এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : আরিফুল হকের দারুণ শট হাওয়ায় ভেসে ছুটছিল সীমানার ওপারে। দুর্দান্ত ক্ষীপ্রতায় সেই বল মাটিতে নামালেন ফিল্ডার শফিকউল্লাহ। মাটিতে পড়ে আবার সীমানায় যেতে থাকা বলও ফেরালেন পরিমড়ি করে। চার নাকি চার নয়? তৃতীয় আম্পায়ারের রায়, বাউন্ডারি নয়। কেবল দুই রান। বাংলাদেশের হতাশার ষোলকলা তাতে পূর্ণ হলো। শেষ ম্যাচেও ধরা দিল না জয়। বাংলাদেশকে হোয়াইটওয়াশ করেই ছাড়ল আফগানিস্তান।
আগের দুই ম্যাচের চেয়ে লড়াই বেশি হলো এবার। রোমাঞ্চ ছড়াল। পেণ্ডুলামের মতো দুলল ম্যাচের ভাগ্য। তবে শেষের ফলে এলো না পরিবর্তন। ১ রানের জয়ে ৩-০ তে সিরিজ জিতে নিল আফগানিস্তান।
দেরাদুনে বৃহস্পতিবার দারুণ বোলিংয়ে আফগানদের ১৪৫ রানে আটকে রেখেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু নিজের পার হতে পারেনি শেষের বৈতরণী। শেষ বলের দুই রানে ইনিংস শেষ হয়েছে ১৪৪ রানে।
আগের দুই ম্যাচের মতো বাংলাদেশ এবারও হেরেছে রশিদকে হারাতে না পারায়। শেষ ৩ ওভারে প্রয়োজন ছিল ৩৩ রান। সেই সময়ে বোলিংয়ে এসে রশিদ দিলেন মাত্র ৩ রান।
২ ওভারে ৩০ রানের কঠিন সমীকরণ প্রায় মিলিয়ে ফেলেছিল বাংলাদেশ। ঠাণ্ডা মাথার অসাধারণ ব্যাটিংয়ে করিম জানাতকে টানা পাঁচ বলে বাউন্ডারি মারেন মুশফিক। শেষ বলের সিঙ্গেলে ধরে রাখেন স্ট্রাইক।
শেষ ওভারে প্রয়োজন ৯ রান। এমনিতে টি-টোয়েন্টিতে বেশ সহজ, প্রতিপক্ষ বোলারের নাম রশিদ খান হলে বেশ কঠিন। সেটিই প্রমাণ হলো। প্রথম বলেই উড়িয়ে মারতে গিয়ে আউট মুশফিক।
পরের চার বলে একটি দুই, তিনটি সিঙ্গেল। শেষ বলে প্রয়োজন চার। স্ট্রাইকে নতুন ব্যাটসম্যান আরিফুল। রশিদের গুগলিকে উড়িয়ে মারলেন সোজা। সীমানায় শফিকের বীরোচিত ফিল্ডিং। কয়েকবার রিপ্লে দেখে তৃতীয় আম্পায়ার রায়ে উচ্ছ্বাসে ভাসল আফগানিস্তান।
তৃতীয় আম্পায়ার আরেকটু জুম করে, আরও কাছ থেকে মুহূর্তটি দেখতে পারতেন কিনা, সেই প্রশ্ন থাকল। তবে আফগানদের জয় যোগ্য দল হিসেবেই।
বাংলাদেশের রান তাড়ার শুরুটা আবারও ছিল যাচ্ছেতাই। দেশের সফলতম ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল ব্যর্থ সিরিজের তৃতীয়বারের মতো। প্রথম ম্যাচের মতোই ফিরেছেন মুজিব উর রহমানের বলে।
লিটন দাস ডানা মেলতে পারেননি। তিনে নেমে সৌম্য সরকার ধুঁকছিলেন শুরুতে। তবে মুজিবকে দারণ এক সুইচ হিটে ছক্কায় ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ভালো কিছুর।
এরপরই আত্নহত্যার কয়েক মিনিট। নবির এক ওভারে প্রায় একইভাবে রান আউট লিটন ও সৌম্য।
শুরুতে শর্ট ফাইন লেগে খেলেছিলেন লিটন, নন স্ট্রাইক থেকে অনেকটা দৌড়ে গিয়ে লিটনের সাড়া না পেয়ে মাঝ উইকেট থেকে ফেরার চেষ্টায় রান আউট সৌম্য। দুই বল পর, মুশফিক খেললেন শর্ট ফাইন লেগে। এবার নন স্ট্রাইক থেকে ছুটে আবার ফেরার চেষ্টায় রান আউট লিটন।
৩৫ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে তখন আবারও দিশাহারা বাংলাদেশ। দিশা দেখাতে পারেননি অধিনায়কও। জানাতকে দারুণ এক ছক্কার পর সাকিব আউট সেই ওভারেই। ১০ রানে তাকে থামিয়েছে এক্সট্রা কাভারে সামিউল্লাহ শেনওয়ারির চোখধাঁধানো ডাইভিং ক্যাচ।
সেখান থেকে মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহর সংগ্রাম শুরু। উইকেটের স্রোত ঠেকাতে সংযমী হন দুজন। তাতে রানের গতিতেও বাধ আসে।
মাঝে টুকটাক চার-ছক্কায় ম্যাচে টিকে থাকে দল। শেষ ৫ ওভারে প্রয়োজন ছিল ৫৫। কিন্তু রশিদের ৩ ওভার তখনও বাকি। তার প্রথমটিতে এলো কেবল ৭ রান।
পরের ওভরে আফতাব আলমের ওভারে মাহমুদউল্লাহর চার ও ছক্কায় এসেছিল ১৫ রান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রশিদই গড়ে দিলেন পার্থক্য। মাহমুদউল্লাহর ৩৮ বলে ৪৫, ৩৭ বলে ৪৬ রান করে ম্যাচ সেরা মুশফিক কিংবা দুজনের ৮৪ রানের জুটি, সব কিছুর শেষ হতাশায়।
শেষের মতো আফগানদের শুরুটাও ছিল দারুণ। সিরিজে প্রথমবা সুযোগ পাওয়া মেহেদী হাসান মিরাজকে ম্যাচের প্রথম ওভারে বোলিংয়ে এনেছিলেন অধিনায়ক। মোহাম্মদ শাহজাদ এই অফ স্পিনারকে স্বাগত জানিয়েছেন ১৮ রানের ওভারে। টি-টোয়েন্টিতে যা বাংলাদেশের সবচেয়ে খরুচে প্রথম ওভার।
অন্য বোলাররা সেই ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। পরের ৪ ওভার মিলিয়ে রান এসেছে ১৭। তবে ওই প্রথম ওভারের কারণেই রান তোলার চাপ খুব বেশি ছিল না আফগানদের। সেই সুযোগে শাহজাদ ও উসমান গনি গড়েন আরেকটি ভালো জুটি।
প্রথম ম্যাচের মতো এদিনও দুজনের জুটি পেরিয়ে যায় পঞ্চাশ। ৫৪ রানের উদ্বোধনী এই জুটির ভাঙন বাংলাদেশ উপহার পায় আম্পায়ারের কাছ থেকে। নাজমুল ইসলামের বল রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে লেগেছিল শাহজাদের গ্লাভসে। ২২ বলে ২৬ রান করা ব্যাটসম্যানকে এলবিডব্লিউ দেন আম্পায়ার।
পরের ওভারেই মেলে আরেকটি উইকেট। উসমান গনি (২৬ বলে ১৯) আবারও আউট শর্ট বলে, বোলার এবার একাদশে ফেরা আবু জায়েদ।
চেপে বসা ফাঁস আফগানরা আবার আলগা করে মিরাজকে পেয়ে। দ্বিতীয় স্পেলে মিরাজকে ছক্কায় আমন্ত্রণ জানান আসগর স্টানিকজাই। আফগান অধিনায়ক পরের ওভারে ছক্কায় ওড়ান আবু জায়েদকে।
ছক্কার স্রোত বয়ে চলে পরের ওভারেও। সিরিজে প্রথম মাঠে নামা আরিফুল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের প্রথম ওভারে হজম করেন দুটি ছক্কা। ওই ওভারেই একটু স্বস্তি। ১৭ বলে ২৭ করে স্টানিকজাই আরিফুলকে উপহার দেন প্রথম আন্তর্জাতিক উইকেট।
আফগানদের আগের ম্যাচের নায়ক মোহাম্মদ নবিকে এদিন ঝড় তোলার আগেই থামান আবু জায়েদ।
নিজের প্রথম ৩ ওভারে মাত্র ১৬ রান দিলেও শেষ ওভারে নাজিবুল্লাহ জাদরানের ব্যাটে চার-ছক্কায় আবু জায়েদ দেন ১২ রান। পরের ওভরে আবু হায়দারের বলেও সামিউল্লাহ শেনওয়ারি মারেন চার ও ছক্কা।
শেষের ওভারগুলোয় তখন আবারও খেই হারানোর পথে বাংলাদেশের বোলিং। কিন্তু শেষ দুই ওভারে দুর্দান্ত বোলিং করেন সাকিব ও নাজমুল।
টানা দ্বিতীয় ম্যাচে দুর্দান্ত বোলিং করেছেন নাজমুল। ৪ ওভারে মাত্র ১৮ রানে নেন দুই উইকেট। ১৬ রানে একটি উইকেট সাকিবের। শেষ পর্যন্ত তাই আর দেড়শ করতে পারেনি আফগানিস্তান।
কিন্তু বোলিং আক্রমণে যদি থাকে রশিদ, প্রতিপক্ষের জন্য সব স্কোরই যেন পাহাড় সমান! নাগিন নাচ আর পুরো মাঠ প্রদক্ষিণ করে আফগানরা করল হোয়াইটওয়াশের উৎসব।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
আফগানিস্তান: ২০ ওভারে ১৪৫/৬ (শাহজাদ ২৬, গনি ১৯, স্টানিকজাই ২৭, শেনওয়ারি ৩৩*, নবি ৩, নাজিবুল্লাহ ৪, রশিদ ১*; মিরাজ ০/২৭, নাজমুল ২/১৮, সাকিব ১/১৬, আবু হায়দার ০/৩১, সৌম্য ০/৮, আবু জায়েদ ২/২৭, আরিফুল ১/১৩)
বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১৪৪/৬ (লিটন ১২, তামিম ৫, সৌম্য ১৫, মুশফিক ৪৬, সাকিব ১০, মাহমুদউল্লাহ ৪৫, আরিফুল ৫*; মুজিব ১/২৫, আফতাব ০/২৮, নবি ০/২০, করিম ১/৪৪, রশিদ ১/২৪)।
ফল: আফগানিস্তান ১ রানে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: মুশফিকুর রহিম
ম্যান অব দা সিরিজ: রশিদ খান