এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : ‘বাবাতো (ইয়াবা) দূরের কথা, এখন গাঁজাও কিনতে পারবেন না। কেউ আপনার কাছে এখন মাল (মাদক) বিক্রি করবে না।’ রাজধানীর কড়াইল বস্তির বেলতলা এলাকায় রোববার সকালে একটি চায়ের দোকানে বসে কথাগুলো বলছিলেন ৩২ বছর বয়সী এক যুবক। প্রথমে মাদক পাওয়া যাবে না বললেও আলোচনার একপর্যায়ে বলেন, এখন অগ্রিম টাকা দিয়ে অর্ডার দিতে হয়। এক পিস বাবা (ইয়াবা) নিতে হলে ৬০০ (আগে সর্বোচ্চ ২০০ টাকায় পাওয়া যেত) টাকা লাগবে। এখন অর্ডার দিলে সন্ধ্যার পর পাবেন। এরপর মোবাইল ফোনে কারও সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন তিনি। পরে জানান, অপরিচিত ব্যক্তির কাছে আপাতত বিক্রি নিষেধ আছে।
পরিচয় গোপন করে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখন আর প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি হয় না। তবে সন্ধ্যা নামলেই কড়াইল বস্তি এলাকায় বহিরাগতদের আনাগোনা বাড়ে। তাদের অধিকাংশই ইয়াবার নিয়মিত ক্রেতা। ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশুরা মোবাইল ফোনে ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আড়ালে গিয়ে মাদক সরবরাহ করে।
ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ২৬ মে রাজধানীর অন্যতম মাদক স্পট কড়াইল বস্তিতে অভিযান চালানো হয়। এরপরও মাদক বিক্রি বন্ধ হয়নি। মাদকসেবীরা পরিচিত মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে খুব সহজেই মাদক সংগ্রহ করতে পারছেন। নানা কৌশলে মাদক ব্যবসায়ীরা বাহকের মাধ্যমে মাদকসেবীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছে মাদক। মাদক বহনে এখন নারী ও শিশুদের বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। মৌসুমি ফল আম ও শাড়ির ভেতরে ভরে নারী ও শিশুরা ইয়াবা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাচ্ছে। শুধু কড়াইল বস্তি নয়, রাজধানীর আরও তিনটি বড় মাদক স্পট মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প, তেজগাঁও রেললাইন বস্তি এবং পল্লবীর বিভিন্ন বিহারি ক্যাম্প ঘুরেও একই চিত্র দেখা গেছে। সাঁড়াশি অভিযানে মাদকের হোতারা ধরা না পড়ায় মাদক বিক্রিও বন্ধ হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ঢাকা মেট্রো অঞ্চলের উপপরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমার বক্তব্য হল- অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে মাদকচক্র নতুন কৌশলে তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কক্সবাজার ও টেকনাফ থেকে নানা কৌশলে ঢাকায় নিয়ে আসা হচ্ছে ইয়াবার চালান। বহনকারীদের শরীরে বিশেষ ডিভাইস বেঁধে দিয়ে আত্মগোপনে থেকে ওই ডিভাইসের মাধ্যমে বহনকারীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে মাদক ব্যবসায়ীরা। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে এমন সব কায়দায় ইয়াবার চালান বহন করা হয়, যা বহনকারীর জন্য মৃত্যুঝুঁকিও থাকে। বিশেষ করে শিশুদের পাকস্থলীতে করে ইয়াবা আনা হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, সোমবার বিকালে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে যাত্রাবাড়ী থানার ঢাকা-মাওয়া রোডের পাশে মেট্রো সিএনজি ড্রেন স্টেশনের ভেতরে নামাজের জায়গায় ইয়াবা ক্রয়- বিক্রয়ের সময় ২৮ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ কোরআনে হাফেজ শহিদুল্লাহসহ চারজনকে আটক করে ডিবি। শহিদুল্লাহর বাড়ি টেকনাফের সীমান্তবর্তী শাহপরীর দ্বীপে। মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এনে তারেক নামের একজনের মাধ্যমে ঢাকায় নিয়ে এসে বিভিন্ন মাদক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করত শহিদুল্লাহ। ২৭ মে দক্ষিণখান থেকে এক রোহিঙ্গা শিশু ও তার চাচা সেলিম মোল্যাসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। রোহিঙ্গা চাচা-ভাতিজার পেট থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট বের করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা বলেছে, এর আগেও একাধিকবার তারা ঢাকায় ইয়াবার চালান নিয়ে আসে। ৫০টি ইয়াবা স্কচটেপ দিয়ে পেঁচিয়ে ক্যাপসুলের মতো পোঁটলা করে তা পানি দিয়ে গিলে ফেলত তারা। সেলিম এ রকম ৭০টি পোঁটলা এবং শিশুটি ৩০টি পোঁটলা গিলে ফেলে। এরপর তারা ঢাকায় চলে আসত। রেজোয়ান নামে এক ইয়াবা ব্যবসায়ীর তিন সহযোগী তাদের পথ দেখিয়ে দিত। রেজওয়ান কক্সবাজারে বাসা ভাড়া করে থেকে স্থানীয় লোকজন এবং রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে ইয়াবা ঢাকায় পাঠায়। মামুন ঢাকায় ইয়াবার চালান বুঝে নেয়। টেকনাফ থেকে আসার পর বহনকারীদের বাসায় নিয়ে মিল্ক অব ম্যাগনেশিয়াম ওষুধ খাইয়ে পেট থেকে মলের সঙ্গে ইয়াবার পোঁটলা বের করা হতো। এভাবেই অনেক ব্যবসায়ী ইয়াবা পাচার করছে।
ইদানীং মাদক পাচারের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের ব্যবহার বেড়েছে। নারী ও শিশুর শরীরে বা পোশাকের ভেতরে, শরীরের গোপন স্থানে, রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স, মাছের পেটে, নারিকেলের ভেতরে, সবজির মধ্যে, গাড়ির সিটের নিচে, ইঞ্জিনের ভেতরে, লঞ্চ বা নৌকা-ট্রলারের গোপন স্থানসহ আরও নানা কৌশলে চলছে ইয়াবা পাচার।
অভিযানের পর মাদক ব্যবসায়ীরা ফিরেছে কড়াইল বস্তিতে : কড়াইল বস্তির কয়েকজন বাসিন্দা জানান, ২৬ মে রাত ৯টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত পুরো বস্তিতে সাঁড়াশি অভিযান চালায় পুলিশ। অভিযানের আগে রাত সাড়ে ৮টার দিকে অভিযানে অংশ নেয়া পুলিশ সদস্যদের একটি স্কুল মাঠে জড়ো করা হয়। সেখানে অভিযান সম্পর্কে পুলিশ সদস্যদের ব্রিফিং করেন গুলশান বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ফলে মাদক ব্যবসায়ীরা টের পেয়ে পালিয়ে যায়। অভিযানের পর কেউ কেউ বস্তিতে ফিরে এসে মাদক বিক্রি করছে।
বস্তির বেলতলা ব্রিজপাড় এলাকায় কথা হয় দেলোয়ার হোসেন নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি বলেন, সন্ধ্যার পর অনেক মাদক ব্যবসায়ী বস্তিতে ফিরে আসে। বিভিন্ন গলিতে তারা অবস্থান নিয়ে মাদক বিক্রি করে। এ বস্তির নিয়ন্ত্রণ তাসলি নামে এক নারী মাদক ব্যবসায়ীর হাতে। সে সাঁড়াশি অভিযানের আগে পালিয়ে যায়। এখন বাইরে থেকেই সে বস্তির মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে।
পুলিশের গুলশান জোনের সহকারী কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে আছি। তথ্য পেলেই অভিযান চলে। কড়াইল বস্তিতেও নিয়মিত অভিযান চলছে। মাদকের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট অনেকেই বস্তি ছেড়ে পালিয়েছে।
জেনেভো ক্যাম্পের মাদক ব্যবসায়ীরা আরও সতর্ক : তিন দিন আগে মোহাম্মদপুরে বিহারিদের সবচেয়ে বড় আবাসস্থল জেনেভা ক্যাম্পে ঘুরে জানা যায়, ২৬ মে র্যাবের বিশেষ অভিযানের পর প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি কমেছে। এখন মাদক বিক্রির ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা হচ্ছে। আগে অপরিচিত ব্যক্তি দেখলে মাদক কেনার ‘অফার’ দিত। কিন্তু এখন অপরিচিত ব্যক্তি দেখলেই মাদক ব্যবসায়ীরা সতর্ক হয়ে যায়। তবে মাদক বিক্রি বন্ধ নেই। বাবর রোড দিয়ে ক্যাম্পে ঢুকে একটি গলি পেরিয়ে দেখা গেল আনুমানিক ১৫ বছরের এক কিশোর এক ব্যক্তির কাছে গাঁজা বিক্রি করছে। কাছে গিয়ে বাবা (ইয়াবা) পাওয়া যাবে কিনা জানতে চাইলে সে জানায়, তার কাছে নেই। সংগ্রহ করে দেয়া যাবে কিনা জানতে চাইলে কোনো কথা না বলেই চলে যায় সে।
পুলিশের একজন সোর্স বলেন, এখন মাদক ব্যবসায়ীরা অনেক বেশি সতর্ক। তারা ক্রেতাদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে ক্যাম্পের বাইরে মাদক সরবরাহ করে। মাদক সরবরাহে এখন তারা অনেক বেশি সতর্ক।
ওই সোর্স আরও জানান, র্যাবের অভিযানের পর থেকেই ক্যাম্পে এক ধরনের আতঙ্ক রয়েছে। তবে ক্যাম্পের মাদকের নিয়ন্ত্রণকারীরা ধরা না পড়ায় মাদক ব্যবসা চলছেই। এখন মাদক কেনাবেচায় ঝুঁকি থাকায় মূল ব্যবসায়ীরা বিহারি শিশুদের দিয়ে ক্রেতার কাছে মাদক পৌঁছে দিচ্ছে। ক্যাম্পের মূল নিয়ন্ত্রক ইশতিয়াক বাইরে থেকেই ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকায় মাদক নিয়ন্ত্রণ করছে।
মো. জাহাঙ্গীর নামে একজন বিহারি বলেন, মাদক ব্যবসার সঙ্গে অনেক বিহারি নেতা জড়িত। তারা পুলিশকে ম্যানেজ করেই মাদক ব্যবসা করে। এ কারণে অভিযানের পরও ক্যাম্পে মাদক ব্যবসা চলছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাব-২ এর উপঅধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ আলী বলেন, জেনেভা ক্যাম্পটি অনেক বড় এবং অসংখ্য অলিগলি। এ কারণে সেখানে অভিযান চালানো সহজ নয়। আমাদের সাঁড়াশি অভিযানের পর সেখানে মাদক পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এখন খবর পাচ্ছি ভেতরে খুচরা বিক্রি হচ্ছে তবে সেটার পরিমাণ অনেক কম। আমরা স্পটটিতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছি। প্রয়োজন হলে আবারও অভিযান চালাব।
তেজগাঁও রেললাইন বস্তি ও পল্লবীর বিভিন্ন স্পটে মিলছে মাদক : গত সোমবার দুপুরে তেজগাঁও রেললাইন বস্তি এলাকায় ২ ঘণ্টা ঘুরে তিনজন নারী, একজন মধ্যবয়সী পুরুষ ও দুই কিশোরকে প্রকাশ্যেই গাঁজা বিক্রি করতে দেখা গেছে। এ সময় এই প্রতিবেদক আটজনকে গাঁজা কিনতে দেখেছেন। এ স্পটটিতে পুলিশ সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছিল ২৭ মে।
গাঁজা বিক্রেতা এক কিশোরের সঙ্গে পরিচয় গোপন করে কথা বলে জানা যায়, বস্তিতে গাঁজা সহজেই পাওয়া যায়। এক পুরিয়া গাঁজা সে বিক্রি করছে ৫০ টাকা করে। আগে এক পুরিয়া গাজা ৩০ টাকায় বিক্রি হতো।
ইয়াবা পাওয়া যাবে কিনা জানতে চাইলে সে বলে, ইয়াবার লোক আলাদা। সন্ধ্যার পর এলে ম্যানেজ করা যাবে। দাম কত পড়বে জানতে চাইলে সে জানায়, ৫০০ টাকার কম নয়।
হালিমা বেগম নামে এক নারী জানান, অভিযানের আগে অনেক মাদক ব্যবসায়ী বস্তি ছেড়ে পালিয়েছিল। এখন আবার তারা ফিরে এসে মাদক বিক্রি শুরু করেছে।
জানতে চাইলে তেজগাঁও থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম বলেন, রেললাইন বস্তিতে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স।
গত শনিবার পল্লবীর বিভিন্ন বিহারি ক্যাম্পে পুলিশ সাঁড়াশি অভিযান চালায়। অভিযানের পরদিন কয়েকটি ক্যাম্প ঘুরে দেখা যায় সেখানে মাদক বিক্রি বন্ধ হয়নি। অভিযানের আগেই মাদক ব্যবসায়ীরা খবর পেয়ে পালিয়ে যান। পরে আবার তারা স্পটে ফিরে মাদক বিক্রি করছে। ১১ নম্বরের তালতলায় কাল্লুর গাঁজার স্পট এবং খালার মদের স্পটে এখনও মাদক বিক্রি হয় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। ১০ নম্বর ঝুটপট্টিতে রাজীবের স্পট, কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পে মুকুলের স্পট ও বাউনিয়া বাঁধ এলাকায় হারুনের স্পট ও পাপিয়ার স্পটে মাদক বিক্রি হচ্ছে।
এ বিষয়ে পুলিশের পল্লবী জোনের সহকারী কমিশনার এবিএম জাকির হোসেন বলেন, আমরা তথ্য পাচ্ছি মাদক ব্যবসায়ীরা এখন ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় থেকে মাদক বিক্রি করছে। আম ও শাড়ির ভেতরে করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাচ্ছে মাদক। আমরা এ বিষয়ে সতর্ক আছি।