এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : রাজশাহী ও বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী বিপুল ভোটের ব্যবধানে মেয়র পদে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ও বরিশালে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ নগরপিতার আসনে বসতে যাচ্ছেন। অপরদিকে সিলেট সিটি মেয়র পদে বিএনপি প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী ১৩৪টির মধ্যে ১৩২টি কেন্দ্রে ফলাফলে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের চেয়ে ৪ হাজার ৬২৬ ভোটে এগিয়ে আছেন। দুটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত থাকায় চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করেননি রিটার্নিং কর্মকর্তা। এ দুটি কেন্দ্রে ভোটার ৪ হাজার ৭৮৭ জন। এ দুটি কেন্দ্রের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে বলে জানিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
সর্বশেষ ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত এ তিনটির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীকে হারিয়ে বিএনপির প্রার্থীরা মেয়র পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
সোমবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত তিন সিটি কর্পোরেশনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত তিন সিটি নির্বাচনে কমবেশি কারচুপি, কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট, ধানের শীষের এজেন্টদের বের করে দেয়া, প্রার্থীকে মারধর, সহিংসতাসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ করেছেন বিএনপিসহ অন্য দলের প্রার্থী ও সংশ্লিষ্টরা। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধেও পক্ষপাতের অভিযোগ আনেন। ভোটে অনিয়মের অভিযোগে বরিশাল সিটির ১২৩টি কেন্দ্রের মধ্যে একটিতে ভোট গ্রহণ বন্ধ এবং ১৫টি ভোট কেন্দ্রের ফল স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। বাকি ১০৭টি কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। বন্ধ ও স্থগিত হওয়া ১৬টি কেন্দ্রের মোট ভোটার সংখ্যা ৩১ হাজার ২৮৭। কিন্তু সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মজিবর রহমান সরোয়ারের থেকে ৯৪ হাজার ২১৮ ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে আছেন। এর ফলে স্থগিত কেন্দ্রের ভোট ছাড়াই বেসরকারিভাবে মেয়র নির্বাচিত হলেন সাদিক আবদুল্লাহ। তবে রাজশাহীর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কোনো ভোট কেন্দ্র স্থগিত হয়নি।
এদিকে তিন সিটিতে নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছে বলে অভিযোগ করে বিএনপি বলেছে, আওয়ামী লীগ ভোট কারচুপি, ভোট জালিয়াতি ও ভোট সন্ত্রাস করেছে। অপরদিকে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে বলে দাবি করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলেছে, এ নির্বাচন বিতর্কিত করতে চেষ্টা করেছে বিএনপি। এছাড়া তিন সিটি নির্বাচনই বর্জন করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। তিনটিতেই প্রার্থী ছিল দলটির। পাশাপাশি কয়েকটি রাজনৈতিক দলও নির্বাচনে অনিয়মের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
ভোট গ্রহণ শেষে সন্তোষ প্রকাশ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা বলেছেন, সব মিলিয়ে নির্বাচন ভালো হয়েছে। অনিয়মের কারণে বরিশালের ১৫টি কেন্দ্রের ফল স্থগিত ও একটি কেন্দ্র বন্ধ করা হয়েছে। তিন সিটি ভোটে আপনি সন্তুষ্ট কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘হ্যাঁ, আই এম স্যাটিসফাইড। অনেক প্রার্থী পুনরায় ভোট আয়োজনের আবেদন করেছেন- এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিইসি বলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে এ বিষয়ে আবেদন করেছেন বলে গণমাধ্যমে জানতে পেরেছি। সেখানে পুনরায় ভোট গ্রহণের মতো অবস্থা আমরা পাইনি।’
তিন সিটি নির্বাচনের বেসরকারি ফলে ১৩৮ কেন্দ্রে ৮৭ হাজার ৩৯৬ ভোটের ব্যবধানে বিএনপির মেয়র প্রার্থী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে হারিয়ে রাজশাহীর নগরপিতা নির্বাচিত হয়েছেন এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। খায়রুজ্জামান লিটন পেয়েছেন ১ লাখ ৬৫ হাজার ৯৬ ভোট ও তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির বুলবুল পেয়েছেন ৭৭ হাজার ৭০০ ভোট। সিলেটে বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী ১৩২ কেন্দ্রে ৯০ হাজার ৪৯৬ ভোট পেয়ে এগিয়ে আছেন। এ সিটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরান পেয়েছেন ৮৫ হাজার ৮৭০ ভোট। বরিশালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ ১ লাখ ৭ হাজার ৩৫৩ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে মেয়র নির্বাচিত হচ্ছেন। তার নিকটতম বিএনপি প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ার পেয়েছেন ১৩ হাজার ১৩৫ ভোট। তিন সিটি নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ৮ লাখ ৮২ হাজার।
নির্বাচনে জয়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাজশাহীর নবনির্বাচিত মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, মানুষ ভোট দিয়ে আমাকে বিজয়ী করার মধ্য দিয়ে যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তা পালনে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। বরিশাল সিটির নবনির্বাচিত মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ বলেন, এ বিজয় জনতার বিজয়, এ বিজয় আওয়ামী লীগের উন্নয়ণের গণতন্ত্রের বিজয়। এছাড়া সিলেটে এগিয়ে থাকা আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, সিলেটের ইতিহাসে এতসংখ্যক ভোট কেন্দ্র দখল, জালভোট ও বোমাবাজির পরও মানুষ ভোট কেন্দ্র ছেড়ে আসেনি। আমি সিলেটবাসীকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই।
ভোট চলাকালে নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ ছাড়া বাকি প্রায় সব প্রার্থী অনিয়মের অভিযোগ তোলেন। তাদের বড় অংশই এ নির্বাচন বর্জন করে পুনরায় নির্বাচন দাবি করেন। বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তুলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বাদে বাকি পাঁচ মেয়র প্রার্থীই নির্বাচন বর্জন করে পুনর্নির্বাচন দাবি করেছেন। এ সিটি কর্পোরেশনে বাসদের মেয়র প্রার্থী ডা. মনীষা চক্রবর্তীকে মারধরও করা হয়। অপরদিকে সিলেটেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী বাদে চারজন মেয়র প্রার্থী ভোট ও ফল বাতিল করে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। এ সিটি কর্পোরেশনে সহিংসার ঘটনা ঘটে। আরেক প্রার্থী মো. এহছানুল হক তাহের (স্বতন্ত্র) নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো মন্তব্য করেননি। অনিয়ম ও জাল ভোটের ঘটনায় সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ১৩৪টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে দুটি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ বন্ধ করা হয়েছে। অপরদিকে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির এজেন্টদের বের করে দেয়া, জাল ভোট ও কারচুপির অভিযোগ করেছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। ৩০নং ওয়ার্ডের বিনোদপুর ইসলামিয়া কলেজ কেন্দ্রে ভোট জালিয়াতির অভিযোগে মাটিতে বসে ও বৃষ্টিতে ভিজে প্রায় ৪ ঘণ্টা অবস্থান করে প্রতিবাদ জানান তিনি। নির্বাচনের অনিয়মের প্রতিবাদ হিসেবে নিজের ভোটও দেননি বুলবুল। নির্বাচনের ফল আগাম প্রত্যাখ্যানও করেন বিএনপির এ প্রার্থী।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি কর্পোরেশনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হল। আর এ কারণেই নির্বাচনে জয় পেতে দু’দলই মরিয়া ছিল। দল দুটির প্রচারে জাতীয় ইস্যুগুলো গুরুত্ব পেয়েছিল। সিটিগুলোর মেয়র পদে কাগজে-কলমে ১৯ জন প্রার্থীর নাম থাকলেও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ১৭ জন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নৌকা ও বিএনপির ধানের শীষ প্রার্থীদের মধ্যেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস আগেই পাওয়া গিয়েছিল। তিন সিটির ৮৭ ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৩৮১ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ১৪৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচন ঘিরে এক ধরনের শঙ্কা বিরাজ করলেও বাস্তবেও এর কিছুটা প্রতিফলন দেখা গেছে। যদিও সুষ্ঠু ভোট নিশ্চিতে তিন সিটিতে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও আনসার বাহিনীর প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মাঠে রয়েছেন।
নির্বাচন কর্মকর্তাদের পর্যবেক্ষণে যেসব অনিয়ম : তিন সিটি নির্বাচনে ভোট গ্রহণ চলাকালে নানা অনিয়ম, কারসাজি ও পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের তথ্য-উপাত্ত কমিশন সচিবালয়ে পাঠিয়েছেন ইসির নিজস্ব কর্মকর্তারা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনিয়মের তথ্য এসেছে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন থেকে। বেলা ১১টায় পরিস্থিতি প্রতিবেদনে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. মুজিবুর রহমান ইসিকে জানিয়েছেন, সকাল ৮টায় ১২৩টি ভোট কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। বেলা ১০টার দিকে কিছু কিছু কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট ঢুকতে দেয়া হয়নি- এ মর্মে অভিযোগ পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কিছু কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে রিপোর্ট করেনি। অধিকাংশ কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার জানান, তাদের কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট অবস্থান করছেন।
এতে তিনি আরও উল্লেখ করেন, ১০১ নম্বর ভোট কেন্দ্র থেকে ইসির ট্যাব ছিনতাই হয়েছে। পরে ওই ট্যাব উদ্ধার করা হয়েছে। ১০৪ নম্বর কেন্দ্রে ট্যাব পরিচালনাকারীকে পুলিশ কর্মকর্তা বের করে দিয়েছেন। ৪৮ নম্বর মহিলা ভোট কেন্দ্র হওয়া সত্ত্বেও কয়েকজন পুরুষকে ভোট দিতে দেখা গেছে। এছাড়াও কয়েকটি কেন্দ্রে কিছু ব্যালটে আগাম সিল মারার ঘটনা ঘটেছে। প্রিসাইডিং অফিসারদের ওইসব ব্যালট পেপার গণনা থেকে বাদ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ৪ নম্বর কেন্দ্রর পরিস্থিতি খুব খারাপ হওয়ায় সেই কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ রিটার্নিং কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করেন, পুলিশের দায়িত্ব পালনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিথিলতা লক্ষ্য করা গেছে। এ বিষয়ে পুলিশ কমিশনারকে বলা হয়েছে।
এর আগে সকাল সাড়ে ৯টায় বরিশালে দায়িত্বরত ইসির পর্যবেক্ষক টিম এক প্রতিবেদনে ৭টি কেন্দ্রের অবস্থা তুলে ধরে। এতে তারা জানিয়েছে, ৬৯ নম্বর ভোট কেন্দ্রে ইসির ট্যাব ঢুকতে দেয়নি সন্ত্রাসীরা। ৭৬ নম্বর কেন্দ্রের পোলিং এজেন্টরা ভোটারদের নৌকা প্রতীকে ভোট দিতে নির্দেশ দিচ্ছেন। ৯৭ নম্বর ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ৭-৮ জন লোক গলায় নৌকা প্রতীক ঝুলিয়ে বসে আছেন। প্রিসাইডিং অফিসার বলার পরও তারা কেন্দ্র থেকে বের হননি। ১০৯ নম্বর কেন্দ্রে মোবাইল টিমের পুলিশ কর্মকর্তারা ভোট কেন্দ্রে ঢুকে ধানের শীষের এজেন্টকে বের করে দিয়েছেন। ৪৮ নম্বর কেন্দ্রটি মহিলা ভোট কেন্দ্র হওয়া সত্ত্বেও পুরুষরা ভোট দিয়েছেন।
এর আগে সকাল সাড়ে ৮টায় এক প্রতিবেদনে সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আলীমুজ্জামান তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, সব কেন্দ্রেই সুষ্ঠুভাবে ভোট শুরু হয়েছে। তবে রাতে ৪৬ নম্বর সিলেট ইনক্লুসিভ স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রের বাইরে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। পুলিশের মোবাইল টিম ৯ রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
আ’লীগ ও বিএনপি প্রার্থীরা যা বললেন : তিন সিটিতেই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা। অপরদিকে বিএনপির প্রার্থীরা নির্বাচন নিয়ে নানা অভিযোগ তুলেছেন। তিন সিটির মধ্যে রাজশাহীতেই সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট গ্রহণ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। তিনি বলেন, ভোট গ্রহণ চলাকালে আমি ২৮টি কেন্দ্র ঘুরেছি। কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা দেখিনি। কেউ কোনো ক্ষোভ বা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেনি। অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় রাজশাহীর কুমারপাড়ায় মহানগর আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে লিটন এসব কথা বলেন। অপরদিকে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে বিএনপির প্রার্থী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, পুলিশ প্রশাসন, প্রিসাইডিং অফিসার, নির্বাচন কমিশনার, রিটার্নিং অফিসারসহ প্রধান নির্বাচন কমিশনার, সচিব, তাদের নীলনকশার বাস্তবায়ন রাজশাহীর এ নির্বাচন। ২৭ থেকে ৩১টা ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ঘুরে দেখেছি, পুলিশের সহায়তায় অনেক কেন্দ্রে ভোট কাটা হয়েছে। অনিয়ম আমার চোখে ধরা পড়েছে। নিজের ভোট না দেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বিএনপির প্রার্থী বলেন, ‘বাংলাদেশের সাংবাদিক, সাধারণ মানুষ সবাই আজ নিরূপায়। আমার প্রতিক্রিয়া হচ্ছে- বিপন্ন গণতন্ত্র। আমি আমার ভোট পর্যন্ত দেইনি। যেখানে ভোটের মূল্য নেই, যেখানে রাষ্ট্রের কর্মচারীরা ভোট চুরির সঙ্গে সম্পৃক্ত; সেখানে আমার ভোটের কোনো দাম নেই।’
সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরান নির্বাচনকে উৎসবমুখর বলে উল্লেখ করেন। বিএনপির প্রার্থীর অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিনি শুরু থেকেই একের পর এক ভিত্তিহীন বানোয়াট অভিযোগ করেই যাচ্ছেন। তার এসব অভিযোগে কেউ বিভ্রান্ত হবেন না। নৌকার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে নিজের জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী বলেও উল্লেখ করেন কামরান।
এদিকে সিলেট সিটিতে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর শহর বিএনপির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আরিফুল হক বলেন, এটা ভোট চুরি না, দিনদুপুরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে ভোট ডাকাতি হয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের উদ্দেশে বিএনপি প্রার্থী বলেন, এ জয় জয় না, এটা মীরজাফরের জয়। এ জয়ের মাধ্যমে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। আমার পরাজয়টা বড় ব্যাপার না, এ নির্বাচনের ফলে নতুন প্রজন্ম একটি ভুল জিনিস শিখছে। সৎসাহস থাকলে আওয়ামী লীগের কোন নেতা আছেন, আসেন নির্বাচন করি, দেখা যাবে কার কত জনপ্রিয়তা। কমপক্ষে ১ লাখ ভোটে জয়লাভ করব। তিনি আরও বলেন, আমি এ সরকারের পদত্যাগ দাবি করছি। এ সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে যাওয়া উচিত না।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোট গণনার শেষ পর্যায়ে পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রয়া জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ ও বিএনপির মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার। মেয়র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ বলেন, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। নৌকার পক্ষে জনজোয়ার উঠেছে। মানুষ উন্নয়নের ধারায় নৌকা প্রতীকে ভোট দেবেন। বিএনপির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সাদিক বলেন, ইভিএমে ব্যালটের ভোটের তুলনায় স্বচ্ছতা বেশি। এখানে একজনের ভোট অন্যজনের দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ স্মার্টকার্ড পাঞ্চ করে এরপর আঙুলের ছাপ নিয়ে পরিচয় নিশ্চিত হলেই তিনি ভোট দিতে পারেন। সেখানেও তো নৌকার জয় এসেছে। মূলত নৌকার গণজোয়ার এসেছে বরিশালে।
অপরদিকে বিএনপির মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার বলেছেন, এমন কারচুপি মানুষ কখনও দেখেনি। এ নির্বাচনে প্রশাসনের ভূমিকা ন্যক্কারজনক। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো সরকারের আমলেই এমন নজিরবিহীন ভোট আমরা দেখিনি। এমন প্রহসনের নির্বাচন না করে এমনিতেই ঘোষণা দিয়ে নিয়ে যেতে পারত সরকার। সরোয়ার বলেন, আমরা আগেই বলেছিলাম, এখানে প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় প্রার্থী, তাই সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচন কমিশনের আশ্বাসে আমরা আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের আগের আশঙ্কাই আজ ঠিক হল। এ নির্বাচন আমরা বর্জন করেছি।
বরিশালের যে ১৫টি কেন্দ্রের ফল স্থগিত : নির্বাচনে অনিয়মের কারণে বরিশাল সিটির ১৫টি কেন্দ্রের ফল স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন। কেন্দ্রগুলো হলে- বরিশাল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ (মহিলা), ফারিয়া কমিউনিটি সেন্টার (পুরুষ), সরকারি মহিলা কলেজ (পুরুষ), বরিশাল সিটি কলেজ (পুরুষ), আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ-১ (পুরুষ), শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ-২ (মহিলা), উদয়ন প্রাথমিক বিদ্যালয় (পুরুষ), সাবেরা খাতুন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় (মহিলা, আর এম সাগরদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (পুরুষ), শহীদ আ. রব সেরনিয়াবাত সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় (পুরুষ), রূপাতলী জাগুয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, রূপাতলী জাগুয়া ডিগ্রি কলেজ ও সংলগ্ন রূপাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সখিনা খাতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও এ ওয়াহেদ বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উত্তর ভবন এবং নয়গাঁও মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও সংলগ্ন ইন্দ্রকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের ক্ষোভ : তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অনিয়মের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। এক বিবৃতিতে গণসংহতি আন্দোলন তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি, অনিয়ম ও ভীতির পরিবেশ সৃষ্টির নিন্দা জানিয়েছে। তারা বলেছে, নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি এবং ভোটারদের অবাধ ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে তাদের যে সাংবিধানিক কর্তব্য তাতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বরিশালে মেয়র প্রার্থী মনীষা চক্রবর্তীর ওপর প্রকাশ্যে হামলা হয়েছে, রাজশাহীতে মুরাদ মোর্শেদের নির্বাচনী এজেন্টকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছে। বহু পোলিং এজেন্টকে ভেতরে ঢুকতেই দেয়া হয়নি। নির্বাচনী কেন্দ্র আটকে ব্যালট পেপারে সিল মারা হয়েছে। প্রকাশ্যে টাকা-পয়সা দিয়ে ভোট কেনাবেচা হয়েছে প্রশাসনের নাকের ডগায়। এ ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে আগে থেকেই সিল মারা ব্যালট পেপার পাওয়া গেছে। সব স্থানে সরকারদলীয় ক্যাডারদের মহড়ার মাধ্যমে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। যার ফলে জনগণের ভোটাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।
পৃথক এক বিবৃতিতে যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, বিএনপির প্রার্থীর নির্বাচন বর্জন জাতীয় দুঃসংবাদ। ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগে ব্যর্থ হয়েছে নির্বাচন কমিশন। সরকারের কূটচালের কারণে নির্বাচন ব্যর্থ হয়েছে। এটা ভবিষ্যতের নির্বাচনের জন্য অশনিসংকেত। আরেক বিবৃতিতে জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মাদ তাহের বলেন, তিন সিটিতে ভোট ডাকাতি হয়েছে। তিন সিটিতে প্রহসনের নির্বাচন হয়েছে। এই সরকার ও ইসির অধীনে ভবিষ্যতে কোনো নির্বাচনে যাবে না জামায়াত।