এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যাওয়া অর্থ আদায়ে সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক ও একটি বিশেষ সংস্থা খেলাপি ঋণ আদায়ে শীর্ষ খেলাপিদের ওপর প্রবল চাপ প্রয়োগ করছে। এর ফলে কয়েকটি গ্রুপ ইতিমধ্যে প্রায় হাজার কোটি টাকা দিয়েছে।
অন্য বড় বড় খেলাপিও ঋণ পরিশোধ করার অঙ্গীকার করেছে। সবচেয়ে বেশি ঋণ আদায় করেছে সোনালী ব্যাংক। এর পরে জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের অবস্থান। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের প্রাইম ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংকও বকেয়া টাকা আদায় বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। ব্যাংকাররা বলেছেন, ঋণ আদায় বাড়লে ব্যাংকের তারল্য সংকট কিছুটা হলেও সমাধান হবে।
সূত্র জানায়, জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যারা খেলাপি হয়েছেন তাদের তালিকা তৈরি করেছে প্রতিটি ব্যাংক। এ তালিকা ধরে ব্যাংকগুলো এখন গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। ঋণ আদায় পরিস্থিতি সার্বক্ষণিকভাবে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়কে জানানো হচ্ছে।
প্রতিটি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ঋণ আদায় বিভাগে জনবলও বাড়ানো হয়েছে। এখান থেকে তদারকিও করা হচ্ছে। যেসব গ্রাহকের কাছ থেকে ঋণ আদায়ের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার পর বাংলাদেশ ব্যাংককে তা জানানো হচ্ছে।
এদিকে, বড় বড় খেলাপির কাছ থেকে ঋণ আদায় বাড়াতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বিশেষ তাগাদা দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নগদ আদায় বাড়ানোর দিকে ব্যাংকগুলোকে নজর দিতে বলা হয়েছে। গ্রাহকদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট শাখার একজন করে কর্মকর্তাকে বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
এর পাশাপাশি সরকারের একটি বিশেষ সংস্থা থেকেও এই প্রথমবারের মতো ঋণের টাকা আদায়ে ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করা হচ্ছে। বিশেষ করে যারা জালিয়াতি করে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করেছেন তাদের কাছ থেকে টাকা আদায়ে ওই সংস্থা থেকে জোরালো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এসব চাপে পড়ে বড় ঋণখেলাপিরা এখন সীমিত আকারে হলেও ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করতে শুরু করেছেন।
কয়েক বছর ধরে ব্যাংকিং খাত থেকে জাল-জালিয়াতি ও ঋণের নামে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। কিন্তু টাকা আদায় হয়েছে খুবই কম। এ ছাড়া আমানতের চেয়ে ঋণ বিতরণ বেশি হয়েছে। এ কারণে ব্যাংকে তারল্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। ফলে গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে নতুন করে ঋণ পাচ্ছেন না।
বিশেষ করে শিল্প খাতে ঋণের জোগান বাড়াতে তারল্যপ্রবাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে এখন খেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঋণ বিতরণের পর আদায় না হলে একপর্যায়ে ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দেয়। ব্যাংকিং খাতে এর প্রভাব পড়ে। ঋণ আদায়ে জোরালো উদ্যোগে সুফল দেখা দিলে ব্যাংকিং খাতে আবার তারল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
তিনি বলেন, ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকিং রীতিনীতি অনুসরণ করা উচিত। এর বাইরে গিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ঋণ আদায় করা হলে ব্যাংকিং খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক গ্রুপ জালিয়াতি করে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর আদালতের নির্দেশ ছিল প্রতি মাসে এক কোটি টাকা করে পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু তারা তা পারছে না।
সম্প্রতি হলমার্ক গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তা এবং সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ওই গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়েছে। এরপর তাদের কাছ থেকে ১২ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। বিদেশে যেসব অপ্রত্যাবাসিত রফতানি বিল রয়েছে সেগুলো ফেরত আনারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) উবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ যুগান্তরকে বলেন, খেলাপি ঋণ আদায় বাড়াতে জোরালো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
সোনালী ব্যাংক থেকে যারা ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছেন তাদের এই বার্তা দেয়া হয়েছে যে- ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে তা ফেরত দিতে হবে। এ বার্তা পেয়ে অনেকেই ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। ফলে ঋণ আদায় বাড়ছে।
বিসমিল্লাহ গ্রুপের জনতা ব্যাংক কর্পোরেট শাখা থেকে নেয়া ১৮৬ কোটি টাকার মধ্যে রফতানি বিল দেশে আনার মাধ্যমে ১০ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। ক্রিসেন্ট গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে নিয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে তারা কিছু টাকা পরিশোধ করেছে। আরও কিছু টাকা তারা শিগগির ফেরত দেয়ার অঙ্গীকার করেছে।
গ্রুপটির সঙ্গে সরকারের ওই সংস্থা ইতিমধ্যে কয়েক দফা বৈঠক করেছে। অ্যানন টেক্সের কাছে বকেয়া ঋণের পরিমাণ প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। তাদের কাছ থেকেও কিছু টাকা আদায় হয়েছে। এ গ্রুপের সঙ্গেও ব্যাংকের পাশাপাশি ওই সংস্থার কর্মকর্তারা বৈঠক করেছেন।
বেসিক ব্যাংকের সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির ঘটনায় যেসব গ্রাহককে শনাক্ত করা হয়েছে তাদের কাছ থেকে এখন ঋণ আদায় করা হচ্ছে। ছয় মাসে তারা প্রায় ১২২ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায় করেছে। যে কারণে তাদের খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি কিছুটা কমেছে।
চট্টগ্রামের নূরজাহান গ্রুপের খেলাপি ঋণ আড়াই হাজার কোটি টাকা, ইউসুফ ব্রাদার্সের দেড় হাজার কোটি টাকা। তাদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো ইতিমধ্যে কিছু ঋণ আদায় করেছে।