হার ৯৭ দশমিক ৬০ শতাংশ।
নতুন বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে মোট ভোটার ১৫০৮। ভোট পড়েছে ১৩৭৮টি। ভোটের হার ৯১ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
অথচ খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটের গড় হার ৬২ দশমিক ১৯ শতাংশ। তিনটি কেন্দ্রে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। ৮৫ শতাংশের বেশি ভোট বেশি পড়েছে ৩ কেন্দ্রে। ছয়টি কেন্দ্রে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। ৭৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে ১২ কেন্দ্রে। ৩০ কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৭০ শতাংশের বেশি।
ভোটের দিন বিভিন্ন কেন্দ্রে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। শহরের বসুপাড়ায় নুরানি বহুমুখী মাদ্রাসা কেন্দ্রে নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষক দলের একজন সদস্য আওয়ামী লীগের স্থানীয় একজন নেতার হাতে অপদস্থ হন। তিনি বিষয়টি মোবাইল ফোনে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ঘটনাস্থল থেকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার না পেয়ে নিজেই কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যান। তখন পেছন থেকে তাঁকে একরকম ধাওয়া করা হয়।
প্রায় সব ভোটকেন্দ্রের অনতিদূরে নৌকা প্রতীকের একটি করে অস্থায়ী নির্বাচনী কার্যালয় ছিল। সকাল সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে তাঁরা সেখানে অবস্থান নেন। অনেক কেন্দ্রে বিএনপির পোলিং এজেন্টরা সেখানে প্রথম বাধা পান। অনেকে শারীরিকভাবে আঘাত বা অপমান-অপদস্থ হয়ে সেখান থেকে ফিরে গেছেন। গণমাধ্যমের কর্মীরা কেন্দ্রে পৌঁছার আগেই, অর্থাৎ সকাল আটটায় ভোট গ্রহণ শুরুর আধঘণ্টা বা পৌনে এক ঘণ্টার আগেই এক দফা এ ঘটনাগুলো ঘটে।
ভোটের দিন নির্বাচনী এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকেরা গাড়ি ও মোটরসাইকেলে নৌকা প্রতীকের স্টিকার লাগিয়ে অবাধে চলাচল করেন। এ ব্যাপারে একজন মোটরসাইকেলচালক ছাড়া পুলিশ বা ভ্রাম্যমাণ আদালত কাউকে শাস্তি বা অর্থদণ্ড করেছেন, এমন খবর পাওয়া যায়নি।
তবে রাতে ভোট গণনা শেষে যে ফলাফল আসে, তাতে ৪ লাখ ৯৩ হাজার ভোটারের মধ্যে ৩ লাখ ৬ হাজার ৬৩৬ ভোট পান পাঁচ মেয়র প্রার্থী। বাতিল হয় ৬ হাজার ৫৬৫ ভোট। আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক ১ লাখ ৭৮ হাজার ভোট পেয়ে জয়ী হন। বিএনপিসহ অন্য চার মেয়র প্রার্থী পেয়েছেন ১ লাখ ১১ হাজার ভোট। এর মধ্যে বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু পান ১ লাখ ৯ হাজার ২৫১ ভোট।
কিন্তু প্রথম আলোর আটজন সংবাদকর্মী ৮০টি কেন্দ্র ঘুরে ধানের শীষ ব্যাজধারী বিএনপির ৮০ জন নেতা বা কর্মীকেও দেখতে পাননি।
তাহলে এই বিপুলসংখ্যক ভোট কারা, কখন দিল? কারণ, লাইনে দাঁড়ানো, ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার সময় বা বুথফেরত অধিকাংশ ভোটারের হাতে ছিল নৌকা প্রতীকের ভোটার স্লিপ বা বুকে ছিল ব্যাজ। বিষয়টি খোদ তালুকদার আবদুল খালেককেও ভাবিয়েছে।
গতকাল বিজয়-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তালুকদার খালেক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ভোটের দিন আমাদের কর্মীদের পরিচিতি ছিল, তারা নৌকার ব্যাজ পরে ছিল। কিন্তু আমি সারা দিন বিএনপির প্রতীকের ব্যাজধারী কাউকে কোনো কেন্দ্রে দেখিনি। এত ভোট কোত্থেকে এল!’
তালুকদার খালেক দাবি করেন, ভোট অবাধ, সুষ্ঠু হয়েছে। কেবল কিছু কেন্দ্রে কাউন্সিলর প্রার্থীরা কিছু বিশৃঙ্খলা করেছে। তার দায় তিনি নেবেন না।
তবে মোট যে ভোট পড়েছে, তা হিসাব করে দেখা যায়, কাউন্সিলরদের ভোটের চেয়ে মেয়র ভোট ৪১১টি বেশি পড়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, কেবল কাউন্সিলর প্রার্থীদের কারও কারও জন্য বুথ দখল বা জাল ভোট দেওয়া হলে মেয়র প্রার্থীদের মোট ভোটের সংখ্যা কম হতো।
তালুকদার খালেককে দীর্ঘদিন থেকে জানেন, খুলনা শহরের এমন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের কয়েকজনের সঙ্গে গতকাল এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা বলেন, খালেক সেই ব্যক্তি, যিনি ২০১৩ সালে মেয়র নির্বাচনে বিনা বাক্যে পরাজয় মেনে নিয়েছিলেন। তাঁর মতো ব্যক্তি রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর লোকদের পুলিশ দিয়ে মাঠছাড়া করে এভাবে জিতবেন এবং তাতে তাঁর সায় থাকবে, তা অনেকেই ভাবতে পারেনি। এই শহরের মানুষ এ ধরনের নিয়ন্ত্রিত ভোটও আগে কখনো দেখেনি।
এর মধ্যে সিপিবির মেয়র পদপ্রার্থী মিজানুর রহমান অনেকটা আক্ষেপ করে প্রথম আলোকে বলেন, এই নির্বাচনে তালুকদার আবদুল খালেক মেয়র হলেন, কিন্তু বিসর্জন দিলেন তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন। এই মন্তব্য সম্পর্কে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে তালুকদার খালেককে প্রশ্ন করা হলেও তিনি এড়িয়ে যান।
বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুর দাবি, খুলনায় ভোট ডাকাতির একটা নতুন সংস্করণ হয়েছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে তার একটা মহড়া হয়ে গেছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনেরও একটা পরীক্ষা হয়েছে। তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সচেতন নাগরিক কমিটির খুলনার সভাপতি আনোয়ারুল কাদির নির্বাচন কমিশনের ভিজিল্যান্স টিমের সদস্য। তিনি ভোটের দিন বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, খুলনা সিটি নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন যে ভূমিকা রেখেছে, তেমনটা যদি জাতীয় নির্বাচনে রাখে, তবে সেই নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা আছে। কমিশনের উচিত হবে খুলনার নির্বাচনের ভুলত্রুটি থেকে শিক্ষা নেওয়া। সূত্র : প্রথম আলো