এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসতেই ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে বাড়তে শুরু করেছে টানাপোড়েন। চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলাতে গিয়ে তাদের মধ্যে দূরত্ব বেড়েই চলেছে। সর্বশেষ সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী রাখার ব্যাপারে জামায়াত অনড় থাকায় এ টানাপোড়েন অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের আসন ভাগাভাগি নিয়ে এ টানাপোড়েন আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অর্ধশতাধিক আসনের একটি তালিকা করছে জামায়াত। আনুষ্ঠানিকভাবে সেই তালিকা বিএনপির হাইকমান্ডের কাছে উপস্থাপন করা হবে।
বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, জামায়াতের একটি অংশের কার্যক্রমের ওপর অনেক আগে থেকেই আমরা নজর রাখছি। তাদের কর্মকাণ্ডকে সন্দেহের চোখে দেখছি। দলের হাইকমান্ডও বিষয়টি অবহিত। তবে এ মুহূর্তে রাজনৈতিক নানা হিসাব-নিকাশ করেই কোনো কৈফিয়ত চাওয়া হচ্ছে না।
তবে বারবার আহ্বান জানানোর পরও মেয়র পদে সিলেটে প্রার্থিতা এখন পর্যন্ত প্রত্যাহার না করায় বিএনপির পাশাপাশি জোটের শরিকরাও জামায়াতের ওপর ক্ষুব্ধ। যে মুহূর্তে বৃহত্তর ঐক্যের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, সেই মুহূর্তে জামায়াতের এমন কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা। জামায়াতের এমন কর্মকাণ্ডের দুটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে মনে করছেন বিএনপির নেতারা।
প্রথমত, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে মেয়র প্রার্থী দেয়া জামায়াতের একটি কৌশল হতে পারে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আসন ভাগাভাগি প্রশ্নে দরকষাকষির সুযোগ করে দিতেই তারা এমন কৌশল নিয়েছে। অথবা জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটির একটি অংশ সরকারের সঙ্গে গোপন আঁতাত করছে। বিএনপিকে বাদ দিয়ে বর্তমান সরকারের অধীনে ওই অংশটি নির্বাচনে যেতে পারে বলেও শঙ্কা তাদের।
তবে জামায়াতের এমন ভূমিকা নিয়ে চিন্তিত নন বিএনপির কট্টরপন্থীরা। তারা মনে করেন, বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে জামায়াত যদি জোট ছেড়ে চলে যেতে চায়, তাহলে সেটি দলের জন্য মঙ্গলই হবে।
কারণ, স্বাধীনতাবিরোধী এ দলটির কারণেই বারবার বৃহত্তর ঐক্যের উদ্যোগ নিয়েও তা সফল হওয়া যাচ্ছে না। জামায়াতের কারণে প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেক দল ও শক্তি বিএনপিকে সমর্থন দিতে অনীহা জানিয়ে আসছে। তাই স্বাধীনতাবিরোধী এ দলটি জোট ছেড়ে চলে যেতে চাইলে তাদের ধরে রাখার পক্ষে এ অংশটি।
কিন্তু দলটির উদারপন্থীরা এ মুহূর্তে জামায়াতের সঙ্গে বড় ধরনের টানাপোড়েনের পক্ষে নন। তারা মনে করেন, বিএনপি জোট থেকে ইসলামী দলগুলোকে আলাদা করতে সরকার নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে। জামায়াতকে জোট থেকে আলাদা করতে পারলে সরকার এ দলটিকেই আবার বিএনপির বিপক্ষে দাঁড় করাতে পারে।
তাই আগামী নির্বাচন পর্যন্ত জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখার পক্ষে তারা। জোটের সমন্বয়ক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান যুগান্তরকে বলেন, আমরা এখনও আশাবাদী জামায়াত সিলেট থেকে তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করবে। এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা চলছে। এ নিয়ে দলটির সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করনে না তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার হয়তো জামায়াত নিয়ে নানা খেলা খেলতে চাইছে। তাদেরকে আলাদাভাবে নির্বাচন করার নানা প্রস্তাব দিতে পারে। কিন্তু দলটির একটি অংশ যদি এমন সমঝোতা করে তাহলে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা তা মেনে নেবে বলে মনে হয় না। কারণ, তারা নানাভাবে নির্যাতিত।
নজরুল ইসলাম বলেন, এ মুহূর্তে জাতীয় নির্বাচনের আসন ভাগাভাগি নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি। আমরা এ ব্যাপারে চিন্তাও করছি না। চেয়ারপারসনের মুক্তি এবং নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠাই আমাদের মূল লক্ষ্য। এরপর আসন ভাগাভাগির প্রশ্ন আসবে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, প্রত্যেকটি দলের নিজস্ব কিছু চাওয়া-পাওয়া থাকে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে জামায়াত হয়তো সিলেটে তাদের প্রার্থী দিয়েছে। তবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান করা হবে।
জামায়াতের প্রার্থী সিলেট মহানগর আমীর এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের কোনো সম্ভাবনা নেই। কেন্দ্রের অনুমতি সাপেক্ষেই মেয়র পদে মনোনয়নপত্র নিয়েছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা সিলেটে আগে থেকেই মেয়র পদে নির্বাচনের কথা বলেছি।
জুবায়ের বলেন, মেয়র পদে নির্বাচন করায় জোটের মধ্যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হবে বলে মনে করি না। কারণ, জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে জোট হয়েছে। স্থানীয় সরকারের সঙ্গে জোটের কোনো সম্পর্ক নেই। এর আগেও আমরা আলাদাভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছি।
এদিকে সিলেট সিটি কর্পোরেশনে জামায়াতের প্রার্থী দেয়ার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়েছে ২০ দলীয় জোটের শরিকরা। তাদের মতে, অতীতে স্থানীয় নির্বাচনেও জোটগতভাবেই প্রার্থী দেয়া হয়েছে। জোটের বৈঠকেও এভাবে প্রার্থী দেয়ার সিদ্ধান্ত আছে। কিন্তু জোটের সেই সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে জামায়াতের প্রার্থী দেয়া মোটেই উচিত হয়নি।
বিষয়টিকে তারা সহজভাবে নিচ্ছে না। সরকারের ইন্ধনে এমনটা হতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। বিএনপি ও জোটের একাধিক নেতা জানান, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে জামায়াত প্রকাশ্যে দলের কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। সেখানে সিলেটে প্রকাশ্যে তাদের প্রার্থী নিয়মিত নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন।
মহানগর জোটের শরিকদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। গাড়িবহর নিয়ে শহরের সব জায়গায় নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন। প্রতিদিন কর্মিসভা করে যাচ্ছেন। অথচ জামায়াতের প্রার্থীকে পুলিশ কোনো বাধা দিচ্ছে না। অন্যদিকে বিএনপির নেতাকর্মীরা এখনও মাঠে নামতে পারছেন না। প্রতিনিয়ত তাদের বাসাবাড়িতে হানা দেয়া হচ্ছে।
এলডিপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, জামায়াতের মেয়র প্রার্থী দেয়া উচিত হয়নি। এতে জোটের ঐক্য বিনষ্ট হচ্ছে। সার্বিকভাবে মনে হচ্ছে, জামায়াতের একটি অংশের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ আছে। জামায়াতের ব্যাপারে একটি ফয়সালা হওয়া উচিত। এ মুহূর্তে জোটের সঙ্গে এমন আচরণ কাম্য হতে পারে না।
তবে জামায়াতের একটি অংশের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ আছে- এ অভিযোগের বিষয়ে সিলেটে জামায়াতের প্রার্থী এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, এ ধরনের কোনো কিছু নেই।
সিলেটের পাশাপাশি বরিশাল ও রাজশাহীতেও বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। রাজশাহীতে মেয়র পদে জামায়াত প্রার্থী না দিলেও এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিকে সমর্থন দেয়নি। কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থন দিলেই মেয়র পদে বিএনপিকে সমর্থন দেবে- এমন শর্ত জুড়ে দিয়েছে জামায়াত।
এ নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে গোপনে দরকষাকষি চলছে। পরস্পরকে সমর্থক দেয়া না-দেয়া নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে দেখা দিয়েছে এক ধরনের টানাপোড়েন।
জানা গেছে, ১৬টি ওয়ার্ডে জামায়াত কাউন্সিলর প্রার্থী দিয়েছে। এর মধ্যে সাধারণ ওয়ার্ডে ১৪টি ও সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডে দুটি। তাদের ১৬ কাউন্সিলর প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে বিএনপি প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করালেই মেয়র পদে তারা মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে সমর্থন দেবেন।
রাজশাহী মহানগর জামায়াতের নায়েবে আমীর আবু ইউসুফ সেলিম বলেন, রাজশাহী ও বরিশালে আমাদের কোনো মেয়র প্রার্থী থাকবে না বলে কেন্দ্র জানিয়েছে। ২০ দল বিএনপিকে সমর্থন দিচ্ছে বলে খবরে দেখেছি। তবে এ ব্যাপারে আমাদের কাছে কেন্দ্র থেকে কোনো নির্দেশনা আসেনি। নির্দেশনা না এলে আমাদের নেতাকর্মীরা রাজশাহীতে বুলবুলের জন্য মাঠে নামতে নাও পারেন।
এ ছাড়া বরিশালে জামায়াতের মেয়র প্রার্থী না থাকলেও এখন পর্যন্ত তারা বিএনপিকে আনুষ্ঠানিক সমর্থন জানায়নি।