এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : ইন্দোনেশিয়ার উলেমা পরিষদ ২০১৪ সালে বিপন্ন প্রাণি হত্যা না করতে একটি ফতোয়া জারি করেছিল৷ আর গত রোজায় প্লাস্টিক বর্জ্যের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করার এক প্রচারণায় অংশ নেন তাঁরা৷প্লাস্টিক ব্যাগের পরিবর্তে বারবার ব্যবহার করা যায়, এমন ব্যাগ ব্যবহারের পরামর্শ দেন ধর্মীয় নেতারা৷ইন্দোনেশিয়ার বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ সংগঠন গ্রিনপিসের সঙ্গে তিনটি ইসলামি সংগঠনএই প্রচারণার সঙ্গে যুক্ত হয়৷
মন্ত্রণালয়ের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক পরিচালক রোসা ভিভিয়েন রত্নাওয়াতি জানান, ইন্দোনেশিয়ায় প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে৷ জানা গেছে, দেশটির একজন নাগরিক বছরে গড়ে ১৭ কিলোগ্রামের সমপরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলেন৷ ফলে বছরে গড়ে ১৮৭ দশমিক ২ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে গিয়ে মেশে৷
এর আগে ২০১৪ সালে দেশটির উলেমা পরিষদ বিপন্ন প্রাণি হত্যা না করতে একটি ফতোয়া জারি করেছিল৷ এছাড়া ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন ফর ইকোলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস’ এর উদ্যোগে ইন্দোনেশিয়ার স্কুলগুলোতে গাছ লাগানো কর্মসূচি পালন করা হয়েছিল৷
ইন্দোনেশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিলিজিয়াস স্টাডিজের অধ্যাপক জয়নুল বাহরি বলেন, ইসলাম ধর্মে পরিবেশ রক্ষার উপর জোর দেয়া হয়েছে৷ ‘‘পরিবেশের ক্ষতি করার জন্য আল্লাহ মানুষকে দায়ী করেন,” জানান তিনি৷
সচেতনতা তৈরিতে ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন বাহরি৷ তবে এক্ষেত্রে ধর্মীয় নেতাদের কারিগরি জ্ঞান বাড়াতে পরিবেশবাদী সংগঠনের সঙ্গে মিলে যৌথভাবে কাজ করার ওপর জোর দেন তিনি৷ ‘‘প্রকৃতি কীভাবে কাজ করে, ইকোসিস্টেমকে কীভাবে রক্ষা করা যায় – এ সংক্রান্ত পর্যাপ্ত জ্ঞান অনেক ইমামের নেই,” বলেন রিলিজিয়াস স্টাডিজের অধ্যাপক বাহরি৷
ইন্দোনেশিয়া ছাড়াও অন্যান্য দেশে পরিবেশ রক্ষায় ধর্মের ব্যবহার হয়েছে৷ যেমন, ২০০৮ সালে ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শের অনুসারী সংস্থা ‘দ্য অ্যালায়েন্স ফর রিলিজিয়ন্স অ্যান্ড কনজারভেশন’ তাঞ্জানিয়ার পেম্বা দ্বীপের জেলেদের নিয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে৷ এক্ষেত্রে স্থানীয় ধর্মীয় নেতাদের সহায়তা নেয়া হয়েছিল৷ প্রকল্পের আওতায়, মাছ ধরার ক্ষেত্রে বিস্ফোরক ব্যবহার না করতে জেলেদের আহ্বান জানানো হয়েছিল৷ পরবর্তীতে এক জেলে ‘দ্য ক্রিস্টিয়ান সায়েন্স মনিটর’কে জানিয়েছিলেন, ‘‘পরিবেশ রক্ষার পরিকল্পনা পশ্চিম থেকে আসেনি৷ এটা এসেছে কোরান থেকে৷”
অজান্তেই পেটে যাচ্ছে প্লাস্টিক
মুখভর্তি প্লাস্টিক
৫ মিলিমিটারের চেয়েও ছোট প্লাস্টিকের অংশকে বলা হয় মাইক্রোপ্লাস্টিক৷ ছোট ছোট এই প্লাস্টিকের অংশ গিয়ে মিশছে সমুদ্রে৷ ঢুকে পড়ছে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য সামগ্রীতে৷ শুধু তাই নয়, বাতাসেও ছড়িয়ে রয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিক৷ টুথপেস্ট থেকে ক্রিম, মাছ থেকে জল সর্বত্র মাইক্রোপ্লাস্টিক৷
প্লাস্টিক দিয়ে মুখ ধোয়া
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, কোনো কোনো কসমেটিকে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়৷ কখনো কখনো যার পরিমাণ প্যাকেজিংয়ে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের সমপরিমাণ বা তার চেয়েও বেশি৷ কিন্তু আপাত চোখে কসমেটিকে প্লাস্টিক দেখা যায় না৷ তা লুকিয়ে থাকে ক্রিম বা টুথপেস্টের মধ্যে৷ ব্যবহার করলে কিছু অংশ ঢুকে যায় দেহের ভিতর৷ বাকি অংশ চলে যায় ড্রেনে৷
পানিতেও প্লাস্টিক
ড্রেনের জলে মিশে যাওয়া প্লাস্টিক পৌঁছে যায় সমুদ্রে৷ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, সমুদ্রে গিয়ে মেশা প্লাস্টিক ঢুকে যায় জলজ উদ্ভিদে৷ মাছ সেই উদ্ভিদ খায়৷ ফলে তাদের শরীরেও পৌঁছে যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিক৷ ২০১৭ সালের একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, ইন্দোনেশিয়া এবং ক্যালিফোর্নিয়ার বাজারের ২৫ শতাংশ মাছের শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অংশ রয়েছে৷
এমনকি লবণেও…
২০১৭ সালে ইউরোপ, অ্যামেরিকা এবং চিনে একটি যৌথ গবেষণা হয়েছিল৷ তার রিপোর্টে বলা হয়, শুধু মাছ নয়, সমুদ্র উপকূল থেকে সংগৃহীত নুনের মধ্যেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে৷ তার কারণও আছে৷ প্রতি বছর প্রায় ১২ মিলিয়ন প্লাস্টিক আবর্জনা সমুদ্রে গিয়ে মেশে৷ ফলে উপকূলবর্তী নুনেও তার অংশবিশেষ মিশে যায়৷
নিরাপদ নয় মধু
সম্প্রতি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন জানিয়েছে, মধুতে প্রচুর মাইক্রোপ্লাস্টিক আছে৷ এ কারণে মধু নিষিদ্ধ করারও একটি পরিকল্পনা হয়েছে৷ কিন্তু মধুতে কীভাবে মাইক্রোপ্লাস্টিক মিশছে, সে বিষয়ে এখনো পরীক্ষানিরীক্ষা সম্পূর্ণ হয়নি৷
জামা নয়, প্লাস্টিক
সুতি নয়, কিন্তু সিন্থেটিক জামায় প্রচুর মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকে৷ কাপড় ধোয়ার সময় সেই প্লাস্টিক জামা থেকে বেরিয়ে ড্রেনের পানিতে গিয়ে মেশে৷ পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ৬ কিলোগ্রাম সিন্থেটিক জামা কাচলে তার থেকে ৭ লক্ষ প্লাস্টিক ফাইবার নির্গত হয়৷ ড্রেনের জলের মাধ্যমে তা গিয়ে পৌঁছায় সমুদ্রে৷ বস্তুত, সমুদ্রের জলে প্লাস্টিকের মোট পরিমাণের এক তৃতীয়াংশই জামা কাপড়ের মাইক্রোপ্লাস্টিক৷
চাকায় প্লাস্টিক
গাড়ির চাকা থেকেও প্রচুর মাইক্রোপ্লাস্টিক পরিবেশে গিয়ে মেশে৷ রবারের সঙ্গে সিন্থেটিক পলিমার মিশিয়ে তৈরি হয় গাড়ির টায়ার৷ রাস্তার সঙ্গে টায়ারের ঘর্ষণে সেই সিন্থেটিক পলিমার থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক রাস্তায় গিয়ে মেশে৷ কখনো বা বাতাসেও মিশে যায়৷ নরওয়ে এবং সুইডেনের বিভিন্ন পরীক্ষায় ধরা পড়েছে, সমুদ্র থেকে পাওয়া মাইক্রোপ্লাস্টিকের একটা বড় অংশ গাড়ির চাকার পলিমার৷
কল খুললেও প্লাস্টিক
কলের পানিতেও মিশে থাকছে প্লাস্টিক৷ বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশ থেকে কলের জল সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, অন্তত ৮০ শতাংশ নমুনাতেই মাইক্রোপ্লাস্টিক আছে৷ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, কলের পানিতেই প্লাস্টিক থাকলে যে কোনো খাবারেই তা সহজে মিশে যেতে পারে৷