এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : চার দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজনীতির ময়দানে থেকে নানা উত্থান-পতন দেখছেন নওয়াজ শরিফ। এর আগেও দণ্ডিত হয়েছেন, প্রবাস জীবন কাটিয়েছেন। কিন্তু বারবার তিনি ফিরে এসেছেন জনগণের কাছে। জনগণও তাঁকে বিমুখ করেনি। তিন-তিনবার তাঁকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করেছে। তার আগে পাঞ্জাবের জনগণ তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসিয়েছে।
তবে এবার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। আদালতের রায়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেওয়ার প্রায় এক বছরের মাথায় দুর্নীতির দায়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে নওয়াজের (৬৮)। এর আগে আদালত তাঁকে ‘রাষ্ট্রীয় যে কোনো পদে অযোগ্য’ ঘোষণা করায় নিজের দলের প্রধানের পদও ছাড়তে হয়েছে। জনগণের কাছে ফিরতে নওয়াজের মূল শক্তি হলো তাঁর দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ (এন)। সেই দলের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকতে না পারায় আবারও জনগণের কাছে ফিরে যাওয়া তাঁর জন্য আসলেই কঠিন।
এই মুহূর্তে লন্ডনে চিকিৎসাধীন স্ত্রী কুলসুম নওয়াজের পাশে থাকতে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে সেখানেই অবস্থান করছেন নওয়াজ। এই রায়কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাবি করে ১৩ জুলাই দেশে ফেরার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। দশ দিনের মধ্যে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে হবে নওয়াজকে। কিন্তু দেশে ফিরলেই সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তাঁর। আর গ্রেপ্তার হলে আসন্ন ২৫ জুলাইয়ের সাধারণ নির্বাচনের জন্য দলীয় কৌশলে সেভাবে কোনো ভূমিকাও রাখতে পারবেন না তিনি। আর দল ক্ষমতায় না এলে কিংবা ক্ষমতার অংশীদার হতে না পারলে নওয়াজের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হবে—সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক রসুল বখশ রেইসের মতে নওয়াজ এই মুহূর্তে ‘কঠিন পরিস্থিতির’ মুখে রয়েছেন। এটা তাঁর জন্য উভয়সংকটের মতো। রসুল বখশ বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, নওয়াজ দেশে না ফিরলে তাঁর দল শেষ হয়ে যাবে। আর ফিরলে তাঁকে গ্রেপ্তার হতে হবে, আইনি লড়াই চালাতে হবে। আর এই লড়াইয়ে তাঁকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মুখে পড়তে হবে।
নওয়াজের রাজনৈতিক জীবন আক্ষরিক অর্থেই উত্থান-পতনের। সত্তরের দশকে রাজনীতি শুরু করা নওয়াজ ১৯৭৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান মুসলিম লিগে যোগ দেন। নয় বছরের মাথায় দলটির শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন তিনি। তবে বলা হয়ে থাকে, আশির দশকে পাকিস্তানের সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউল হক মূলত নিজের প্রয়োজনে রাজনীতিক নওয়াজকে কাছে টেনে নেন। জেনারেল জিয়া ওই সময় পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেত্রী বেনজির ভুট্টোকে ঠেকানোর জন্য রাজনৈতিক অস্ত্র খুঁজছিলেন। সেই অস্ত্র হয়ে উঠেছিলেন নওয়াজ। যার ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনীর কাছের রাজনীতিক বনে যান তিনি। সেনাবাহিনীর আশীর্বাদ আর নিজের ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব দিয়ে ১৯৯০ সালে প্রথমবারের মতো দেশটির প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন নওয়াজ। তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তিন বছরের মাথায় দুর্নীতির অভিযোগে পদচ্যুত হন তিনি। মুসলিম লিগ ঐতিহাসিকভাবেই সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সখ্য রাখা দল হলেও নিজের অংশকে (পিএমএল-এন) নওয়াজ জনগণের দলে পরিণত করতে পেরেছেন। তিন-তিনবার জনগণের ভোটে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি সেটাই প্রমাণ করে। এ কারণেই নওয়াজ সেনাবাহিনীর প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। সেটা হয়তো ভালোভাবে নেয়নি পাকিস্তানের রাজনীতির সবচেয়ে বড় খেলোয়াড় সেনাবাহিনী। আর জনপ্রিয় কোনো রাজনৈতিক দলকে দিয়ে সেনাবাহিনী নিজের অভিপ্রায় পুরোপুরি পূরণও করতে পারে না। নওয়াজের সমর্থকেরা মনে করেন, এবার নওয়াজকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করতে আটঘাঁট বেঁধে মাঠে নেমেছে তাঁর বিরোধীরা।
এ জন্য প্রথমে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে সরানো, তারপর ‘রাষ্ট্রীয় যে কোনো পদে অযোগ্য’ ঘোষণা ও দলীয় প্রধানের পদ থেকেও সরানো; সর্বশেষ দুর্নীতির দায়ে ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে নওয়াজকে। যদিও এমন কারাদণ্ডাদেশ নতুন নয় নওয়াজের জন্য। ১৯৯৭ সালে সালে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে ১৯৯৯ সালে সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারান নওয়াজ। শুধু তাই নয়, ২০০০ সালে সন্ত্রাস-দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে আদালত তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন। পরে সেনাশাসক পারভেজ মোশাররফের সঙ্গে বোঝাপাড়ায় নওয়াজ সৌদি আরবে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যান। তখনো মনে করা হয়েছিল, নওয়াজের রাজনৈতিক জীবনের বোধ হয় অবসান হলো। কিন্তু আবারও দেশে ফেরেন নওয়াজ। ২০০৭ সালে দেশে ফিরে রাজনীতির মাঠ চষে বেড়ানো শুরু করেন। ২০১৩ সালে আবারও জনগণের ভোটে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
তবে মনে হচ্ছে, এবার নওয়াজ তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের কঠিনতর পরিস্থিতির মুখে। কাগজ-কলমে তিনি নিজের দল পিএমএলের (এন) কেউ নন। দলের প্রধান এখন ছোট ভাই শাহবাজ শরিফ। শাহবাজ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বড় ভাইয়ের মতো ক্যারিশম্যাটিকও নন, কুশলীও নন। যেটা দলকে খুব ভোগাবে। এ ছাড়া তাঁর দলকে ভাঙার চেষ্টাও চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দলের সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি পাঞ্জাবেই অনেক নেতাকে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার লোকজন ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। পাঞ্জাবের বাইরে দলের অবস্থা ইতিমধ্যে আরও নাজুক হয়ে পড়েছে। আর নওয়াজ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন সম্ভবত তাঁর ভাই শাহবাজের কাছ থেকেই। প্রচারণা রয়েছে, শাহবাজ দলের নিয়ন্ত্রণ এককভাবে নিজের হাতে নিতে চান। আর দলের পরবর্তী কান্ডারি হিসেবে নিজের ছেলে হামজা শরিফকে তৈরি করছেন। কিন্তু নওয়াজ তাঁর মেয়ে মরিয়মকে নিজের উত্তরসূরি করার পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে দুটি আসনে প্রার্থীও হয়েছেন মরিয়ম। কিন্তু গত শুক্রবারের রায়ে বাবার সঙ্গে মরিয়মকেও সাত বছরের কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। তাই শুরুতেই সংকটের মুখে মরিয়মের রাজনৈতিক জীবন।
নওয়াজের বিরুদ্ধে ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশের রায় ঘোষণা হওয়ার পর মুলতানে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন তাঁর সমর্থকেরা। এএফপির ফাইল ছবি
নওয়াজের বিরুদ্ধে ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশের রায় ঘোষণা হওয়ার পর মুলতানে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন তাঁর সমর্থকেরা। এএফপির ফাইল ছবি
তবে সব কথার শেষ কথা হলো দেশটি পাকিস্তান। যে নওয়াজ সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন, সেই নওয়াজও সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়েছেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পেয়ে স্বেচ্ছা নির্বাচনে প্রবাসী হয়েছিলেন যিনি, তিনিই দেশে ফিরে আবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তাই নওয়াজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এখানেই শেষ—এমনটা বলা আসলেই কঠিন।
লেখক : মাহফুজার রহমান