এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : রোজা শুরু হল আজ, ঈদ আসতে দেরি প্রায় এক মাস। কিন্তু এর মধ্যেই রাজধানীতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চাঁদাবাজরা। বিপণিবিতান থেকে রোজা ও ঈদকেন্দ্রিক চাঁদা আদায় শুরু হয়েছে। দ্বিগুণ করা হয়েছে ফুটপাতের চাঁদা। সংশ্লিষ্টদের দাবি, ফুটপাত থেকে আড়াইশ’ কোটির বেশি এবং বিপণিবিতানগুলো থেকে সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকা (দুটি মিলে ছয়শ’ কোটির বেশি) তোলার ছক এঁকেছে চাঁদাবাজ চক্র। এর বাইরে স্থানীয় পর্যায়ে ছোট/মৌসুমি চাঁদাবাজরাও সক্রিয় হয়ে উঠছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৫০ হোতা (গডফাদার) এসব চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে। এরা হয় রাজনৈতিক নেতা, নতুবা জনপ্রতিনিধি। আর এদের সঙ্গে রয়েছে পুলিশ। যে কারণে এরা অনেক শক্তিশালী। চার শতাধিক প্রতিনিধির মাধ্যমে (লাইনম্যান/সোর্স) টাকা তুলছে তারা। শীর্ষ ২৩ সন্ত্রাসী ও ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের নামেও চাঁদা উঠছে। এমনকি টাকা তুলছে পুলিশও। বসে নেই পাড়ার উঠতি সন্ত্রাসীরাও।
চাঁদাবাজি নিয়ে আতঙ্কে আছেন ব্যবসায়ীরা। উদ্বেগের কথা জানিয়ে তারা বলেছেন, শুধু টাকা নয়, শার্ট, পাঞ্জাবি, শাড়ি, থ্রিপিসও দাবি করছে তারা। পুলিশের কাছে অভিযোগ করে কোনো লাভ নেই। উল্টো বেড়ে যায় চাঁদার অঙ্ক। ফলে যে যেভাবে পারে চাঁদাবাজদের মানানোর চেষ্টা করছে।
মিরপুর, নিউমার্কেট ও পুরান ঢাকার বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, চার-পাঁচ দিন ধরে প্রতিদিনই একের পর এক ফোন আসছে। তারা অপরিচিত ফোন ধরাই ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু ল্যান্ডফোনে চাঁদা চাওয়া এড়ানো যাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে আপসরফা করেই নিরাপদ থাকার চেষ্টা করছি।
মিরপুরের বিপণিবিতান ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ক্ষমতাসীন দলের কোনো কোনো নেতার নামেও চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। ১০ ও ১১ নম্বর বেনারসি পল্লীর একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, ভারতে পলাতক কালাচাঁন ও কিলার বুলবুলের নামে চাঁদা চাওয়া হচ্ছে। বেনারসি পল্লীতে কালাচানের চাঁদা তোলে মোস্তাকের ছেলে মিস্টার। আর কিলার বুলবুলের চাঁদা তোলে চঞ্চল বাবু। এক ব্যবসায়ী বলেন, অন্য বছর ১৫ রোজার পর ওরা চাঁদা চাইত। এবার রোজার আগেই শুরু হয়েছে।
ধানমণ্ডি হকার্স মার্কেটের এক ব্যবসায়ী বলেন, রোজার আগেই ওয়ার্নিং দিয়ে গেছে। মিরপুর রোডের ধানমণ্ডি ও নিউমার্কেট অংশে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কিছু ক্যাডার চাঁদা উঠায়। সারা বছর এদের উৎপাত তো থাকেই, ঈদ পার্বণে এরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এদের বিরুদ্ধে কথা বলে লাভ নেই। কারণ এই এলাকায় ব্যবসা করতে হবে।
পুরান ঢাকার ইসলামপুরের এক কাপড় ব্যবসায়ী বলেন, ডাকাত শহীদ সেই কবেই মারা গেছে। কিন্তু তার সাঙ্গপাঙ্গরা এখনও তৎপর। জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থেই তাদের টাকা দিয়ে ব্যবসা করছি।
চাঁদনীচক মার্কেট বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. খলিলুর রহমান বলেন, আমাদের কাছে এখনও কেউ চাঁদা চায়নি। উপর মহলে আমাদের পরিচিতি আছে, তা অনেকেই জানে। যে কারণে আমাদের ডিস্টার্ব করে কম। তবে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নীরবে কেউ চাঁদা নিয়ে থাকতে পারে।
গুলিস্তান হকার্স, গাউছিয়া, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, খিলগাঁও তালতলা, মীরপুর শাহআলী, ১ নম্বর, গুলশান ১-২, মিরপুরের মুক্তিযোদ্ধা সুপার, মুক্তবাংলা, কো-অপারেটিভ সোসাইটি, কুসুম-এ বাগদাদ, শাহআলী, ধানমণ্ডি হকার্স, তালতলা সুপার এবং উত্তরা ও পুরান ঢাকার বেশির ভাগ মার্কেট ও শপিং কমপ্লেক্স ঘুরে জানা গেছে, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হচ্ছে।
৬০০ কোটি টাকার মিশন : বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের সভাপতি আবুল কাশেম দাবি করেন, রাজধানীতে হকার রয়েছে এক লাখ ১০ হাজারের মতো। কারও কাছ থেকে চাঁদা নেয়া হয় ১০০, কারও কাছ থেকে ২০০, কারও কাছ থেকে ৩০০-৪০০ টাকাও। তিনি বলেন, গড়ে ১৫০ টাকা করে যদি চাঁদা ধরা হয় তবে রোজার আগের ১০ দিনে চাঁদাবাজরা ১৬ কোটি টাকা আদায় করেছে। রোজা শুরু হলে প্রতি ১০ দিনে এ টাকা প্রায় দ্বিগুণ হতে থাকবে। আর ২০ রমজানের পর থেকে চাঁন রাত পর্যন্ত চলবে অরাজকতা। সব মিলে শুধু হকারদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেবে অন্তত আড়াইশ’ কোটি টাকা। এ ছাড়া মৌসুমি হকারদের দিতে হবে অন্তত ২০ কোটি টাকা। তিনি বলেন, চাঁদাবাজ দমন করে যদি সরকার হকারদের কাছ থেকে ট্যাক্স নিত তবে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় হতো।
সরকারি হিসাবে রাজধানীতে ছোটবড় শপিংমলের সংখ্যা ১৪৭টি। কিন্তু বাস্তবে এ সংখ্যা অনেক বেশি। এসব শপিং মলে লক্ষাধিক দোকান রয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এসব দোকান থেকে সর্বনিম্ন ১০ হাজার, সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদাবাজি হবে। সব মিলে সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকার বেশি চাঁদা দিতে হবে।
নিয়ন্ত্র্রণে ৫০ গডফাদার : অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু ফুটপাতের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে এমন গডফাদার গুলিস্তানে চারজন, মতিঝিলে তিন, সদরঘাট এলাকায় তিন, নিউমার্কেটে তিন, ফার্মগেটে তিন, মিরপুর ১ নম্বরে দুই, ১০ নম্বরে দুই, উত্তরায় দুই, বাড্ডায় দুই, কুড়িলে দুইজন রয়েছে। অন্যরা রয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। ফুটপাতে রয়েছে তাদের নিয়োজিত ৪০০ লাইনম্যান। মার্কেটের চাঁদা আদায়ে রয়েছে তাদের আলাদা শিষ্য।
শীর্ষ সন্ত্রাসীর নামে চাঁদাবাজি : শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ কারাগারে। কিন্তু তাদের নামে চাঁদা উঠছে। আবার অনেকেই বিদেশে পলাতক। দেশের বাইরে থেকেই তারা সক্রিয় রয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে- খিলগাঁওয়ের জিসান, মিরপুরের শাহাদাত ও লিটু, কারওয়ান বাজারের আশিক, কল্যাণপুরের বিকাশ-প্রকাশ, বাড্ডার মেহেদী, মগবাজারের রনি, আদাবরের নবী, মোহাম্মদপুরের কালা মনির, শাহ আলীর গাজী সুমন, পল্লবীর মোক্তার, কাফরুলে শাহীন সিকদার, যাত্রাবাড়ীতে ইটালি নাসির, জুরাইনের কচি।
এদের হাত ধরে বাড্ডা এলাকায় ডালিম, রবিন, ভাগ্নে ফারুক, আরিফ, মান্নান, রমজান, দুলাল, মানিক, সিপলু, রায়হান, রুবেল, রিয়াদ; রামপুরায় কালা পলাশ ও মুরাদ; গুলশান-বনানীতে টিপু, মহাখালীতে অপু, মিলন ও জামাই মুকুল; সাততলা বস্তিতে মনির ও লম্বু সেলিম; খিলগাঁওয়ে খালেদ ও মানিক; যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদে জাহাঙ্গীর ও সায়েম আলী; হাজারীবাগে বুলু, লিংকন, তপু, জনি, রফিক, বিল্লু ও মুন্না; কলাবাগানে নাজিম বাবু ও ইমন, মোহাম্মদপুরে গালকাটা মোশারফ, লম্বা মোশারফ, চিকা জসিম, আহম্মদ, সাজ্জাদ, মোহন, পাভেল, লোটন, চাইনিজ তানভীর, রবিন, আদিত, মীম, খলিল ও হাজী আক্কাস এবং শাহ আলীতে বল্টু রাসেল এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে। মিরপুর ১০ ও ১১ নম্বরে চাঁদা উঠছে কালাচান ও কিলার বুলবুলের নামে।
ফুটপাতের লাইনম্যান : মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের পাশের মার্কেটে চাঁদা আদায় করছে সাইফুল ইসলাম ও তার তিন সহযোগী, বায়তুল মোকাররম জিপিও লিংক রোডে হলিডে মার্কেটে খোকন মজুমদার, আবুল হাসেম, মজিবর, পোটল, নসু, হারুন অর রশীদ ও তার সহযোগীরা, উত্তরগেট এলাকায় দুম্বা রহিম, সাজু চাঁদা তুলছে। শাপলা চত্বরে আরিফ চৌধুরী, পল্টনে দুলাল মিয়া ও তার সহযোগী, গুলিস্তান আহাদ পুলিশ বক্স ও রাস্তায় আমিন মিয়া, সাহিদ ও লম্বা হারুন, জুতা পট্টিতে সালেক, গোলাপশাহ মাজারের পূর্ব-দক্ষিণ অংশে ঘাওড়া বাবুল ও শাহীন টাকা তুলছে।
ওসমানী উদ্যানের পূর্ব ও উত্তর অংশে লম্বা শাজাহান, গুলিস্তান খদ্দর মার্কেটের পশ্চিমে কাদের ও উত্তরে হান্নান, পূর্বে সালাম, আক্তার ও জাহাঙ্গীর, গুলিস্তান হল মার্কেটের সামনের রাস্তায় লাইনম্যান সর্দার বাবুল, সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের উত্তর পাশের রাস্তার জজ মিয়া, পূর্ব পাশের রাস্তার সেলিম মিয়া, মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে মো. আলী, আবদুল গফুর ও বাবুল ভুঁইয়া, শাহবাগে ফজর আলী, আকাশ, কালাম ও নুর ইসলাম, যাত্রাবাড়ীতে সোনামিয়া, তোরাব আলী, মান্নান টাকা তোলায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। জুরাইন-পোস্তগোলায় খায়রুল, সিরাজ তালুকদার ও গরু হানিফ, লালবাগে আবদুস সামাদ, চানমিয়া ও ফিরোজ, মিরপুরে-১ এ ছোট জুয়েল, আলী, বাদশা ও মিজান, মিরপর-১১এ আবদুল ওয়াদুদ, শফিক ও হানিফ, গুলশানে হাকিম আলী, কুড়িলে আবদুর রহীম ও নুরুল আমিন, এয়ারপোর্টে আকতার, মনির, ইব্রাহিম, জামাল ও বাবুল, উত্তরায় টিপু, নাসির ও হামিদ।
লাইনম্যান জজমিয়া বলেন, পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের নামে চাঁদা উঠাই। এক হাজার টাকা তুললে আমাকে দেয়া হয় ২০০ টাকা। পুলিশ নেয় ৫০০, নেতারা পান ৩০০ টাকা। প্রতিদিন রাতে থানার ক্যাশিয়ার এসে ভাগের টাকা নিয়ে যায়। আর থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের টাকা পাঠিয়ে দেয়া হয়। তবে কোনো নেতার নাম জানাতে রাজি হননি তিনি।
পুলিশের মন্তব্য : ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) মো. মাসুদুর রহমান বলেন, রমজান ও ঈদ সামনে রেখে রাজধানীতে যাতে চাঁদাবাজি না হয় সে লক্ষ্যে আমরা নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছি। টহল পুলিশের তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। কারও কোনো অভিযোগ থাকলে আমাদের কন্ট্রোলরুমে জানাতে পারে, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পুলিশের কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকলে আমরা তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। তিনি বলেন, এসব অপরাধ প্রতিরোধে পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশও তৎপর রয়েছে।