এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : স্ট্যালিন। শক্ত হাতে ২৭ বছর শাসন করেছেন সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাকে বলা হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রিম ডিক্টেটর, পূর্ব ইউরোপের পাপেট মাস্টার। তার মৃত্যুর পর চারজন ছলনাময় কৌশলী ব্যক্তি তার ক্ষমতার উত্তরাধিকারী হন। তাদের কথা বিশ্বাস করলে বলতে হয়, তিনি অতিথিদের জন্য রাখা অতিরিক্ত একটি কক্ষে একাকী মনমরা অবস্থায় চিন্তামগ্ন থাকাবস্থায় বড় ধরনের পক্ষাঘাত বা স্ট্রোকের শিকার হন। সে কক্ষে তিনি কয় ঘণ্টা অচেতন অবস্থায় ছিলেন, তা বলা মুশকিল।
কারণ, তার ২৭ বছরের লৌহকঠিন শাসনে দেহরক্ষী থেকে শুরু করে পরিবারের লোকজন ও সহযোগী কর্মকর্তারা পর্যন্ত তার ভয়ে এতটাই ভীতসন্ত্রস্ত থাকত যে, কেউ তার দরজায় নক করতেও ভয় পেতো। অভিযোগ যদি সত্য হয়, তবে তার বেদনাদায়ক এ মৃত্যুর ঘটনা তার কর্মজীবনের সাথে বৈপরীত্য ঠেকে। কারণ তিনি নিজেকে করে তুলেছিলেন এমন এক কঠোর শাসক হিসেবে, যিনি তার অনুগত অনুসারীদের ওপরও অত্যাচার অনাচার চালিয়েছিলেন এবং অনেককে খুনও করেছিলেন। বলা হয়, তার বিরোধিতা করতে পারেন এ ধরনের কাণ্ডজ্ঞানহীন সন্দেহে তিনি তিন কোটি, এমনকি হতে পারে তারও দ্বিগুণ পরিমাণ সোভিয়েতবাসীকে গুলি করে মেরেছেন, ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন, বুভুক্ষু অবস্থায় মেরেছেন, প্রহার করেছেন কিংবা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন।
লাখ লাখ মানুষকে বন্দী রেখেছেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। তাদের বাধ্য করেছেন রাষ্ট্রের কাজ করতে। ইউক্রেনে অগুনতি মানুষ মারা গেছে, যখন তিনি কৃষকদের বাধ্য করেছেন যৌথ চাষে। বাধ্য করেছেন তাদের উৎপাদিত পণ্য অন্য কোথাও পাঠাতে। একদম ব্যক্তিপর্যায়ে তিনি পুরনো সহকর্মীদের দাওয়াত করে রাতের ভোজসভায় ডেকে এনে সর্বোচ্চ উন্মাদনা নিয়ে এসব দুর্ভাগাকে পাঠাতেন এক্সিকিউশন চেম্বারে। এমনও বলা হয়, তিনি সোয়ান লেকের একটি ব্যালে নৃত্যানুষ্ঠানের মধ্যবিরতির সময় গাড়ি চালিয়ে চলে যান রেড স্কোয়ারের লুবিয়াঙ্কা কারাগারে তার সাবেক কয়জন সমর্থকের মাথায় গুলি করে হত্যা করার জন্য। তাদের হত্যা করে তিনি আবার থিয়েটারে ফিরে এসে নৃত্যের বাকি অংশ উপভোগ করেন।
১৯৫৩ সালের প্রথম দিকে স্ট্যালিনের বয়স তখন ৭৩। এই সময় তার এ প্যারানয়েড টেনডেনসি অর্থাৎ উন্মত্ততার প্রবণতা ও আন্দাজ-অনুমানের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড আরো বেড়ে যেতে থাকে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত জর্জ কেনান বলেছেন, এই পুরনো স্বেচ্ছাচরী শাসকের ভীতি ও ঘৃণা আকাশ-বাতাস এতটাই ভারী করে তুলেছিল যে, যে কেউ তা আঁচ করতে পারত। তখন সোভিয়েত স্টেট সিকিউরিটি সার্ভিসের প্রধান ল্যাভরেন্টি বেরিয়ার সিক্রেট অ্যাজেন্ট ছিলেন এক মহিলা। তার অভিযোগ, স্ট্যালিনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক জড়িত ছিলেন তথাকথিত ‘ডক্টর’স প্লট’-এর সাথে। এর আওতায় ‘ভুল চিকিৎসার মাধ্যমে হত্যা করা হতো গুরুত্বপূর্ণ সামরিক নেতাদের। বাকি আটজন চিকিৎসককে বন্দী করা হয়, যাদের বেশির ভাগই ছিলেন ইহুদি।হতে পারে তিনি এটা ধরে নিয়েছিলেন, তাকে হত্যা করে বিরোধীরা ব্যাপক হত্যা ও লুণ্ঠনের আশ্রয় নিতে পারে। তাই তিনি অ্যান্টিসেমিটিজম অর্থাৎ ইহুদিবিদ্বেষ জিইয়ে রেখেছিলেন।
কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম কংগ্রেসে প্রথমবারের মতো অবস্থান নেয়া হয় স্ট্যালিন নামের এই স্বেচ্ছাচারী শাসকের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিরুদ্ধে। যদিও তা নেয়া হয় হালকাভাবে। কিন্তু পর্দার আড়ালে স্ট্যালিন গোপনে কাজ করছিলেন কমিউনিস্ট পার্টিকে অবাঞ্ছিত ওল্ডগার্ডবিমুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে। সেই সাথে তার লক্ষ্য ছিল তাদের জায়গায় নতুন স্ট্যালিন অনুগতদের বসানো। এই ডিক্টেটরের পরিকল্পনার ওপর নজর রাখছিলেন তাদের ঘনিষ্ঠজনেরা : নিরাপত্তাপ্রধান বেরিয়া, প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিকোলাই বুলগেনিন, উপপ্রধানমন্ত্রী এবং প্রকল্পিত উত্তরাধিকারী জর্জি মেলেনকভ এবং মস্কো নগর ও অন্যান্য আঞ্চলিক কমিটির শক্তিধর নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ।
একটি পানের আসর, এরপর নীরবতা
মৃত্যুর খুব বেশি আগে নয়, স্ট্যালিন একদিন হঠাৎ করেই উধাও করে দেন তার প্রাইভেট সেক্রেটারিকে। দশকের পর দশক ধরে তার এই ‘অল্টার ইগো’ কম-বেশি কাজ করেছে সবখানে। ১৯৫৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তার প্রধান দেহরক্ষীর ‘প্রিম্যাচিউর ডেথ’ ঘোষিত হলো সরকারিভাবে। সন্দেহ নেই তিনি ইউফেরিজম ফর এক্সিকিউশনের শিকার। স্ট্যালিনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক তখনো বন্দিশালায় আটক। চার দিকে গুজব এই গ্রেটম্যান অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ডিসেম্বর থেকেই অভিজাত মহলে এ গুজব ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তার কন্যা এস্ভেটলানা (ঝাবঃষধহধ) তার কাছে যেতে পারছিলেন না, যদিও তিনি বারবার প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে তার বাবার কাছে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কয়েক মাস আগে তিনি দেখেছিলেন বাবা স্ট্যালিন ক্রমেই অপচিত হয়ে পড়ছিলেন আর্টেরিওসক্লেরোসিস অর্থাৎ এক ধরনের ধমনীর প্রদাহের কারণে।
২ মার্চে স্ট্যালিন সেরিব্রাল হেমারেজের শিকার হয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু স্ট্যালিনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী আতঙ্কিত মহলটি এই খবর গোপন রাখে। ক্রুশ্চেভের মতে, এর আগের দিন স্ট্যালিন চার ঘনিষ্ঠকে তার কুনজেভোর গ্রীষ্মকালীন বাড়িতে দাওয়াত করে আনেন রাতের পানের ও রগড় গালগল্পের আয়োজনে। কিন্তু পার্টি ভেঙে যাওয়ায় অল্পক্ষণের মধ্যেই স্ট্যালিন একা শুতে চলে যান। মার্চের ৩ তারিখে রাত ৩টার পর ভীতসন্ত্রস্ত দেহরক্ষীরা জানায়, ২৪ ঘণ্টা ধরে সোভিয়েত চিপটেনকে দেখা যায়নি। যখন এরা সাহস করে তার প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত ইনার স্যাঙ্কটাম বা অন্তর্দেশে প্রবেশ করে, তখন দেখেতে পেল পুরোপুরি পোশাকপরা অবস্থায় একটি কম্বলের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছেন স্ট্যালিন।
দৃশ্যত বিস্মিত ও আশঙ্কিত ম্যালেনকভ ক্রুশ্চেভ, বুলগেনিন ও বেরিয়া দ্রুত আসেন তাদের আলাদা আলাদা বাড়ি থেকে। এসে দেখেন স্ট্যালিনকে তখনো একটি সাধারণ কোচে অস্বাভাবিকভাবে রাখা হয়েছে। এক সময় ডাক্তার ডেকে আনা হলো। চার সহকর্মী ও সরকারি দলের অন্য প্রেসিডিয়াম সদস্যরা দু’জন দু’জন করে পালা করে তার চিকিৎসা তদারকি করেন। একই সময়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পরিকল্পনাও প্রণয়ন করেন।
পরবর্তী দিনগুলোয় ক্রুশ্চেভ ও অন্যদের চোখ লাল করে কাঁদতে দেখা গেছে। কিন্তু বেরিয়ার আচরণ ছিল অনেকটা বিস্ময়কর। মাঝে মধ্যে স্ট্যালিনের চোখের পাতা যখন নড়ে উঠত, তখন আতঙ্কে বিস্ময়ীভূত নিরাপত্তা প্রধান ল্যাভরেন্টি বেরিয়া প্রকাশ করতেন তার উদ্বেগ ও সহানুভূতির কথা। কিন্তু যখন মনে হলো স্ট্যালিন আবার কোমায় চলে গেছেন, বেরিয়া অন্যদের কাছে তার পুরনো মেন্টর স্ট্যালিন সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে সবার মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করতেন। তার এই আচরণের মধ্য দিয়ে তিনি অন্যদের কাছে কী আভাস-ইঙ্গিত পৌঁছাতে চেয়েছিলেন সেদিন? ১৯৩৮ সাল থেকে বেরিয়া ছিলেন সিক্রেট পুলিশ বাহিনীর প্রধান। তিনি ছিলেন স্ট্যালিনের অমনিপটেন্সের সত্যিকারের উৎস।
৪ মার্চ স্ট্যালিন হঠাৎ জেগে ওঠেন। তখন নার্স একটি চামচ দিয়ে তাকে খাওয়াচ্ছিলেন। তখন তিনি দেয়ালে টাঙানো একটি ছবির দিকে আঙুল দিয়ে দেখালেন। ছবিতে এক মহিলা ঠিক তার মতো একটি মেষশাবককে চামচ দিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছে। এর কতক্ষণ পরই তিনি তার অনুসারীদের দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে তীব্র আক্ষেপ নিয়ে মৃত্যুকোলে ঢলে পড়েন। এর পর বেরিয়া হয়ে ওঠেন মস্কোর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু।
এই দিনটিতেই তার মৃত্যুর আগে সোভিয়েত সাম্রাজ্যের ৮০ কোটি মানুষ এবং সেই সাথে বাকি দুনিয়ার মানুষ জানতে পারে স্ট্যালিন মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। চিকিৎসক তার রোগ সম্পর্কে যে অস্বাভাবিক ব্যাখ্যা দিলেন, তাতেও ছিল জটিলতা। শেষ পর্যন্ত ৬ মার্চ সরকারি রেডিওতে ঘোষণা দেয়া হয়, স্ট্যালিনের হৃদস্পন্দন আগের রাত ১০টা ১০ মিনিটের সময় থেমে গেছে। একটি পূর্ণ অটপ্সি রিপোর্টে বলা হয়, আরোগ্যের অনুপযোগী এ রোগের মোকাবেলায় সম্ভাব্য সবচেয়ে বেশি চেষ্টা চালানো হয়েছে।
বিকেল ৪টার দিকে হাউজ অব দ্য ট্রেড ইউনিয়নের হল অব কলামসে প্রচুর তাজা ফুলে ঢাকা অবস্থায় তার লাশ রাখা হয়। মনে হচ্ছিল মস্কোর সব মানুষ যেন লাইন ধরেছে তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। সম্ভবত পরের তিন দিনে ৫০ লাখ মানুষ তাকে শ্রদ্ধা জানান। দুর্ভাগ্য, অনেকেই আহত বা নিহত হয়েছিল যখন বিব্রত জেনারেলেরা জনগণকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিলেন। তারা আদেশ দিলেন, শোকাভিভূত জনতাকে নিচতলায় লোহার জানালার বাইরে আটকে দিতে।
স্ট্যালিন ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের ২৭ বছরের উৎপীড়ক স্বৈরশাসক। মনে করা হয় তিনি দায়ী ছিলেন দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ সোভিয়েতের মৃত্যুর জন্য। তার পরও ৬ মার্চ তার মৃত্যুর খবর ঘোষিত হওয়ার পর লাখ লাখ মানুষকে তার মৃত্যুতে কাঁদতে দেখা গেছে। কারণ, তার নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয় পেয়েছে। তিনি ছিলেন তাদের নেতা, ‘ফাদার অব দ্য পিপল’, সুপ্রিম কমান্ডার, দ্য জেনারেলিসিমো।
স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর তার লাশ ধোয়ার কাজটি করেন একজন নার্স। এরপর তার লাশ একটি সাদা গাড়িতে করে ক্রেমলিন মর্চুয়ারিতে নিয়ে যাওয়া হয়। এর পর চলে তার লাশের এমব্যামিংয়ের (বসনধষসরহম) অর্থাৎ লাশের ওপর রাসায়নিক প্রলেপ লাগানোর কাজ।
১৯২৪ সালে লেলিন যখন মারা যান, তখন তার লাশের এমব্যামিং করেন প্রফেসর ভরোবিয়েভ। তখন এ কাজটি ছিল বেশ জটিল। একটি ইলেকট্রিক পাম্প লেনিনের শরীরজুড়ে দিতে হয়েছিল লাশকে অব্যাহতভাবে আর্দ্র রাখার জন্য। ১৯৫৩ সালে স্ট্যালিন যখন মারা যান, এর আগেই গত হয়েছেন প্রফেসর ভরোবিয়েভ। ফলে স্ট্যালিনের লাশের এমব্যামিং করেন প্রফেসর ভরোবিয়েভের সহকারী প্রফেসর জারস্কি। এই এমব্যামিংয়ের কাজ চলে কয়েক মাস ধরে। স্ট্যালিনের মৃত্যুর সাত মাস পর ১৯৫৩ সালের নভেম্বরে এসে তার কবর আবার খোলা হলো। তখন স্ট্যালিনের লাশ কাচের নিচে একটি কফিনে রাখা ছিল।
৯ মার্চ তাকে সমাহিত করা হয়। সেটি ছিল বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় মাপের শেষকৃত্য তথা সমাহিত করার আয়োজন। ওই দিন সোভিয়েত ইউনিয়নের সব কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখা হয়। শেষকৃত্যে আসা প্রতিনিধিদের দিয়ে ভরে যায় পুরো রেড স্কোয়ার। বহু রাষ্ট্রপ্রধান এতে যোগ দেন। স্ট্যালিনের উত্তরাধিকারীরা বয়ে নিয়ে যান শবযানের আচ্ছাদনবস্ত্র। কমিউনিজমের ‘লিটল ফাদার’ বলে খ্যাত স্ট্যালিনকে সমাহিত করা হলো মস্কোর রেড স্কোয়ারে লেনিন টম্বে সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা লেনিনের কবরের পাশে।
নানা অসামঞ্জস্য
স্ট্যালিনের খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ারপর প্রথম সরকারি ঘোষণায় দাবি করা হয় তিনি অসুস্থ হন তার মস্কোর অ্যাপার্টমেন্টে। যদি তা সত্য হয়, তাহলে তিনি কী করে ফিরে গেলেন কুনজেভোতে, যা আরো ৪৮ মাইল দূরে? কেন সরকারি ভাষ্যে বলা হলো, তিনি প্রথম রোগে পড়েন সোমবার খুব ভোরের দিকে, যেখানে ক্রুশ্চেভ ও অন্যরা বলেছেন, তিনি আক্রান্ত হন রোববার সকালের দিকে? পদচ্যুত ক্রুশ্চেভ কেন কয়েক বছর পর তার স্মৃতিচারণে এমন ভিন্ন কথা বলেন যে, তিনি ও তার তিন সাথী যখন স্ট্যালিনের গ্রামের বাড়িতে যান তখন তারা স্ট্যালিনকে দেখেননি এবং ডাক্তারও ডাকেননি? তা না করে বরং এর বদলে তারা বাড়ি চলে যান এবং ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকেন যতক্ষণ না ম্যালেনকভ কয়েক ঘণ্টা পর এমন খবর নিয়ে আসেন যে, স্ট্যালিন আসলেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
তার মৃত্যুর কিছু দিন আগে তিনি ভারতীয় কূটনীতিকের কাছে দাবি করেছিলেন, স্ট্যালিন অলসভাবে এঁকেছিলেন ক্রুদ্ধ খেঁকশিয়ালের ছবি। তিনি কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, অনুগ্রহ করে জেনে নিন কিভাবে খেঁকশিয়াল নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এরা তাদের পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়।
স্ট্যালিন কি একটি প্রতি-আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন? তার ‘ডক্টরস প্লট’ হতে পারে তার ওপর প্রতিশোধ নেয়ার অজুহাত খাড়া করা। শেষ দিকে স্ট্যালিন যখন ল্যাভরেন্টি বেরিয়ার ওপর মাঝে মধ্যেই হঠাৎ করে রেগে যেতেন, তখন ধরে নেয়া যেত এই সিক্রেট পুলিশপ্রধান বিপদে আছেন। আসলে যাই ঘটুক, স্বৈরশাসক স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর বেরিয়ার পরমান্দকর স্বস্তি ও ক্ষমতার উলঙ্গ দখল স্বল্প সময় স্থায়ী হয়। জুন মাসে তাকে প্রকাশ্যে গ্রেফতার করে রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করা হয়। ম্যালেনকভ সরকারের প্রধান ও একই সাথে কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান হিসেবে স্ট্যালিনের উত্তরসূরি হয়েছিলেন। তিনি প্রেসিডিয়ামের বাকিদের সাথে যোগ দেন টেরোরিজমের জিনিয়াস বলে খ্যাত বেরিয়াকে প্রকাশ্যে দোষারোপ ও মুক্ত করার কাজে নেমে পড়েন। সম্ভবত একটি গোপন বিচারের মাধ্যমে ডিসেম্বরের দিকে বেরিয়ার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। রায় ঘোষণার পর পরই সে স্থানেই তাকে গুলি করে মারা হয়। আগে যা বলার মতো ছিল না, শিগগিরই এ নিয়ে নানা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। মৃত ক্ষমতাধরদের সঙ্গী সাথীদের শিশুধর্ষণ, ছিনিয়ে আনা তরুণীদের নিয়ে পানোন্মত্ততা ও এমনি আরো অনেক গুঞ্জনই মস্কোর বাতাসে ভাসতে লাগল।
যুগের সমাপ্তি
অন্যান্য পরিবর্তনও বাতাসে ভাসতে লাগল। সেপ্টেম্বরের দিকে ক্রুশ্চেভ ম্যালকভের কাছ থেকে পার্টির সভাপতিত্ব গ্রহণ করেন। আর ১৯৫৫ সালে স্ট্যালিনের ফার্স্ট ডেপুটিকে একটি প্রদেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়ে কার্যত নির্বাসনে পাঠিয়ে বুলগেনিন হলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রজন্মে এই প্রথমবারের মতো নেতৃত্বে পরিবর্তন ঘটেনি চিপটেইনের জীবনের বিনিময়ে। আরো বড় মাটি কাঁপানো ঘটনা হলো, মস্কো দ্রুত সরে এলো স্ট্যালিনের বিখ্যাত ‘কাল্ট অব পার্সোনালিটি’ থেকে। স্ট্যালিনের সমাহিত হওয়ার দুই সপ্তাহ পর থেকে সরকারি প্রেসে স্ট্যালিনকে আর ধফ হধঁংবঁস হিসেবে উদ্ধৃত করা হতো না কিংবা তাকে প্রশংসা করে কিছু লেখা হতো না। ‘স্ট্যালিনিস্ট কনস্টিটিউশন’ রূপ নিলো ‘সোভিয়েত কনস্টিটিউশন’-এ। এমনকি রুশ সরকারি অভিধান থেকে ‘স্ট্যালিনিস্ট’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। সরকারি পত্রিকা প্রাভদা ঘোষণা করল ‘ডক্টরস প্লট’ কখনোই অস্তিত্বশীল ছিল না। ক্রুশ্চেভ প্রকাশ্যে বলেন, স্ট্যালিনের অব্যবস্থাপনার সূত্রে কৃষিসঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে।
সবশেষে ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের নতুন নেতা ২০তম পার্টি কংগ্রেসে দেন তার বিখ্যাত ‘সিক্রেট স্পিচ’। এতে তিনি তার পূর্বসূরি স্ট্যালিনের শাসনামলের বর্বরতা ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কথা উল্লেখ করেন। তাদের পাশ্চাত্যের শত্রুদের প্রশ্নে ক্রুশ্চেভ স্ট্যালিনের শত্রুতাপূর্ণ বিদেশনীতির বিপরীত নীতিতে অবস্থান নেন। তার নতুন ডকট্রিন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া হয় ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান‘ হিসেবে। এর মধ্য দিয়ে কার্যত বিদায় করা হয় স্ট্যালিন যুগের।
সরানো হলো স্ট্যালিনের লাশ
১৯৫৩ সালে স্ট্যালিন মারা যাওয়ার পর লেনিনের লাশের পাশেই সমাহিত করা হয়। এর পর প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ তার সমাধি দেখত আসত। এর আট বছর পর সোভিয়েত সরকার আদেশ দেয় লেনিনের সমাধি থেকে স্ট্যালিনের লাশ সরিয়ে নেয়ার জন্য। কেন সোভিয়েত সরকারের মনোভাবের এই পরিবর্তন? লেনিনের সমাধি থেকে স্ট্যালিনের লাশ সরানোর পর এ লাশের কী হলো?
এ কথা ঠিক, স্ট্যালিন ছিলেন এক স্বৈরশাসক। তার পরও তিনি নিজেকে জনগণের কাছে উপস্থাপন করেছিলেন ফাদার অব দ্য পিপল হিসেবে। তার মৃত্যুর পর সোভিয়েত জনগণ বলতে শুরু করে, তিনি দেশের লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। কমিউনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি (১৯৫৩-১৯৬৪) এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী (১৯৫৮-১৯৬৪) নিকিতা ক্রুশ্চেভ শুরু করেন ডি-স্ট্যালিনাইজেশনের কাজ। স্ট্যালিনের মৃত্যুর তিন বছর পর ১৯৫৬ সালের ২৪-২৫ ফেব্রুয়ারি ক্রুশ্চেভ ২০তম পার্টি কংগ্রেসে দেয়া ভাষণে স্ট্যালিনের জীবনের প্রচলিত সব মহত্ত্ব ধূলিসাৎ করে দেন। এই ভাষণে ক্রুশ্চেভ স্ট্যালিনের করা নানা বর্বরতার কথা উল্লেখ করেন।
পাঁচ বছর পর সময় এলো ‘প্লেস অব অনার’ হিসেবে বিবেচিত লেনিন টম্ব থেকে স্ট্যালিনের লাশ সরিয়ে দেয়ার। কমিউনিস্ট পার্টির ২২তম পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬১ সালের অক্টোবরে। এই পার্টি কংগ্রেসে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধা বললেন : ‘আমার হৃদয় লেনিনে পরিপূর্ণ। কমরেড, আমি আমার জীবনের সবচেয়ে জটিল দিনগুলো পেরিয়ে আসতে পেরেছি শুধু একটি কারণে। কারণ আমি আমার হৃদয়ে বহন করেছি লেনিনকে এবং সব সময় করণীয় সম্পর্কে তার পরামর্শ নিয়েছি। গতকালও আমি তার পরামর্শ নিয়েছি। তিনি ছিলেন আমার সামনে দাঁড়িয়ে, যেন এখনো তিনি জীবিত এবং তিনি আমাকে বলেছেন, স্ট্যালিন আমার পাশে শুয়ে আছে এটি আমার জন্য বিরক্তিকর। পার্টির এই ক্ষতিটা কে করল।’
এই বক্তব্য ছিল পূর্বপরিকল্পিত। তার পরও এটি ছিল বেশ কার্যকর প্রভাব সৃষ্টিকর। এর পর ক্রুশ্চেভ স্ট্যালিনের লাশ সরিয়ে নেয়ার ব্যাাপারে একটি ডিক্রি পাঠ করেন। এর কয়দিন পর স্ট্যালিনের লাশ নীরবে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। তার লাশ আবার কবর দেয়া হয় অন্য সব ছোটখাটো বিপ্লবী নেতাদের কবরের পাশে। তাকে কবর দেয়া হয় ক্রেমলিন দেয়ালের পাশে অনেকটা গাছগাছালি দিয়ে আড়াল করা এক স্থানে। এর কয় সপ্তাহ পর কবরের পাশে স্থাপন করা হয় একটি ছোট্ট গ্রানাইট পাথর যাতে শুধু লেখা হয় : ‘জেবিএস স্ট্যালিন ১৮৭৯- ১৯৫৩’। ১৯৭০ সালে তার কবরের পাশে যোগ করা হয় একটি ছোট্ট আবক্ষমূর্তি। লেখক : জি মুনীর