এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : দর নির্ধারণ ইস্যুতে বারবার আটকে যাচ্ছে আগামী বছরের নতুন পাঠ্যবই মুদ্রণ কার্যক্রম প্রক্রিয়া। জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) যে দরে কাজ দিতে চায় মুদ্রাকররা তার চেয়ে অনেক বেশি দর হাঁকছেন। এ কারণে ইতিমধ্যে পাঠ্যবইয়ের পাঁচ টেন্ডারের চারটিতেই সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের দুটি টেন্ডারই বাতিল হয়ে যায়। পরে দ্বিতীয়বার টেন্ডার ডাকতে হয়েছে। মাধ্যমিকের দুটি টেন্ডারের একটি জটিলতায় আটকে আছে। সেটিরও আংশিক বাতিল হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এছাড়া একাদশ শ্রেণীর বইয়ের টেন্ডারও বাতিল হয়ে যায়। পরে উপায়ান্তর না পেয়ে টেন্ডারের পরিবর্তে ‘অফারিং’ পদ্ধতিতে বই ছাপতে হচ্ছে।
নির্বাচনী বছর হওয়ায় এবার অক্টোবর মাসের মধ্যে বই ছাপিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরবরাহের লক্ষ্য ছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে বারবার টেন্ডার বাতিল হওয়ায় সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। এমনকি পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষার্থীদের হাতে যথাসময়ে বই না পৌঁছানোর আশঙ্কা আছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘অক্টোবরের মধ্যে আমরা এবারের পাঠ্যবই মুদ্রণ কাজ শেষ করতে চেয়েছিলাম। মাধ্যমিকের বইয়ের একটি অংশ হয়তো এই সময়ের মধ্যে ছাপানো সম্ভব হবে। প্রাক-প্রাথমিকের (শিশু শ্রেণী) বইও পেয়ে যাব। নতুন টেন্ডারের কারণে হয়তো প্রাথমিক এবং মাধ্যমিকের কিছু বই ছাপাতে বিলম্ব হবে। তবে ১৫ নভেম্বরের মধ্যেই কাজ শেষ হয়ে যাবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিনামূল্যের পাঠ্যবই নিয়ে এবার এনসিটিবিতে একটি সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। ওই সিন্ডিকেটে এনসিটিবির কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে দেশি-বিদেশি মুদ্রাকরদের একটি অংশ আছে। বিদেশি গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্প্রতি এনসিটিবির এক শীর্ষ কর্মকর্তার বৈঠক হয়। সেই বৈঠক নিয়ে তোলপাড় হয়।
অপরদিকে কাগজ ও বইয়ের কাজের প্রাক্কলন তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাটির মধ্যম সারির কিছু কর্মকর্তা এবং কয়েকজন কর্মচারীর বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী অবস্থান নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই অংশটির সঙ্গে মুদ্রাকরদের একটি অংশের যোগসাজশ আছে। এর মধ্যে এনসিটিবির সরকারবিরোধী অংশটি বই-কাগজের প্রাক্কলিত দর কমিয়ে দিয়ে ‘সাবোটাজ’ করেছে, যাতে বইয়ের টেন্ডার বাতিল হয়ে যায় এবং বইয়ের কাজ বিলম্বিত করা হয়। আর সিন্ডিকেটের মুদ্রাকর অংশটি বেশি দর দিয়ে ফায়দা লুটে নেয়ার ফাঁদ পেতেছে। ফলে একের পর এক প্রাক্কলিত দরের চেয়ে বেশি হেঁকে যাচ্ছে। এসব অভিযোগের বিষয় অবশ্য ইতিমধ্যে তদন্তে নেমেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। কয়েকদিন আগে এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে গোয়েন্দারা বৈঠক করেছেন।
এ ব্যাপারে এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, একটি দুষ্ট চক্র এক্ষেত্রে কাজ করছে। তবে সেই দুষ্ট চক্রটিকে আমি চিনি না। কাদের সমন্বয়ে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে সেটা আমার পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি। তিনি আরও বলেন, প্রাক্কলিত দরের চেয়ে এবার টেন্ডারের দর বেশি হয়েছে। এ কারণে আমাদের কয়েকটি টেন্ডার বাতিল হয়েছে। আসলে আমরা ২-৩ মাস আগে প্রাক্কলন করে থাকি, যে কারণে বর্তমান দরের সঙ্গে প্রাক্কলনের মিল ছিল না।
শিশু থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সরকার বিনামূল্যে বই বিতরণ করে থাকে। এর মধ্যে শিশু শ্রেণীর বইয়ের যে টেন্ডারে ছাপানো হয়, সামান্য কারণে সেটির টেন্ডার বাতিল হয়েছে। জানা গেছে, এই স্তরের বইয়ের কাগজের উজ্জ্বলতা চাওয়া হয়েছিল ৯০ শতাংশ। কিন্তু টেন্ডারের সঙ্গে দাখিলকৃত স্যাম্পল কাগজের উজ্জ্বলতা দশমিক ২৪ শতাংশ কম ছিল। এ কারণে এই টেন্ডার বাতিল করা হয়।
এ ব্যাপারে মুদ্রণ শিল্প সমিতির চেয়ারম্যান তোফায়েল খান বলেন, এই সামান্য ডেভিয়েশন (ঘাটতি) নিয়ে অতীতে অনেক বই ছাপানো হয়েছে। তাছাড়া স্যাম্পলের সঙ্গে হুবহু মিলিয়ে কখনই বই গ্রহণ করে না এনসিটিবি। তাই এই সামান্য বিষয়টি উপেক্ষা করলে পুনঃটেন্ডারে যেতে হতো না। এতে সময়ের অপচয় বন্ধ হতো।
প্রাথমিকের বইয়ের টেন্ডারও এবার বাতিল হয়। মুদ্রাকররা এবার এনসিটিবির প্রাক্কলনের চেয়ে অনেক বেশি দর হাঁকে। এতে প্রাথমিকের বইয়ের টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির সদস্যরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে সহজ সমাধানের জন্য সদস্যদের একটি অংশ সময় সাশ্রয়ের লক্ষ্যে টেন্ডার বহাল রেখে নতুন প্রাক্কলন তৈরির পক্ষে মত দেন। কিন্তু আরেক অংশ টেন্ডার বাতিলের পক্ষে মত দেন। এমন পরিস্থিতিতে এই টেন্ডারও নতুন করে ডাকা হয়েছে। আগামী ২১ জুন টেন্ডার সিডিউল দাখিলের শেষদিন নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে এই বই মুদ্রণ কার্যক্রম অক্টোবর দূরের কথা ডিসেম্বর মাস লেগে যেতে পারে।
এ ব্যাপারে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, এ বছর বাজারে কাগজের দর অনেক বেশি। বই ছাপানোর অন্যান্য উপাদানের দামও বেশি। বই ছাপানোর দরে ৮০-৮৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয় কাগজের পেছনে। এনসিটিবিও জানে যে, কাগজের দাম এবার বেশি। কেননা তারা মাধ্যমিকের ৩৪০ প্যাকেজের কাগজ গতবছরের চেয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি দামে কিনেছে। মাধ্যমিকের কাগজের পুরুত্ব ৬০ জিএসএম। অপরদিকে প্রাথমিকের কাগজের পুরুত্ব ৮০ জিএসএম। সেই হিসেবে প্রাথমিকের কাগজের দাম বেশি হবে। কিন্তু তারা প্রাক্কলন করেছে ৮২ হাজার টাকা। অথচ মাধ্যমিকের কাগজ কিনেছে ৯৬ হাজার থেকে ১ লাখ ১ হাজার টাকা (প্রতি মেট্রিক টন)। এ কারণে টেন্ডারে রেট বেশি পড়ে। ফলে এনসিটিবি কাউকে কাজ না দিয়ে নতুন টেন্ডার ডেকেছে। এতে এই স্তরের বই ছাপা কাজ প্রায় তিন মাস পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
মাধ্যমিকের যেসব বইয়ের কাগজ এনসিটিবি কিনে দিয়েছে সেগুলোর ছাপা কাজ ঈদের পর শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু ৩২০ প্যাকেজের অপর টেন্ডারেও উচ্চ দর হাঁকার ঘটনা ঘটেছে। এক্ষেত্রে মুদ্রাকরদের মধ্যে সিন্ডিকেট হয়েছে। বিশেষ করে প্রভাবশালী মুদ্রাকররা লটভিত্তিক ভাগ হয়ে আলাদা দর দিয়েছেন। এ কারণে কিছু লটের দর এনসিটিবির প্রাক্কলনের মধ্যেই আছে। কিছু লটের দাম ১২ শতাংশ পর্যন্ত বেশি পড়েছে। এভাবে ১৩০টি লটের দাম সিন্ডিকেট হয়ে বেশি পড়েছে। জানা গেছে, এনসিটিবি সাধারণত আগের বছরের চেয়ে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বেশি দরে কাজ দিতে পারে। এ অবস্থায় উল্লিখিত ১৩০ লটের টেন্ডার নিষ্পত্তি করতে না পারায় আবার টেন্ডার দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
এ ব্যাপারে এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, মাধ্যমিকের ৩২০ প্যাকেজের টেন্ডার এখনও মূল্যায়ন পর্বে আছে। তাই দরের ক্ষেত্রে কী ঘটেছে আমার জানা নেই। সেটা টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটি বলতে পারবে। যদি আপনি কিছু জেনে থাকেন সেটা অবৈধ হয়েছে। আর মুদ্রাকরদের যারা জেনেছে তারাও অবৈধভাবে জেনেছে। এখানে একটি দুষ্ট চক্র আছে। তারা (মুদ্রাকর) ওই চক্রের অংশ। আগামী বছরের জন্য সরকার ৩৬ কোটি ৬ লাখ বই ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।