এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : পৃথিবীর একেবারে পূর্বাংশে অবস্থিত একটি দ্বীপরাষ্ট্র ফিলিপাইন। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত মিন্দানাও দ্বীপপুঞ্জ একটি মুসলিম অধ্যুষিত জনপদ। এর রাজধানীর নাম সুলু এবং জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৫৬ লাখ। ১ লাখ ২ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট মিন্দানাওয়ের জনসংখ্যার শতকরা ৯৮ ভাগ মুসলমান। দূরপ্রাচ্যের এ দেশটিতে গত পাঁচ দশক ধরে যে মানুষগুলো সেনাবাহিনীর গুলিতে অকাতরে প্রাণ হারিয়েছেন তারা ‘মরো’ মুসলমান। মরো শব্দটি হচ্ছে স্পেনিশদের উদ্ভাবন। অতীতে তারা ইবেরিয়া তথা মুসলিম স্পেন ও পর্তুগালের মুসলমানদের ‘মুর’ বলে অভিহিত করত। আর সেখান থেকেই মরো শব্দের উৎপত্তি। পরবর্তীকালে ফিলিপাইনের মুসলমান মরো নামে সারাবিশ্বে পরিচিতি লাভ করে।
ফিলিপাইনে ইসলাম
ফিলিপাইনে ইসলাম ধর্মের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। ফিলিপাইনের সবচেয়ে প্রাচীন নথিভুক্ত একেশ্বরবাদী ধর্ম ইসলাম। পারস্য উপসাগর, দক্ষিণ ভারত এবং অন্যান্য মুসলিম সালতানাত থেকে আগত মুসলিম বণিকদের মাধ্যমে ১৪ শ’ শতকেই ফিলিপাইনে ইসলাম ধর্মের আগমন ঘটে। ফিলিপাইনের দি ন্যাশনাল মুসলিম কমিশনের হিসাব অনুসারে, বর্তমানে দেশটির মোট জনসংখ্যার ১১% মুসলমান। দেশটিতে জনসংখ্যায় খ্রিষ্টানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং কিছু বৌদ্ধ ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও বসবাস করেন।
ইতিহাস
১৩৮০ সালে করিম উল মখদুম নামক আরব বণিক সর্বপ্রথম ফিলিপাইনের সুলু এবং জুলু দ্বীপপুঞ্জে আগমনের পর বানিজ্যের সাথে সাথে সব দ্বীপে ইসলাম ধর্ম বিস্তার লাভ করে। এর মাধ্যমে ফিলিপাইনে প্রথম ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৩৯০ সালে মিনাঙ্গকাবাউ রাজবংশের প্রিন্স রাজা ব্যাগুইনদা এবং তার অনুসারীরা ইসলাম গ্রহণ এবং দ্বীপপুঞ্জে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। মিন্দানাওয়ের সিমুনুল প্রদেশে ১৪ শ’ শতকে প্রতিষ্ঠিত শেখ করিম আল-মাখদুম মসজিদটি ফিলিপাইনের প্রথম মসজিদ। পরবর্তীকালে মালেশিয়া ও ইন্দুনেশিয়ায় ভ্রমণকারী আরব ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে ফিলিপাইনে ইসলাম আরো শক্তিশালী হয়। পাশাপাশি চীন, ভারত ও পারস্য থেকে আগত মুসলিম আলেমদের মাধ্যমেও এখানে ইসলাম প্রচারিত হয়। তৎকালীন ফিলিপাইনে অন্তর্ভুক্ত মুসলিম প্রদেশগুলো : মাগুইন্দানাও সালতানাত, সুলু সালতানাত, লানাও সালতানাত এবং দক্ষিণ ফিলিপাইনের অন্যান্য অংশ।
ফিলিপাইন তখন তিনটি মুসলিম সালতানাতে বিভক্ত ছিল। ‘ম্যানিলা’ও ছিল তিনটি সালতানাতের একটি। ম্যানিলার সর্বশেষ মুসলিম শাসকের নাম সোলায়মান। বর্তমান ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলার নাম ছিল ‘মিরদিকাই’। এই ‘মিরদিকাই’কে পরিবর্তন করে বানানো হয় ম্যানিলা। মুসলিম শাসক সোলায়মানের আমলে দলে দলে স্পেনীয় বণিকরা ম্যানিলায় আসতে থাকেন। স্পেনীয় বণিকদের সাথে সাথে প্রশান্ত মহাসাগরে স্পেনের নৌবহরও নোঙর ফেলে। পরবর্তীকালে সুলতান সোলায়মানের সাথে স্পেনীয়দের যুদ্ধ শুরু হয়। ১৫৬৫ সালের এই যুদ্ধে স্পেনীয়দের কাছে সুলতান সোলায়মান পরাজিত হলে স্পেনীয়রা ম্যানিলা ও পার্শ্ববর্তী সুলু ও মাগিনদানিউ সালাতানাতও কুক্ষীগত করে। দখলকৃত এ অঞ্চলকে তারা তৎকালীন স্পেনের রাজা ফিলিপের নামানুসারে নামকরণ করে ফিলিপাইন।
পরবর্তীকালে ১৮৯৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সঙ্ঘটিত যুদ্ধে স্পেনীয়রা পরাজিত হয়। এরপর ফিলিপাইনের শাসন ক্ষমতা চলে যায় মার্কিনীদের হাতে।
বর্তমান ফিলিপিনোদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে ছিল ফিলিপাইন। স্পেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বর্তমান অমুসলিম ফিলিপিনো শাসকদের কয়েক শ’ বছরের শাসনামলে গণহত্যা, নির্যাতন ও ধর্মান্তরিতকরণসহ বিভিন্নভাবে মুসলমানদের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হয়।
কেমন ছিলেন ফিলিপাইনের মুসলমানেরা
প্রেসিডেন্ট রদরিগো দুতার্তের নেতৃত্বাধীন ফিলিপাইন সরকার মুসলমানদের স্বায়ত্তশাসন দিলেও মুসলিম অধ্যুষিত দক্ষিণ ফিলিপাইনে বিরাজ করছে জটিল এক পরিস্থিতি। সেখানে মুসলিম জনগোষ্ঠী দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশক ধরে ফিলিপাইন সেনাবাহিনী এবং মুসলিম প্রতিরোধ গ্রুপগুলোর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে জীবনযাপন করেছে। সুলু প্রদেশের কোতাবাতো নগরীর শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশি মুসলমানের বাড়িতে স্যানিটারি সুবিধা ও চলমান পানির ব্যবস্থা নেই। সরকারি পুলিশ বাহিনী থেকে তাদের জন্য নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এখানে বসবাসকারীদের অবহেলিত ও পরিত্যক্ত বলেই মনে করা হয়। অথচ খ্রিষ্টান অধ্যুষিত নগরীর চিত্র ঠিক এর উল্টো।
২০০২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে মুসলিম স্বাধীনতাকামী গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে ফিলিপাইন সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে মার্কিন সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। এখানে তথাকথিত শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে মার্কিন বাহিনী মোতায়েন করা হলেও আদতে পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করে। শুধু মুসলামনরাই নয়, বহু ফিলিপিনো নাগরিক তাদের দেশে আমেরিকান সেনাবাহিনীর উপস্থিতির বিরোধিতা করেছে। কারণ এটা তাদের দেশে আমেরিকান উপনিবেশবাদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
মিন্দানাওয়ে স্বায়ত্তশাসন অর্জনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট (এমআইএলএফ)। ফ্রন্টটি বাংসামরো ইসলামিক আর্মড ফোর্সেস (বিআইএএফ) নামেও পরিচিত। ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এমআইএলএফের নেতা মুরাদ ইবরাহিম। স্বাধীনতাকামী এই সশস্ত্র সংগঠনটির সৈন্য সংখ্যা ৩০ থেকে ৪০ হাজার।
সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ মরো মুসলিমদের সমর্থনে দক্ষিণ ফিলিপাইন সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান হিসেবে অঞ্চলটির পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে মত দেয়। ১৯৬৮ সালে ফিলিপাইনের জাতীয় সেনাবাহিনী কোনো ধরনের বিচার ছাড়াই বিপুলসংখ্যক মরো মুসলিম সৈন্যকে হত্যা করে। আর এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই সরকারি সেনাবাহিনী এবং মরো মুসলিম স্বাধীনতাকামীদের মধ্যে ধারাবাহিক সঙ্ঘাত শুরু হয়।
স্পেনিশরা ফিলিপিনো মুসলিমদের মরো মুসলিম হিসেবে আখ্যায়িত করে। এই মরো মুসলিমরা মিন্দানাও ও ভিসাইয়াস অঞ্চলে স্বতন্ত্র ইসলামি প্রদেশ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায়। ১৮৯৯ সালে ফিলিপাইন-আমেরিকান যুদ্ধকালে তাৎপর্যপূর্ণ মরো বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। সেই উপনিবেশিক আমল থেকে ফিলিপাইনে সঙ্ঘাত ও বিদ্রোহ অব্যাহত রয়েছে। আশা করা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট রদরিগো দুতার্তের স্বাক্ষর করা নতুন স্বায়ত্তশাসন আইনের মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদবহুল এই অঞ্চলটিতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।
উল্লেখ্য, মিন্দানাও অঞ্চলটি মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার নিকটে অবস্থিত এবং আয়তনের দিক দিয়ে অঞ্চলটি গ্রিসের সমান। সূত্র : ইন্টারনেট
Subscribe to Updates
Get the latest creative news from FooBar about art, design and business.
Trending
- রফিকুল টাওয়ার হ্যামলেটসের পাবলিক গভর্নর হিসেবে পুনঃনির্বাচিত
- দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টার প্রতিবাদে লন্ডনে ইআরআইয়ের মানববন্ধন
- আইসিটি মন্ত্রণালয়ের বিসিসি এবং এটুআইসহ দুর্নীতিবাজদের তালিকা প্রকাশ করে পদত্যাগের আল্টিমেটাম দিল শিক্ষার্থীরা
- করিডোর চুক্তি বাতিলের দাবিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে ইআরআইয়ের বিক্ষোভ সমাবেশ
- ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করতে প্রয়োজন দেশপ্রেমিকদের ঐক্যবদ্ধ লড়াই : ফাইট ফর রাইট ইন্টারন্যাশনাল
- লন্ডনে রাইটস অফ দ্যা পিপলস এর ভারতীয় হাইকিমশন ঘেরাও কর্মসূচি
- লণ্ডনে জিবিএএইচআর এর ইন্ডিয়ান হাইকমিশন ঘেরাও ও বিক্ষোভ সমাবেশ
- বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় গণমানুষকে সোচ্চার হতে হবে