এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : আন্দোলন না নির্বাচন- এ ইস্যুতে করণীয় চূড়ান্তে ব্যস্ত বিএনপি। সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ইস্যুতে সরকারকে সব দিকে থেকে চাপে রাখতে চায় দলটির নীতিনির্ধারকরা। তাদের মতে, একাদশ সংসদ নির্বাচন সন্নিকটে। অথচ নির্বাচন নিয়ে সরকারের সঙ্গে কোনো সমঝোতা হয়নি। নির্বাচনের আগে আইনি প্রক্রিয়ায় চেয়ারপারসনের মুক্তির বিষয়টি অনিশ্চিত। হাতে সময়ও কম।
আগস্টে ঈদুল আজহা। নভেম্বরে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা (জেএসসি) ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা। সবকিছু চিন্তা করে দ্রুত কর্মকৌশল ঠিক করতে চান তারা। এজন্য খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে এবার তৃণমূলের মত নেয়া হবে। দলীয় নেতাদের মতের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীসহ বিশিষ্টজনদের মতামতও নেবেন তারা। এরপর হাইকমান্ডের সঙ্গে আলোচনা করে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করবেন নীতিনির্ধারকরা। কর্মকৌশল চূড়ান্তের পাশাপাশি বাড়ানো হবে কূটনৈতিক তৎপরতাও।
এদিকে আগামীতে দল কী করবে এই ব্যাপারে অনেকটা অন্ধকারে তৃণমূল। নানা কারণে কেন্দ্রের ওপর তাদের ক্ষোভ-অসন্তোষের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে। দফায় দফায় তৃণমূলে ঝড় বয়ে গেলেও কেন্দ্রের নজর নেই তাদের দিকে। এবার সেই তৃণমূলকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে দলটির নীতিনির্ধারকরা। দলের করণীয় চূড়ান্তে নেয়া হবে তাদের মতামত। এ লক্ষ্যে ৭৮টি সাংগঠনিক জেলা নেতাদের ঢাকায় ডাকা হচ্ছে। ৩ ও ১০ আগস্ট রাজধানীতে তাদের নিয়ে বৈঠক করা হবে। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর তৃণমূল নেতাদের নিয়ে এই বৈঠককে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশ আজ মহাসংকটে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অন্যায়ভাবে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। বিএনপিকে বাইরে রেখে সরকার আবারও একতরফা নির্বাচনের পাঁয়তারা করছে। কিন্তু এবার জনগণ তাদের সেই সুযোগ দেবে না। তিনি বলেন, জনগণের ভোটাধিকার রক্ষা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আমরা বদ্ধপরিকর। এজন্য যা যা করা প্রয়োজন তাই করা হবে। দলীয় নেতাদের মতামতের পাশাপাশি প্রয়োজনে আরও অনেকের মতামত নেয়া হবে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ধারাবাহিক বৈঠকের অংশ হিসেবেই তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে বৈঠক ডাকা হয়েছে। সব সাংগঠনিক জেলার নেতাদের ইতিমধ্যে বৈঠকের বিষয়ে জানানো হয়েছে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের কৌশল ঠিক করতে ধারাবাহিক বৈঠক করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। এসব বৈঠকের মূল এজেন্ডাই থাকে আন্দোলন ও নির্বাচন।
প্রথমে দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এবং পরে যুগ্ম-মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক ও সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক হয়। এতে আগামী দিনের করণীয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মত আসে। তবে এসব বৈঠকে দলের নীতিনির্ধারকরা কোনো বক্তব্য রাখেননি। বৈঠকে নেতারা খালেদা জিয়াকে ছাড়া জাতীয় নির্বাচনে না যাওয়ার বিষয়ে একমত পোষণ করে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন। এ ইস্যুতে সরকারকে কোনো ছাড় না দেয়ার বিষয়ে তাদের কঠোর মনোভাবের বিষয়টিও সিনিয়র নেতাদের কাছে তারা স্পষ্ট করেন। একই সঙ্গে নেতারা খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে দ্রুত আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়ার পক্ষে বক্তব্য দেন। তাদের এমন মতামতকে গুরুত্বের সঙ্গে নেন নীতিনির্ধারকরা।
দলটির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, নির্বাচনের আগে আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার মুক্তি হবে না এটা নিশ্চিত। তাই আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। তবে সেই আন্দোলন যাতে পরিকল্পিত হয় সেজন্যই সবার মতামত নেয়া হচ্ছে। হঠাৎ করে কঠোর আন্দোলন ঘোষণা করে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো কঠিন হবে। তাই ছোট ছোট কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রাজপথে সক্রিয় হওয়ার চিন্তাভাবনা রয়েছে তাদের। কী ধরনের কর্মসূচি দেয়া যায় এবং কীভাবে তা সফল করা সম্ভব সেজন্য তৃণমূলের মতামত নেয়া হবে। তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতেই কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। নেতাকর্মীদের মতামতের বাইরে এবার কোনো কর্মসূচি দেয়া হবে না।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশের নেতাদের নিয়ে দু’দিন ঢাকায় বৈঠক করার সিদ্ধান্ত হয়। প্রথম দিন ৩ আগস্ট নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের নেতাদের নিয়ে বৈঠক হবে। দ্বিতীয় দিনে চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, ঢাকা, ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগের নেতাদের নিয়ে গুলশানের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে হবে বৈঠক। দু’দিনের এই বৈঠক হবে মোট চারটি সেশনে। এতে জেলা ও মহানগর কমিটির সুপার ফাইভ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সিনিয়র সহ-সভাপতি, যুগ্ম সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক এই পাঁচ নেতা উপস্থিত থাকবেন।
এদিকে তৃণমূলের পরিস্থিতি জানতে গত এক বছরে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা মোট চারবার তৃণমূল সফর করেন। নির্বাচনের প্রস্তুতি, প্রার্থী সম্পর্কে ধারণা, আন্দোলন ও দল পুনর্গঠনসহ সার্বিক বিষয়ে খোঁজখবর নেন তারা। তবে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানোর পর এই প্রথম তৃণমূল নেতাদের নিয়ে ঢাকায় বৈঠক করছেন নীতিনির্ধারকরা। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পরামর্শে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, তৃণমূল থেকে কেন্দ্রের সব নেতার মতামত একই। কেউ দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে নয়। বিএনপি চেয়ারপারসনকে সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলায় রাজনৈতিক কারণে কারাবন্দি করে রাখা হয়েছে। তাকে মুক্ত করাই হচ্ছে আমাদের মূল লক্ষ্য। আন্দোলন, জাতীয় নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা তাদের মতামত দেবেন।
বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও বরিশাল উত্তরের সাধারণ সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান বলেন, ঢাকায় বৈঠকের ব্যাপারে দলের দফতর থেকে তাদেরকে জানানো হয়েছে। ৩ আগস্ট বরিশাল বিভাগের সব সাংগঠনিক জেলা নেতাদের ওই বৈঠকে থাকতে বলা হয়েছে।
তৃণমূল নেতাদের মতে, বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণে হাইকমান্ডকে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে বাধ্য করতে হবে। কারণ মাঠ বিএনপির অনুকূলে। সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার ও নানা ব্যর্থতার কারণে নেতিবাচক ভোট বেড়েই চলেছে। আর নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগবিরোধী এসব ভোট স্বাভাবিকভাবে বিএনপির বাক্সে জমা পড়বে।
কিন্তু যথাসময়ে নির্বাচন আদায় এবং জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী একটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য বিএনপির সামনে এখন অনেক কাজ বাকি। তাদের মতে, যেনতেন ইস্যুতে রাজপথে কর্মসূচি দিয়ে পুলিশের হাতে মার খাওয়ার দরকার নেই। বরং রাজপথের বাইরেও ঘরোয়া বৈঠক ও আলোচনা সভাসহ নানামুখী তৎপরতা বৃদ্ধি করে দলের সাংগঠনিক ভিত মজবুত করা সম্ভব। সেদিকেই বিএনপির কেন্দ্রকে বেশি করে মনোযোগ দিতে হবে। তাদের মতে, সংগঠন শক্তিশালী হলে নির্বাচনের সময় তা সত্যিই ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠতে পারবে। কিন্তু সে রকম কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
তারা জানান, খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের পাশাপাশি আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতিও চলছে। প্রার্থীরা নিজ নিজ আসনে অনানুষ্ঠানিক গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে নির্বাচনে অংশ নেয়া নির্ভর করছে দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তের ওপর। জানতে চাইলে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও পাবনা-২ আসনের সাবেক এমপি সেলিম রেজা হাবিব যুগান্তরকে বলেন, আন্দোলন না নির্বাচন এ ব্যাপারে কেন্দ্র থেকে আমরা সুনির্দিষ্ট কোনো বার্তা পাইনি। কিন্তু আমরা নিজ উদ্যোগে আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনের জন্যও দলকে সংগঠিত করছি। কেন্দ্র থেকে যখন নির্দেশনা আসবে তা যেন সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি সেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি।
তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন সন্নিকটে। আমাদের চেয়ারপারসনও কারাগারে। তাই দলের পরিকল্পনা কী হবে সেই ব্যাপারে কেন্দ্রকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ তাড়াহুড়া করে তৃণমূলের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে তা সফল নাও হতে পারে। তাই সময় নিয়ে পরিকল্পিতভাবে আমাদের এগুতে হবে। কেন্দ্র সেরকম পরিকল্পনা নেবে বলে আমরা আশা করি।