এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : মালয়েশিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি ডাঃ মাহাথির মোহাম্মদের ৯৩তম জন্মদিন আজ। ১৯২৫ সালের ১০ জুলাই মালয়েশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর এ্যালোর সেটর-এ এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। পিতা-মাতার নয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন কনিষ্ঠতম। তার পিতা একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন এবং পরবর্তীকালে একজন সরকারি অডিটর হিসেবে কাজ করেছেন। তার মা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন এবং মাহাথিরকে বাসায় পবিত্র কোরআন শিক্ষা দিতেন।
মাহাথির শৈশবে প্রথমে মালয় ও পরে শহরের একমাত্র ইংরেজি স্কুলে শিক্ষা লাভ করেন। বাসায় তাদের একজন ধর্ম শিক্ষক ছিলেন যিনি প্রতিদিন বাড়িতে এসে পবিত্র কোরআন, ইসলাম ধর্মের উপর বিশ্বাস এবং ধর্মীয় বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান শেখাতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪১ সালে জাপান মালয়েশিয়া আক্রমণ করে। তারা ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বন্ধ করে দেয় এবং একটি জাপানি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। মাহাথিরের বয়স তখন ষোল। প্রথমে তিনি জাপানি স্কুলে যেতে চাননি। ঐ সময় মাহাথির একটি স্থানীয় ছোট বাজারে কলা বিক্রি শুরু করেন। কিন্তু পিতার চাপে তিনি পরবর্তীতে ঐ জাপানি স্কুলে ভর্তি হন। মালয়েশিয়ায় জাপানি শাসন প্রায় তিন বছর স্থায়ী ছিল।
মাহাথিরের বয়স যখন ২০ বছরের একটু বেশি তখন তিনি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। সহপাঠীদের একত্র করে তিনি গোপনে ‘মালয়ান ইউনিয়ন’ প্রস্তাবের বিরুদ্ধচারণ শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত জাপানীরা চলে যাবার পূর্বে তৎকালীন মালয়েশিয়াকে তারা থাই সরকারের শাসনাধীনে হস্তান্তর করে। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা আবার ফিরে আসে এবং ‘মালয়ান ইউনিয়ন’ প্রতিষ্ঠা করে। মালয়ান ইউনিয়ন সত্যিকার অর্থে সম্পূর্ণ উপনিবেশ ছিল। মাহাথির ও তার বন্ধুরা তখন রাতের অন্ধকারে সারা শহরে রাজনৈতিক বাণী সম্বলিত পোষ্টার লাগাতেন।
তাদের উদ্দেশ্য ছিল সীমিত, ‘মালয়ান ইউনিয়ন’ প্রস্তাবের সমাপ্তি এবং প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা ফিরে পাওয়া। সাইকেল চালিয়ে তারা সমগ্র প্রদেশ ঘুরে ঘুরে জনগনকে ব্রিটিশ বিরোধী হিসেবে সংঘটিত ও সক্রিয় করার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। সংগঠনে মাহাথির সাধারণত সম্পাদক বা দ্বিতীয় অবস্থানটা বেছে নিতেন, কারণ দ্বিতীয় ব্যক্তিকেই বেশি সাংগঠনিক কাজ করতে হয় ও অন্য দলগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়। মাহাথির প্রথম কেদাহ মালয় যুব ইউনিয়ন এবং পরে কেদাহ মালয় ইউনিয়ন নামে রাজনৈতিক দল সংগঠিত করেন যা পরবর্তিতে ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন বা ইউএমএনও (UMNO) হিসেবে পরিচিত হয়।
১৯৪৭ সালে তিনি সিঙ্গাপুরের কিং এডয়ার্ড মেডিসিন কলেজে ভর্তি হন এবং চিকিৎসা শাস্ত্রে অধ্যয়ন সমাপ্ত করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি সিঙ্গাপুর থেকে মালয়েশিয়া ফিরে আসেন। সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন মাহাথির সেখানের কলেজের মালয় ছাত্রদের নিয়ে ‘মালয় ছাত্র সংগঠন’ গঠন করেন। তবে এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রদের শিক্ষার মান ও ফলাফল উন্নয়ন করা। এর কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না।
সিঙ্গাপুরে পড়ার সময় মাহাথিরের সিথি হাসমা মোঃ আলীর সাথে সাক্ষাৎ হয়। সিথি হাসমা তখন দ্বিতীয় মালয় মহিলা হিসেবে সিঙ্গাপুরে বৃত্তি নিয়ে একই কলেজে চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ছিলেন। পরবর্তীতে মাহাথির ও সিথি হাসমা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের মোট ৭ জন সন্তান আছে, যার মধ্যে ৩ জনকে তারা দত্তক নিয়েছিলেন। পরিবার সম্পর্কে মাহাথির বলেন, ‘প্রত্যেকের নিজ পরিবার একটি নিরাপদ জায়গা – যা আমাদের এই জটিল সমাজে স্থিরতা আনে।’
১৯৫৩ সালে সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে এসে মাহাথির একজন চিকিৎসক হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। মালয়েশিয়ার স্বাধীনতার ঠিক পূর্বে তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে নিজ শহর এ্যালোর সেটরে মাহা-ক্লিনিক নামে একটি প্রাইভেট ক্লিনিক শুরু করেন। শহরের ৫টি প্রাইভেট ক্লিনিকের মধ্যে এটি একমাত্র মালয় বংশভূত ব্যক্তি মালিকানাধীন ক্লিনিক ছিল। তিনি রোগীদের বাড়িতে যেতেন এবং মাঝে মাঝে ছোট খাট অস্ত্রপচার করতেন।
মাহাথিরের মতে চিকিৎসক হিসেবে তার প্রশিক্ষণ ও প্রাকটিস তার মধ্যে স্থিরতা এনেছিল ও তাকে যে কোনো পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে সক্ষম করেছিল। তিনি একবার ‘দ্যা ইকোনমিস্ট’ পত্রিকাতে বলেছিলেন, ‘চিকিৎসা বিদ্যায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকের জন্য রাজনীতি একটি ভালো পেশা। একজন ডাক্তার রোগীকে পর্যবেক্ষণ করেন, স্বাস্থ্যগত ইতিহাস রেকর্ড করেন, স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন, ল্যাব পরীক্ষা করেন এবং চূড়ান্তভাবে রোগ নির্ণয় করেন। এ প্রক্রিয়াটি রাজনীতির মতই।’ ১৯৭৪ সালে মন্ত্রী হবার আগ পর্যন্ত তিনি চিকিৎসা পেশা অব্যাহত রেখেছিলেন।
সরকারি চাকরিতে থাকাকালীন তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে পারেননি। নিজ ক্লিনিক চালু করার পর তার জাতীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা বাড়তে থাকে। ইউএমএনও-এর প্রাদেশিক শাখার উর্ধ্বতন পদে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৬৪ সালে ৩৯ বছর বয়সে মাহাথির প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপরও এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাহায্যে তিনি ডাক্তারি প্রাকটিস অব্যাহত রাখেন। ১৯৭৪ সাল নাগাদ তিনি এই পেশা ধরে রেখেছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি দ্বিতীয়বার নির্বাচনে প্রার্থী হন। সেই বছর ইউএমএনও এর নেতৃত্বে জোটবদ্ধ সম্মিলিত সরকার গঠিত হয়।
ইউএমএনও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। কয়েকটি প্রদেশে তারা সরকার গঠন করতেও সক্ষম হয়নি। ১৯৬৯ সালের ৩০শে মে কুয়ালালামপুরে যখন চীনা ও মালয় জাতির মধ্যে তুমুল-দাঙ্গা শুরু হয় তখন রাজনৈতিক সংকট চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে। এই দাঙ্গার জন্য মাহাথির ইউএমএনও নেতৃত্বকে দোষারোপ করে প্রধানমন্ত্রী টুঙ্কু আব্দুর রহমানকে কড়া ভাষায় চিঠি লেখেন ও পদত্যাগের পরামর্শ দেন। এ সমালোচনা পার্টি নেতৃবৃন্দের সহ্য করলেন না, তারা মাহাথিরকে দল থেকে বহিষ্কার করলেন। পরবর্তী তিন বছর তিনি নিজ দেশেই রাজনীতি থেকে নির্বাসনে ছিলেন। ১৯৭২ সালে মাহাথিরকে আবার দলের সদস্য ও সিনেটর হিসেবে পুনর্বহাল করা হয়।
১৯৭৪ সালে দল নির্বাচনে জয়ী হবার পর তাকে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। মাত্র দুই বছর পর মাহাথির ১৯৭৬ এ উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এতে তিনি সফল হন। উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের জন্য অনেক কিছু করার পরিকল্পনা থাকলেও মাহাথির স্বাধীনভাবে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে সক্ষম ছিলেন না।
তিনি ১৬ই জুলাই ১৯৮১ সালে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৮১ সালে প্রধানমন্ত্রী হবার পর তিনি তার সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সম্পূর্ণ মুক্ত হন। তার নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন দল পর পর ৫বার সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। তিনি এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে তথা টানা ২২ বছর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
ডাঃ মাহাথির মোহাম্মদ বিশ্বময় আধুনিক মালয়েশিয়ার প্রধান রূপকার হিসেবে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী হবার পর তিনি সকল বিষয় পুনঃপরীক্ষা করেন। সকল নীতি, পদ্ধতি, সরকার চালাতে প্রাত্যহিক সকল কাজ, আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করা হয়। তার সরকার সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ওয়ার্ক-ফ্লো চার্ট আর অফিস ম্যানুয়েল প্রবর্তন করেন। মাহাথির ও তার সরকার দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচি তৈরি করেন যার মাধ্যমে প্রত্যেকে তার নিজ নিজ ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হয়। ব্যবসা এবং রাজনীতিতে ফুটপাতের লোক থেকে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব পর্যন্ত দেশের জন্য নিজের জন্য কাজ করবে।
১৯৯০ সালে মালয়েশিয়া বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৮% ছাড়িয়ে যায়। মাহাথির ১৯৭১ সালে প্রনিত নিউ ইকোনমিক পলিসি (এনইপি) সফল ভাবে বাস্তবায়নে সচেষ্ট হন। এনইপির উদ্দেশ্য ছিল জাতি নির্বিশেষে দারিদ্র্য বিমোচন এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে জাতি পরিচয় মুছে ফেলা। নতুন সম্পদ সৃষ্টি করা এবং এর বৃহত্তর অংশ দরিদ্রদের জন্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে সম্পদের পুনঃবন্টনের চেষ্টা করা হয়। ১৯৯১ সালে বিশ বছর মেয়াদি এনইপি শেষ হয়। দারিদ্র্য বিমোচন বহুলাংশে অর্জিত হয়। সমৃদ্ধির একটি পর্যায়ে পৌছে মালয়েশিয়া বিভিন্ন জাতির সুসম্পর্কসহ একটি জাতিতে পরিনত হয় যা অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য ঈর্ষনীয়। বিশ বছর মেয়াদি এনইপি শেষ হবার পর দশ বছর মেয়াদি ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট পলিসি (এনডিপি) প্রনয়ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
২০০৩ সালের ওআইসি সম্মেলনের সফল সমাপ্তির পর ৩০শে অক্টোবর তিনি স্বেচ্ছায় প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেন। অবসর গ্রহণের দীর্ঘ পনের বছর পর ৯২ বছর বয়সে প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের ব্যাপক দুর্নীতি সংশ্লিষ্টতার কারণে মাহাথির মোহাম্মদ আবারো আসেন রাজনীতিতে। ২০১৮ সালের ৯ মে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনে জয়ের পরদিন ১০ মে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন তিনি।
ইসলাম ধর্মের প্রতি বিশ্বাস মাহাথিরের ভিতর আসে পরিবার থেকে। তার পরিবার তাকে ইসলামের উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে শিক্ষা দেয়, কিন্তু তাদের কোন রূপ গোঁড়ামি ছিল না। ইসলাম সম্পর্কে ‘এ নিউ ডিল ফর এশিয়া’ গ্রন্থে মাহাথির বলেন, ‘ইসলাম ধর্ম আমাদের জীবনের অংশ। একে পরিত্যাগ করার কোনো কারণ নেই। সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা হলে ধর্ম কখনই অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য বাধা হতে পারে না। ইসলামের শিক্ষা সমসাময়িক সময়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে নিতে হবে। ইসলাম শুধু মাত্র সপ্তম শতাব্দীর ধর্ম নয়। ইসলাম অবশ্যই সর্বকালের ধর্ম।’
ব্যক্তিজীবনে মাহাথির ছিলেন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি একাই যে স্বপ্ন দেখেছেন এমনটা নয়। পুরো জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি। চীনা, মালয়ী, তামিলসহ বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত মালয়েশিয়াকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসতে সক্ষম হন তিনি। তিনি কর্মীদের যা করতে বলেছেন তা নিজে করেও দেখিয়েছেন।
সরকারি কর্মীরা যেন ঠিক সময়ে অফিসে আসেন সেজন্য নিজেও ঠিক সময়ে অফিসে আসতেন। টাইম ম্যাগাজিন একবার তার অফিসে আসার সময় রেকর্ড করেছিল। পরপর পাঁচ দিন তার অফিসে প্রবেশের সময় ছিল সকাল ৭:৫৭, ৭:৫৬, ৭:৫৭, ৭:৫৯, ৭:৫৭। তিনি নিজে একজন পরিশ্রমী এবং শৃংখলা পরায়ণ মানুষ ছিলেন। সময়ের মূল্য দিতে জানতেন তিনি।সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা শাস্ত্র পড়ার সময় তার সাথে যে ছয় জন মালয়ী শিক্ষার্থী ছিলেন তাদের একজন ছিলেন সিতি হাসমাহ নামের একজন ছাত্রী। এই সিতিকেই নিজের জীবনের সঙ্গী করে এতটা পথ হেটেছেন।