এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : শিক্ষার্থীদের ৯ দফা মেনে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। কিন্তু এখনও রাজপথ ছাড়েনি শিক্ষার্থীরা। কেন? তারা বলছে, এসব প্রতিশ্রুতিতে আমাদের আস্থা নেই। শুধু মৌখিক আশ্বাসে সন্তুষ্ট নই আমরা। মৌখিক ঘোষণা সরকারি রীতিতে বাস্তবায়নযোগ্য করে লিখিতভাবে প্রকাশ করতে হবে। যেগুলো এখনই বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলো করতে হবে। শ্রমিকদের নেতা শাজাহান খানকে মন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করতে হবে। প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইনে দুর্ঘটনার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখতে হবে। দায়ী ব্যক্তির অপরাধ অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। শনিবার রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপে এ বক্তব্য পাওয়া গেছে।
২৯ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাসচাপায় নিহত হন শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া খানম মিম ও আবদুল করিম রাজিব। এরপর থেকেই নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। ৩১ জুলাই ৯ দফার ই-মেইল গণমাধ্যমে আসে। কিছুটা সংশোধন করে ২ আগস্ট আবারও আসে ৯ দফার দ্বিতীয় মেইল। সেটিতে রয়েছে- শিক্ষার্থী হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। নৌপরিবহনমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রীকে ঘটনার দায় স্বীকার করে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিতে হবে। শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা এবং সব পরিবহনে হাফ ভাড়া নিশ্চিত করতে হবে। পরিবহন খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে এবং চালকদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। লাইসেন্সবিহীন চালক ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে। সড়কসংলগ্ন প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিরাপদ দূরত্বে বাস স্টপেজ তৈরি করতে হবে এবং রাস্তা পারাপারের জন্য ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করতে হবে। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তি দিতে হবে। সুনির্দিষ্ট বাস স্টপেজ ছাড়া যত্রতত্র যাত্রী উঠানামা বন্ধ করতে হবে; গণপরিবহনের জন্য আলাদা লেন করতে হবে এবং গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের সব দায়ভার রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।
আন্দোলন শুরুর পর সরকার এখন পর্যন্ত ১৫টি পদক্ষেপ নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এর একটি শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজকে পাঁচটি বাস প্রদান। শনিবার ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে বাসগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে। স্কুলসংলগ্ন বিমানবন্দর সড়কে আন্ডারপাস নির্মাণ; দেশের সব স্কুলসংলগ্ন সড়কে গতিরোধক নির্মাণ; স্কুলের পাশে বিশেষ ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নিহত মিম ও রাজিবের পরিবারকে ২০ লাখ টাকা করে দেয়া হয়েছে। দ্রুত মামলা শেষ করা ও কঠোর সাজার বিধান রেখে নতুন সড়ক পরিবহন আইন আসন্ন মন্ত্রিসভার বৈঠকে তোলার প্রস্তুতি চলছে। জাবালে নূরের দুটি বাসের রুট পারমিট বাতিল ও ফিটনেসবিহীন সব বাসের রুট পারমিট বাতিলের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। লাইসেন্সবিহীন ভুয়া চালকদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নৌপরিবহনমন্ত্রী ক্ষমা চেয়েছেন। গাড়ির মালিক ও চালককে ৭ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে, আরও চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মহাসড়কে বিশ্রামাগার তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
তবে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়া শিক্ষার্থীরা শনিবার বলছে, দুর্ঘটনা রোধের মতো কোনো ব্যবস্থা নিতে তারা এখনও দেখছেন না। শাহবাগে অবস্থানরত বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা বেলা ৩টার দিকে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে বক্তব্যে মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান সরকারি মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. সজল আলম বলেন, ৯ দফার একটি হল নৌমন্ত্রীর পদত্যাগ, সেটা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। সজল আরও বলেন, সব দাবি না মানা পর্যন্ত আমরা রাজপথ ছাড়ব না। সরকার ৯ দফা দাবি মেনে নিয়েছে কিন্তু বাস্তবায়ন করেনি। বাস্তবায়ন না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। ওই পয়েন্টে অবস্থান নেয়া শিক্ষার্থীরা বলছেন, এ আন্দোলন চলাকালীনও দেশের বিভিন্ন জায়গায় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হচ্ছে। অর্থাৎ এটা রোধ করা যাচ্ছে না। তাই রোধের ব্যবস্থা নিতে হবে।
রাজধানীর প্রগতি সরণিতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নেয়া ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র ইসতিয়াক আহমেদ তুর্য বলেন, দাবিগুলো মেনে নেয়ার কথা শুনেছি। কিন্তু আমরা বাস্তবায়ন চাই। কারণ এরআগে পরিবহন খাতসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারি আশ্বাসের পরে আর বাস্তবায়ন দেখিনি। একই পয়েন্টে কথা হয় ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটির ছাত্র হামিম আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে অনেক কঠোর আইন আছে। কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। সড়ক পরিবহন আইনে দুর্ঘটনা রোধে শক্ত নির্দেশনা নেই। অপরাধ অনুযায়ী সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হলে এমনিতেই চালকরা সতর্ক হয়ে যাবেন। দুর্ঘটনাও কমবে। কিন্তু শাস্তিই যদি দু-তিনবছর জেল থাকে, তাহলে চালক পরোয়া করবেন কেন?’
বসুন্ধরা পয়েন্টে ভিকারুননিসা স্কুলে পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এনামুল হক। তিনি বলেন, না চাইলেও তাকে মেয়ের সঙ্গে আসতে হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি আমার সমর্থন আছে। কেননা, দাবিগুলোর মধ্যে পরিবহন খাতে পুঞ্জিভূত সমস্যাগুলো ফুটে উঠেছে। এখন এগুলো সমাধান হলে জনগণ মুক্তি পাবে। তিনি মনে করেন, পরিবহন ইস্যু হলেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মূলে সম্মিলিত ডিসস্যাটিসফ্যাকশন (অসন্তোষ) আছে। কারণ ব্যাংকের টাকা লুট, স্বর্ণ কেলেংকারি, কয়লা খনি থেকে উধাও হওয়াসহ দেশের নানা অপ্রীতিকর বিষয় তারা দেখছে। প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইনে শাস্তির বিধানটা দুর্ঘটনা রোধের জন্য যথেষ্ট নয়।
শান্তিনগর মোড়ে কর্মসূচিতে বসেছিল ভিকারুননিসা নূন ও উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের শিক্ষার্থীরা। সেখানে কয়েক শিক্ষার্থী যুগান্তরকে বলেন, আমরা দাবিগুলোর বাস্তবায়ন দেখতে চাই। বাস্তবায়ন হলেই রাস্তা ছাড়ব।
মিরপুর ১০ নম্বরে আন্দোলনে অংশ নেয়া এক ছাত্রীর মা ডালিয়া রহমান বলেন, আসলে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের এসব দাবি বড়দেরও। আমরা দৈনন্দিন জীবনে যা ‘সাফার’ করি, সেটা নিরসনের দাবি আমাদের পরিবর্তে ওদের মুখে উঠে এসেছে। আমরা আশা করব, বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসের দিকে নজর দিয়ে সেখান থেকে শিক্ষা নেবে সরকার। কারণ দমন-পীড়নে সুফল আসে না, তা সরকারে থাকা অভিজ্ঞ মন্ত্রীরা জানেন। কারণ এ বয়সের শিশুদের নিয়েই সরকারের অনেক মন্ত্রী ষাটের দশকে আন্দোলন করেছেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের শহীদ মতিউর নবম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। আমরা আশা করব, বর্তমান সরকার ছাত্রদের ৯ দফা দাবি বাস্তবায়ন করে অন্তত শিশুদের কাছে নন্দিত হবে।
অহিংস পন্থায় শুরু হওয়ায় শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি বিভিন্ন মহল থেকে সমর্থন পাচ্ছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তা ধীরে ধীরে সহিংস মাত্রায় পৌঁছার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বাস ভাংচুর, আগুন ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটেছে। একদিকে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলা, অপরদিকে বৃহস্পতিবার ও শনিবার শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের একটি দিক হচ্ছে সড়কে গাড়ির-চালকের লাইসেন্সসহ কাগজপপত্র যাচাই। এতে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সরকারকে দাবি মানার শর্ত দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে হলেও জনদুর্ভোগের কথা বিবেচনা নিয়ে শিক্ষার্থীদের রাজপথ ছেড়ে যাওয়া উচিত।
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের প্রবক্তা চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন যুগান্তরকে বলেন, সরকারের নীতি-নির্ধারকদের পক্ষ থেকে দাবি মেনে নেয়ার ঘোষণার পরও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে ‘বিশ্বাসের অভাব’। কারণ ইতিপূর্বে যা বলা হয়েছে, তা করা হয়নি। আর যা করা হয়েছে, তা বলা হয়নি। তিনি বলেন, তারপরও জনদুর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনা করে শিক্ষার্থীদের উচিত সরকারকে সুযোগ দেয়া। তাছাড়া আগামী প্রজন্ম কী চায় সেটা পরিষ্কারভাবে দেশ-জাতি ও সরকারকে বোঝাতে পেরেছে বলে আমি মনে করি। তাছাড়া অন্যরা এর থেকে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করতে পারে। এতে ছেলেগুলো বিপদে পড়ে যেতে পারে। তাই আন্দোলন স্থগিত করে সরকারকে সময় দেয়া দরকার। সরকার যদি দাবি বাস্তবায়ন না করে তাহলে তারা প্রয়োজনে পরে আন্দোলনে আসতে পারে।