এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম, কারচুপি এবং ভোট জালিয়াতির চিত্র দেখে জনগণ হতাশ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। তাদের মতে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিতর্কিত নির্বাচন দেখে একই সঙ্গে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠারও সৃষ্টি হয়েছে।
পাশাপাশি ভোট অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষভাবে আয়োজনে বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তারা ভোটারদেরও নিরাপত্তা দিতে পারেনি, এমনকি প্রার্থীর নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে পারেনি। অথচ ইসির হাতে আছে অনেক ক্ষমতা। কিন্তু তারা সেই ক্ষমতার প্রয়োগ না করে একটি পক্ষের আজ্ঞাবহ আচরণ করেছে।
তিন সিটি নির্বাচনের ভোট গ্রহণ ও ইসির ভূমিকা নিয়ে মঙ্গলবার যুগান্তরকে দেয়া তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এসব মন্তব্য করেছেন দেশের তিন বিশিষ্টজন।
সোমবার তিন সিটি কর্পোরেশনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত তিন সিটি নির্বাচনে কমবেশি কারচুপি, কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট, ধানের শীষের এজেন্টদের বের করে দেয়া, প্রার্থীকে মারধর, সহিংসতাসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ করেছেন বিএনপিসহ অন্য দলের প্রার্থী ও সংশ্লিষ্টরা। তারা ইসি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধেও পক্ষপাতের অভিযোগ আনেন। ভোটে অনিয়মের অভিযোগে বরিশাল সিটির ১২৩টি কেন্দ্রের মধ্যে একটিতে ভোট গ্রহণ বন্ধ এবং ১৫টি ভোট কেন্দ্রের ফল স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। যদিও শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে বলে দাবি করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলেছে, এ নির্বাচন বিতর্কিত করতে চেষ্টা করেছে বিএনপি। এ ছাড়া ভোট গ্রহণ শেষে সন্তোষ প্রকাশ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা বলেছেন, সব মিলিয়ে নির্বাচন ভালো হয়েছে।
ভোট কেমন হল- জানতে চাইলে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বলেন, তিন সিটিতে যেভাবে ভোট হয়েছে তাতে জনগণ হতাশ হয়েছে। ভোটে কালো টাকা, পেশিশক্তি এবং শাসক দলের প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখা গেছে। ভোট নির্বিঘ্ন করতে নির্বাচন কমিশন পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিন সিটিতে ভোট নিয়ে যা হল, তাতে ভবিষ্যতে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য ভোট নিয়ে জনমনে সংশয়-সন্দেহ আরও দৃঢ় হবে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, তিন সিটি নির্বাচনে অনিয়মের যে দৃশ্য দেখা গেছে, তাতে প্রতীয়মান হচ্ছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানটি ব্যাপকভাবে জনআস্থা হারিয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে তারা দক্ষতা এবং যোগ্যতার কোনো ধরনের প্রমাণ দেখাতে পারেননি।
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের জয়-পরাজয়ে ক্ষমতার বদল হয় না। অথচ মাত্র তিনটি সিটি নির্বাচন যে কমিশন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারে না, সেই কমিশন কীভাবে জাতীয় নির্বাচনের মতো বড় নির্বাচন আয়োজন করবে? আমি মনে করি, এই কমিশন দিয়ে সুষ্ঠুভাবে আগামী জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে না।
ড. বদিউল আলম বলেন, ‘আমি শুনেছি, রিটার্নিং কর্মকর্তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া হয়নি। তাদেরকে ইসি সচিবালয় থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। তারা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত ছিলেন। আর কমিশন একচোখা, আজ্ঞাবহ এবং নতজানু নীতি অবলম্বন করছে।’
নির্বাচনে ইসির করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যখনই ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ ছিল না, তখনই কমিশন ভোট বন্ধ করে দিতে পারত। আইনে নির্বাচন কমিশনের সেই ক্ষমতা দেয়া আছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং নির্বাচন কমিশনের যেসব কর্মকর্তা অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেয়া যেত। কিন্তু নির্বাচনী অনিয়মে এমন কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার খবর আমরা শুনি নাই। যা দুঃখজনক।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান যুগান্তরকে বলেন, এককথায় বলতে হবে যে নির্বাচন ভলো হয়নি। জাতীয় নির্বাচনে আগে একটি ভালো ভোট হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু তা হয়নি। বিশেষ করে বরিশালে ভোটের নামে যা হয়েছে তা নজিরবিহীন। এটাকে ভোট না বলে প্রহসন বলা যেতে পারে। নির্বাচন কমিশন এ প্রহসনের ভোট মঞ্চস্থ করেছে।
তিনি আরও বলেন, দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল তিন সিটিতে একটি স্বচ্ছ ভোট হবে। মানুষ নিজের ভোট নিজে দেবে। কিন্তু বরিশালের ভোট সে কথা বলেনি। অন্য দুই সিটিতেও অনেকে ভোট দিতে পারেনি। তিন সিটির নির্বাচন নিয়েই প্রশ্ন আছে।
ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, তিন সিটির ভোট জাতীয় নির্বাচনের আগে এক ধরনের রিহার্সেল ছিল। কিন্তু নির্বাচন ভালো না হওয়ায় এর প্রভাব আগামী জাতীয় নির্বাচনেও পড়তে পারে বলে আমি আশঙ্কা করছি। এখন দেখতে হবে এই তিন সিটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচন কমিশন জনগণের প্রতি আস্থা ফেরাতে পারে কিনা।