এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : ধারাবাহিকভাবে ৭ শতাংশের ওপর জিডিপি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে দেশে। আগামী অর্থবছরও প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে উন্নীতের পরিকল্পনা নিচ্ছে সরকার। যদিও কৃষক থাকছে অবহেলিতই। কৃষির অন্যতম উপখাত শস্যে প্রবৃদ্ধি তিন অর্থবছর ধরেই ১ শতাংশের নিচে রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নত উপকরণ, প্রযুক্তি ও উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না কৃষক। কৃষিপণ্যের বিপণন ও বাণিজ্যনীতিও কৃষকের পুরোপুরি অনুকূলে নয়। এসব কারণে প্রবৃদ্ধিতে পিছিয়ে থাকছে কৃষি।
বিবিএসের তথ্যমতে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে শস্য ও সবজিতে ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও পরের অর্থবছর তা ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশে নেমে আসে। এরপর ২০১১-১২ অর্থবছরে ১ দশমিক ৭৫, ২০১২-১৩ অর্থবছর শূন্য দশমিক ৫৯, ২০১৩-১৪ অর্থবছর ৩ দশমিক ৭৮, ২০১৪-১৫ অর্থবছর ১ দশমিক ৮৩, ২০১৫-১৬ অর্থবছর শূন্য দশমিক ৮৮, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে শূন্য দশমিক ৯৬ শতাংশে নেমে আসে প্রবৃদ্ধি। চলতি অর্থবছরও এ খাতে শূন্য দশমিক ৯৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৮-এর তথ্য বলছে, এবারো সবচেয়ে খারাপ প্রবৃদ্ধি থাকবে শস্যে।
সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক এ বিষয়ে বলেন, কৃষিতে নানাবিধ সংকট যেমন আছে, তেমনি আছে অবারিত সম্ভাবনা। ক্ষুদ্র আয়তনের জমি, উন্নত বীজ ও প্রযুক্তির অভাব মোকাবেলা করেই কৃষককে এগিয়ে নিতে হবে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিও মোকাবেলা করতে হবে। এজন্য গবেষণা ও সম্প্রসারণে জোর দিতে হবে। সেটি করতে উন্নয়ন পরিকল্পনায় কৃষককে আরো বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা দেশের উর্বর মাটি আর জনগণের চাহিদা থাকায় বড় বাজার রয়েছে।
প্রবৃদ্ধির পথে কৃষকের পিছিয়ে থাকার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে বীজের সংকট। জানা গেছে, দেশে প্রতি বছর সব ধরনের ফসলের জন্য বীজের চাহিদা ১১ লাখ ৫০ হাজার টন। এর মধ্যে আলুবীজের চাহিদা প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টন ও ধানবীজের প্রায় সাড়ে তিন লাখ টন। সার্বিক বীজের বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বীজের সরবরাহ খুব কম। সরকারি ও বেসরকারি খাতের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বীজ সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র ৬ লাখ ১০ হাজার টন, যা চাহিদার মাত্র ৫৩ শতাংশ। আর সরবরাহকৃত প্রাতিষ্ঠানিক বীজের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ বীজ মানহীন ও নিম্নমানের। বীজের চাহিদার এখনো প্রায় ৪৭ শতাংশ বা সাড়ে পাঁচ লাখ টন অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে সরবরাহ হচ্ছে, যেসব বীজের নেই কোনো মান কিংবা সনদ। তবে সেগুলোর উৎপাদনশীলতা কী পর্যায়ে আছে, সেটি গবেষণার দাবি রাখে।
এসিআই লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. ফা হ আনসারী এ বিষয়ে বলেন, ২০৫০ সালের মধ্যে কৃষিজমি আরো কমবে। কিন্তু এ সময়ে ৩০ শতাংশ বেশি খাদ্যশস্যের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে। এ অবস্থায় কম জমিতে অধিক ফসল ফলাতে হবে কৃষকদের। আর সে ফসল উৎপাদনে ভালোমানের বীজ সরবরাহের কোনো বিকল্প নেই। কৃষকদের কাছে উন্নতমানের বীজ সরবরাহ করা গেলে প্রতি বছর বাড়তি সবজিসহ খাদ্যশস্য উৎপাদন করা সম্ভব।
প্রবৃদ্ধির পথচলায় কৃষকের পশ্চাত্পদতার আরেকটি কারণ হলো, কৃষিতে দেয়া ভর্তুকির যথাযথ ব্যবহার না হওয়া। চলতি অর্থবছরের মতো আগামী অর্থবছরও কৃষিতে ভর্তুকির জন্য ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। যদিও ভর্তুকির টাকার পুরোটাই খরচ করতে পারে না কৃষি মন্ত্রণালয়। এ কারণে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে কৃষিতে ভর্তুকি ৬ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।
গত কয়েক বছর শস্যের দাম যে হারে বাড়ছে, উৎপাদন খরচ বাড়ছে তার চেয়েও দ্রুতগতিতে। বাণিজ্য পরিস্থিতিও কৃষকের অনুকূলে যাচ্ছে না। গত বছর বন্যার কারণে চালের মজুদ কমে যাওয়ায় সরকারকে এক ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু চলতি বছর ধানের বাম্পার ফলন হলেও সঠিক সময়ে তা সংগ্রহ করছে না সরকার। ফলে কৃষক এবারো ধানের দাম পাচ্ছেন না। তবে দেরিতে হলেও আগামী বাজেটে চাল আমদানির ওপর শুল্ক ২৮ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. আসাদুজ্জামান বলেন, চাল আমদানিতে শুল্কারোপটা মার্চে করতে পারলে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা লাভবান হতে পারতেন। এখন বড় কৃষক হয়তো সামান্য কিছু সুবিধা পাবেন। কৃষকরা একদিকে যেমন দাম পাচ্ছেন না, তেমনি ভর্তুকির অর্থের যথাযথ ব্যবহার না হওয়ার কারণে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে পারছেন না তারা। এজন্য অর্থসহায়তার সিংহভাগই বাজার ব্যবস্থাপনা ও সাধারণ কৃষকের উন্নয়নে ব্যয় করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।