এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : চীনের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উইঘুরের প্রখ্যাত আলেম মোহাম্মদ সালিহ হাজিম (৮২) দেশটির একটি রাজনৈতিক মতদীক্ষাদান ক্যাম্পে নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন। ওয়ার্ল্ড উইঘুর কংগ্রেস (ডব্লিউইউসি) গত বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানিয়েছে।
সালিহকে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
ডব্লিউইউসি জানায়, উইঘুর ভাষায় পবিত্র কুরআনের অনুবাদক সালিহ সম্ভবত ওই ক্যাম্পে অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন এবং যথাযথ চিকিৎসা পাননি। উইঘুর মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিশেষ করে তাদের ধর্মের স্বাধীনতার অধিকারের ইস্যুতে চীনা কর্তৃপক্ষের ব্যাপক ধরপাকড়ের মধ্যেই সালিহ হাজিমের এ মৃত্যু সংবাদটি আসে।
সম্প্রতি পূর্ব তুর্কিস্তানে লাখ লাখ উইঘুর মুসলমানকে আটক করে তাদেরকে ‘পুনঃদীক্ষা’ কেন্দ্রে পাঠানো হয়। অনেকেই মনে করে চীনের জিনজিয়াং উইঘুরদের স্বায়ত্তশাসিত এলাকা। এখানে তার্কিক উইঘুর ছাড়াও আরো অনেক নৃ-গোষ্ঠীর অবস্থান রয়েছে। তারা এ অঞ্চলকে মধ্য এশিয়ার অংশ হিসেবে মনে করে, চীনের নয়।
উল্লেখ্য, চীনের জিনজিয়াংয়ে তার্কিক গ্রুপের লোকসংখ্যা প্রায় ৪৫ শতাংশ। তারা দাবি করছে, চীন কর্তৃপক্ষ তাদের উপর বেশ কিছু নিয়মনীতি আরোপ করে তাদের ধর্ম, বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক ক্রিড়াকর্মকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে।
সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মতো এবার দেশের সব মসজিদে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের নির্দেশ দিয়েছে চীনা কর্তৃপক্ষ। ‘দেশপ্রেমের চেতনা সমুন্নত’ করতে দেশের প্রতিটি মসজিদে প্রতিদিন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে হবে বলে আদেশ জারি করেছে দেশটির ইসলামবিষয়ক শীর্ষ তদারকি সংস্থা।
উল্লেখ্য, চায়না ইসলামিক অ্যাসোসিয়েশন একটি সরকার অনুমোদিত সংস্থা এবং দেশটিতে ইমামদের স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে একমাত্র তাদেরই। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টিকে ইসলাম ধর্মের ওপর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে।
গত শনিবার নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক ঘোষণায় চায়না ইসলামিক অ্যাসোসিয়েশন নামক একটি সরকারি সংস্থা মসজিদ প্রাঙ্গণে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের নির্দেশ দেয়। মসজিদ প্রাঙ্গণের ‘প্রধান জায়গায়’ পতাকা উত্তোলন করতে হবে বলে সংস্থাটি ঘোষণা করেছে।
ওয়েবসাইটে দেয়া ঘোষণায় আরো বলা হয়, ‘এর (জাতীয় পতাকা উত্তোলন) মাধ্যমে জাতীয় ও নাগরিক আদর্শ আরো সুদৃঢ় হবে এবং মুসলমানদের দেশপ্রেমের চেতনা সমুন্নত হবে। পতাকা উত্তোলনের পাশাপাশি মসজিদগুলোকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ‘মৌলিক সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ’ প্রকাশ্যে প্রদর্শন করতে হবে এবং এগুলোকে ইসলামি গ্রন্থগুলোর মাধ্যমে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদেরকে ব্যাখ্যাসহ বুঝিয়ে বলতে হবে যেন মূল্যবোধগুলো তাদের অন্তরে গেঁথে যায়।’
গত ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ম পালন করার বিষয়ে বিভিন্ন সীমারেখা টেনে দিয়ে চীনের নতুন সংশোধিত আইন পাস করা হয়। সেই আইনের অধীনেই দেশটির মসজিদগুলোতে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের আদেশ জারি করা হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে পাস হওয়া সংশোধিত আইনের কঠোর সমালোচনা করে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলেছে, নতুন এই আইনের মাধ্যমে দেশটির নাগরিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হবে।
চীনে ধর্মের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে প্রণীত নতুন এই আইন পবিত্র রমজান মাসে রোজা পালনের মতো সরকারিভাবে নিষিদ্ধ ধর্মীয় ইবাদত পালনের জন্য শাস্তি বাড়ানো এবং এটা ‘ধর্মীয় চরমপন্থা মোকাবেলায়’ নজরদারি বাড়াতে প্রয়োগ করা হবে বলে জানানো হয়েছে। মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমসহ সংশ্লিষ্ট অন্য কর্মচারীদের নতুন ধর্মীয় আইনসহ চীনের সংবিধান পড়তে হবে বলে ঘোষণায় উল্লেখ করেছে চায়না ইসলামিক অ্যাসোসিয়েশন। তা ছাড়া মসজিদ সংশ্লিষ্ট সবার চীনা সাহিত্য ও ঐতিহ্যবাহী চীনা সংস্কৃতির ওপর পড়াশোনা করতে এবং বিদেশী মুসলিম আলেমদের দিকে নজর না দিয়ে চীনের মুসলিম পণ্ডিতদের দিকে মনোযোগী হতে পরামর্শ দেয়া হয়।
পাশাপাশি সংস্থাটির ঘোষণায় আরো বলা হয়,‘ইবাদত করার জায়গা ছাড়াও মসজিদের আরো একটি দায়িত্ব হচ্ছে এটি কমিউনিস্ট পার্টি এবং দেশের আইন ও নীতি আদর্শ নিয়ে গবেষণা করার শক্ত প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে এবং এর মাধ্যমেই চীনের সংখ্যাগরিষ্ঠ হান জনগোষ্ঠীর সাথে পারস্পারিক স্বার্থের ভিত্তিতে মুসলমানেরা অভিন্ন চীনা পরিচয় লালন করবে।’
চীনে বর্তমানে প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ মুসলিম নাগরিক রয়েছে। দেশটিতে এত বিশাল সংখ্যক মুসলিম বসবাস করা সত্ত্বেও তাদের ওপর ধর্মীয় বিধিনিষেধ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। বিশেষ করে চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মুসলিম উইঘুর সম্প্রদায়ের আবাসস্থল জিনজিয়াং প্রদেশে মুসলমানদের দাড়ি রাখা ও প্রকাশ্যে নামাজ আদায় করা নিষিদ্ধ। এখানকার লাখ লাখ উইঘুর মুসলিমকে কোন অপরাধ ছাড়াই কেবল ধর্ম পালন করায় আটক করে মগজ ধোলাই এবং শূকরের মাংস ও মদ পান করানোর মতো ইসলাম পরিপন্থী কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
চীনা কর্তৃপক্ষের মতে, ‘ইসলামি চরমপন্থা ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ’ করতেই জিনজিয়াং প্রদেশে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পুলিশ মোতায়েন ও ইসলাম ধর্ম পালনে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে; কিন্তু এই অঞ্চলটি ক্রমেই একটি বিশাল উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত হচ্ছে বলে বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন।