এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : রোজার মধ্যে রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার পরিকল্পনা নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামী ঈদের পর জুলাইয়ের শেষ দিকে এ তিনি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ভোটের দিন-তারিখ নির্ধারণে মঙ্গলবার কমিশন সভা আহ্বান করা হয়েছে।
তিন সিটির সঙ্গে একই দিন কুড়িগ্রাম-৩ সংসদীয় আসনে উপনির্বাচন এবং কয়েকটি পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা রয়েছে ইসির।
এদিকে তিন সিটি নির্বাচনে প্রচার শুরুর আগে সংসদ সদস্যদের নির্বাচন কার্যক্রম চালানোর সুযোগ দিয়ে আচরণ বিধিমালায় সংশোধনী আনতে যাচ্ছে কমিশন।
এতে নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হওয়া নিয়ে শঙ্কায় আছেন একজন নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কর্মকর্তারা। এমনকি এমপিদের প্রভাবের মুখে প্রশাসন নিরপেক্ষ আচরণ করবে কিনা ও আচরণবিধি প্রতিপালন করতে পারবেন কিনা- তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তারা।
এছাড়া বিএনপির আপত্তি সত্ত্বেও গাজীপুর, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার অনুষ্ঠেয় কমিশন সভার নির্ধারিত আলোচ্যসূচিতে এ বিষয়টি রয়েছে।
ইসির সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে উল্লিখিত সব তথ্য। জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, তফসিল ঘোষণার বিষয়ে আলোচনা করতে বৈঠকে বসতে যাচ্ছি। ওই বৈঠকে সিটি কর্পোরেশনগুলোর মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ, ঈদের সরকারি ছুটি ও পরীক্ষার বিষয়গুলো বিবেচনা রেখে ভোটের দিন নির্ধারণ করা হবে।
খুলনার প্রেক্ষাপটে সামনের চার সিটি নির্বাচনে ইসি বাড়তি কোনো পদক্ষেপ নেবে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, আমরা কুমিল্লা, রংপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন করেছি। কিছু ইনসিডেন্ট কুমিল্লা ও রংপুর নির্বাচনে ঘটেছে।
কিছু ইনসিডেন্ট খুলনায় হয়েছে। সেখানে তিনটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ বন্ধ করেছি। আমরা খুলনার বিষয় তদন্ত করছি। পত্রপত্রিকায় যেসব সংবাদ বেরিয়েছে তাও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি, যাতে কোনো কিছু আমলে নেয়ার মতো আছে কিনা? সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য যা যা করার, তাই করব।
তবে সুষ্ঠু ভোট গ্রহণ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, খুলনা সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচন কমিশনের যে ভূমিকা দেখেছি তাতে আমরা উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত। তাদের দায়িত্ব পালনে পক্ষপাতদুষ্টের লক্ষণ দেখছি। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের অনীহা দেখা যাচ্ছে।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, আইনি জটিলতায় পিছিয়ে পড়া গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ২৬ জুন ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। আর কুড়িগ্রাম-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাইদুল ইসলাম মারা যাওয়ায় তার আসনটি শূন্য হয়েছে।
এ উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা সংক্রান্ত ফাইল অনুমোদনের জন্য কমিশনে তোলা হয়েছে। তারা জানান- রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি নির্বাচনে ২০১৩ সালের ১৫ জুন ভোট গ্রহণ হয়েছে। তিন সিটি কর্পোরেশনের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন তারিখে। এ হিসাবে ৫ অক্টোবর রাজশাহী সিটির, ৮ অক্টোবর সিলেট ও ২৩ অক্টোবর বরিশাল সিটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে।
এর আগের ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচনের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে কমিশন জুলাইয়ের শেষ দিকে এসব নির্বাচন করতে চায়। এলক্ষ্যে রোজায় তফসিল ঘোষণা হতে পারে।
ইসির একাধিক কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদতবার্ষিকীর মাস আগস্টে কোনো নির্বাচন করার বিপক্ষে কমিশন। এ কারণে জুলাইয়ের মধ্যেই তিন সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের অন্যান্য নির্বাচন শেষ করার পরিকল্পনা ইসির।
নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, আগস্ট জাতীয়ভাবে শোকের মাস হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। ব্যক্তিগতভাবে ওই মাসে কোনো নির্বাচন করার পক্ষপাতী নই। বাকিটা চারজন কমিশনারের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করব।
বিধিমালা সংশোধনের প্রস্তাব যাচ্ছে আইন মন্ত্রণালয়ে : সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের প্রচারের সুযোগ দিয়ে সিটি কর্পোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা সংশোধনের প্রস্তাব দু-এক দিনের মধ্যে ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে যাচ্ছে কমিশন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৪ মে কমিশনের ২৯তম সভায় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির স্বার্থে এমপিদের প্রচারের এ সুযোগ দেয়া হয়। রোববার ওই বৈঠকের কার্যবিবরণী চূড়ান্ত না হওয়ায় সংশোধনীর প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়নি। আজ সোম বা কাল মঙ্গলবার তা পাঠানো হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির এক কর্মকর্তা বলেন, খুলনা ও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এমপিদের নির্বাচনী কার্যক্রমের অংশ নেয়ার সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও নানাভাবে তাদের প্রচ্ছন্ন প্রভাব ছিল।
খুলনা সিটি কর্পোরেশনের বাইরে অবস্থান করে একজন সংসদ সদস্য নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। এবার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভিন্নরূপ দেখা যাবে। তিন সিটি কর্পোরেশনে দলীয় প্রার্থীকে জয়ী করতে বিপুলসংখ্যক এমপি নির্বাচনী এলাকায় যাবেন বলেও আশঙ্কা করছেন তিনি।
এ কর্মকর্তা বলেন, ২০১০ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থীকে জয়ী করতে এমপিদের প্রভাব বিস্তারের অসংখ্য নজির রয়েছে। তাদের পছন্দের প্রার্থীর কারণে নির্বাচনে সহিংসতা বেশি ছিল। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিন সিটিতে একই চিত্র উঠে আসতে পারে।
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির উদ্যোগ নস্যাৎ আশঙ্কা নির্বাচন কমিশনারের : এমপিদের প্রচারের সুযোগ দেয়া হলে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির উদ্যোগ নস্যাৎ হবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।
বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত কমিশন সভায় লিখিত ‘নোট অব ডিসেন্টে’ এ কথা বলেন তিনি। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমি মনে করি সংসদ সদস্যদের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রচারে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হলে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হবে। এতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির উদ্যোগ নস্যাৎ হবে।
এর আগে কাজী রকিব উদ্দীন কমিশন এমপিদের সিটি নির্বাচনে প্রচারের সুযোগ দিয়ে আচরণ বিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মুখে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। বর্তমান সরকারের আমলে ২০১০ সালে সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন আচরণবিধি সংশোধন করেছিল।
তার আওতায় সংসদ সদস্যসহ সব সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির এ নির্বাচনে প্রচারণার সুযোগ নেই।’
‘নোট অব ডিসেন্টে’ তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘সংসদ সদস্যদের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সংজ্ঞা থেকে বাদ দেয়া ঠিক হবে না। আমাদের দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সংসদ সদস্যরা স্থানীয় পর্যায়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এমপিদের নামে সরকারি অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়।
বিশেষত নির্বাচনের পূর্বে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম তাদের মাধ্যমেই পরিচালিত হয়। প্রশাসন ও অনেক স্থানীয় প্রতিষ্ঠানই তাদের আদেশ-নির্দেশে চলে। শিক্ষায়তনগুলো তাদের করায়ত্ত বলা যায়। এ দেশে বাস্তবতা হচ্ছে এমপিরা নিজেদের এলাকায় সর্বেসর্বা।
এমতাবস্থায় এমপিদের স্থানীয় নির্বাচনের প্রচারে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হলে স্থানীয় প্রশাসনের অফিসার ও পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের নির্দেশ অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবেন।
সংসদ সদস্যদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। আমার জানামতে জাতীয় সংসদ সদস্যদের কোনো দেশে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হওয়ার জন্য ম্যান্ডেট দেয়া হয় না।’
এমপিদের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার সুযোগ দেয়ার বিরোধিতা করে মাহবুব তালুকদার আরও বলেছেন, ‘এমপিরা সরকারি সুবিধাভোগী নন বলে যে বক্তব্য রাখা হয়েছে তা নিতান্তই পরিহাসমূলক। তারা সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেন না, এ কথা সত্য।
কিন্তু তারা এমপি হিসেবে কোটি টাকার গাড়ি ক্রয়ে ট্যাক্স রেয়াত পেয়ে থাকেন। এটা কি সরকারি সুবিধাভোগ নয়? এছাড়া তারা রাজউক, চউক ইত্যাদি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যক্তিগতভাবে যে প্লট বা জমি পেয়ে থাকেন, তা কি সরকারি সুবিধাভোগ নয়? এ বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন।
তিনি বলেন, একটি রাজনৈতিক দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তড়িঘড়ি করে আইন ও বিধিমালা পরিবর্তন করে যেভাবে সংসদ সদস্যদের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির তালিকা থেকে বাদ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তা অভিনব।
নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব প্রয়োজন অনুযায়ী বিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এ বিষয়ে আমরা সর্বমহলে নিন্দিত হয়ে পড়ব। আজ পর্যন্ত এ সংশোধনের পক্ষে কেউ অভিমত প্রকাশ করেছেন বলে আমার জানা নেই। আমি মনে করি না যে, সংসদ সদস্যরা নির্বাচনকালে তাদের নিজস্ব এলাকায় না গেলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়বে। বরং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তাদের উপস্থিতিতে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে না।’