এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : আর যেন তর সইছে না ‘কাপ্তানের’। ভোট শেষের ২২ ঘণ্টা পরও ফলাফল ঘোষণার নামগন্ধ পর্যন্ত নেই। এদিকে ‘আঁতে ঘা লাগা’ শত্রুপক্ষও (বিরোধীরা) উঠেপড়ে লেগেছে। ঢাকঢোল পিটিয়ে পুরো পাকিস্তানকে জানিয়ে দিচ্ছে যে-‘ভোটে কারচুপি হয়েছে।
এ নির্বাচন জনগণ মানে না।’ শেষ পর্যন্ত কিসে কী হয়ে যায়? নির্বাচনের ফল ঘোষণা নিয়ে এমন ‘ইঁদুর-বিড়াল’ খেলার মধ্যেই বৃহস্পতিবার নিজেই নিজের বিজয় ঘোষণা করলেন ইমরান খান। বিকাল ৪টায় জাতির উদ্দেশে দেয়া টেলিভিশন ভাষণে নিজের অর্থ ও পররাষ্ট্রবিষয়ক পরিকল্পনা তুলে ধরেন পাকিস্তানের সম্ভাব্য পরবর্তী এই প্রধানমন্ত্রী। ইমরান খান বলেন, এটি একটি ঐতিহাসিক নির্বাচন। মহানবী (সা.)-এর অনুপ্রেরণায় মদিনার মতো নতুন পাকিস্তান গড়তে চাই। পাশাপাশি জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর স্বপ্নের পাকিস্তান গড়ার অঙ্গীকার করেছেন তিনি। পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইরান ও সৌদি আরবের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দিয়েছেন ইমরান।
বুধবার পাকিস্তানের ১১তম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এদিন প্রাদেশিক পরিষদেরও ভোট হয়। ভোটগ্রহণ শেষে সন্ধ্যা ৭টা থেকে গণনা শুরু হয়ে রাতভর চলে। দুপুর গড়িয়ে বিকাল বয়ে যায়। তবুও চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করেনি পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন (ইসিপি)।
রাত সাড়ে ৯টার পর থেকে একে একে ফলাফল আসতে শুরু করে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ২৭০টির মধ্যে ১৯৪ আসনে ফলাফল ঘোষণা করে ইসিপি। ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) ৯৮ আসনে জয়ী হয়েছে। নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ (পিএমএল-এন) ৪৯ ও বিলাওয়াল ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ২৩টি আসন পেয়েছে। বাকি আসন পেয়েছে সংখ্যালঘু দলগুলো ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। জাতীয় পরিষদের আসন সংখ্যা ৩৪২।
এর মধ্যে ২৭২ আসনে সরাসরি নির্বাচনের কথা থাকলেও ভোটের দিনের বিশৃঙ্খলায় ২টি আসনে ভোট স্থগিত করা হয়। সরকার গঠনে ১৩৭ আসনে জয় প্রয়োজন। নির্বাচনে কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হচ্ছে পাকিস্তানে।
নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলেছে শীর্ষ সব দলই। পিটিআই ছাড়া বাকি দলগুলো বলছে, সেনাবাহিনী তাদের পছন্দমতো ভোটের ফল নির্ধারণ করছে। এজন্য বিলম্ব হচ্ছে। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণায় লাগামছাড়া বিলম্বে সেনা হস্তক্ষেপের বিষয়টি আরও জোরালো হয়।
এসব অভিযোগের মধ্যে নিজের বিজয় ঘোষণা করেন ইমরান খান। ভোট নিয়ে সব অভিযোগ নাকচ করেও ইমরান বলেন, ‘বুধবারের এ নির্বাচন পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে সুষ্ঠু হয়েছে।’ ভোট নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলছেন তাদেরও এসব অভিযোগ তদন্ত করে দেখতে সহায়তা করার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
ইমরান বলেন, ‘আমরা সফল হয়েছি এবং নির্বাচনে ম্যান্ডেট পেয়ে জয়লাভ করেছি। কেন আমি রাজনীতিতে এসেছি, বিষয়টি পরিষ্কার করতে চাই। রাজনীতি আমাকে কিছু দিতে পারেনি। আমি আমার নেতা জাতির পিতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর স্বপ্নে পাকিস্তান গড়তে চাই। পাকিস্তানে এ সরকারই হবে কোনোরকম রাজনৈতিক দমনপীড়ন না চালানো প্রথম সরকার।’
প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে থাকার বিষয়ে ইমরান খান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্মিত এতবড় বাড়িতে থাকতে লজ্জাবোধ হবে আমার। ওই বাড়ি কী করা হবে সেটা ভেবে দেখবে সরকার। হয়ত সেটা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। সব সরকারি ভবনই আমরা জনগণের জন্য ব্যবহার করব।’
দেশ সংস্কারে প্রতিশ্রুতি : ভাষণে ইমরান খান দেশে বৃহত্তর সংস্কারের পাশাপাশি জনগণের জন্য সর্বাত্মক নীতি গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমাদের দেশ ঋণে জর্জরিত। উন্নতির জন্য কর প্রয়োজন। আপনারা তা দিতে চাইবেন না এটাই স্বাভাবিক। কারণ আপনারা দেখেছেন ক্ষমতাসীনরা করের টাকায় দুর্নীতি করেছে, অর্থ পাচার করেছে। আমি কথা দিচ্ছি, আপনাদের কর সঠিক কাজে লাগাব। দুর্নীতি দমন কমিশনকেও শক্তিশালী করা হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ইমরান খান আরও বলেন, ‘আমাদের দেশের কৃষকদের নায্যমূল্য দেয়া হয় না। দেশের আড়াই কোটি শিশু বিদ্যালয়ের বাইরে, শিশু জন্ম দিতে গিয়ে নারীরা প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছেন, কারণ দেশের মৌলিক স্বাস্থ্যসেবার অভাব রয়েছে। আমরা মানুষকে পানযোগ্য পানি দিতে পারি না।’ এছাড়া সরকারি ব্যয় কমানো, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম বাড়ানো, তরুণদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, কৃষকদের সাহায্য বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন পিটিআই চেয়ারম্যান।
পররাষ্ট্রনীতি : ইমরান বলেন, পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আমাদের সামনে বহু চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। পাকিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই দেশের উন্নয়নকে তরান্বিত করতে পারে। তিনি বলেন, ‘চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো। আমরা তাদের সঙ্গে কয়েকটি প্রকল্পে কাজ করছি। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের মাধ্যমে দেশে অর্থ আনার চেষ্টা করব।’
ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে ইমরান বলেন, আমি একটু আফসোসের সঙ্গে বলছি, ভারতীয় গণমাধ্যম আমাকে সমর্থন দেয়নি। তারা আমাকে ‘বলিউডের খলনায়ক’ মনে করে। অথচ আমি বিশ্বাস করি, ভারত ও পাকিস্তানের ভালো সম্পর্ক সবার জন্যই ভালো। ক্রিকেটের কারণে আমি ওখানে গেছি। আমি তাদের সংস্কৃতি চিনি। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের বন্ধুত্বই অনেক ভালো কাজে দেবে।
কাশ্মীর ইস্যুতে ইমরান বলেন, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ‘দোষারোপের খেলা’ আগে বন্ধ করতে হবে। কাশ্মীর ইস্যু সমাধানে উভয় দেশকে এক টেবিলে বসতে হবে।
তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো রাখতে চাই আমরা। আমরা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরদার করব। এছাড়া ইরান ও সৌদি আরবের সঙ্গেও সম্পর্ক সমুন্নত রাখতে চাই আমরা। মধ্যপ্রাচ্যে আমরা শান্তি বজায় রাখতে কাজ করব।
সবচেয়ে নোংরা নির্বাচন : নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ করে পিএমএল-এন প্রধান শাহবাজ শরিফ বলেন, ‘এটা পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে নোংরা নির্বাচন।’ সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই শাহবাজ আরও বলেন, ‘জনগণের রায় নিয়ে ছেলেখেলা হয়েছে। গরমের মধ্যেও ভোটাররা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু যখন গণনা শুরু হল, দেখলাম ভয়াবহ অবস্থা।’ দলের এজেন্টদের ভোট কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়।
বুধবার ভোরে টুইটার বার্তায় শাহবাজ লিখেছেন, ব্যাপকমাত্রায় অনিয়মের স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। আমরা নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করছি। আমাদের পোলিং এজেন্ট ছাড়াই ভোট গণনা করা হয়েছে। এটা অসহনীয়, অগ্রহণযোগ্য।
পিপিপির চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো বলেন, আমরা নির্বাচনের ফলাফল মানছি না। টুইটারে তিনি বলেন, ভোট কেন্দ্র থেকে আমার প্রার্থীর মনোনীত পোলিং এজেন্টদের লাথি মেরে বের করে দিয়েছে সেনাবাহিনী। ভয় দেখিয়ে পোলিং এজেন্টদের তাড়িয়ে দেয়া হয়। সারা দেশে এভাবে ভোট কেন্দ্রগুলো নিজেদের দখলে নেয় সেনাবাহিনী। পরে তারাই ইচ্ছামতো ব্যালটে সিল মারে।