এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : আজ ৭ আগস্ট। শোকের মাসের প্রথম সপ্তাহ শেষ। নির্ধারিত কোনো কর্মসূচি না থাকলেও অন্য দিনের মতো আজও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য শোকাহত থাকবে জাতি। বঙ্গবন্ধু শুধু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিই নন, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। রাজনীতির মঞ্চে এসে এ মহানায়ক রাজনীতিবিদ থেকে হয়ে উঠেছিলেন ‘বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক’।
হয়তো প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকেই বাঙালি জাতি যার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন তিনি শেখ মুজিব। বাঙালি জাতি বারবার বহির্শত্রুর হাতে নির্যাতিত হয়ে আসছিল, শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছিল আর এসব থেকে পরিত্রাণ পেতে একজন ত্রাতার অপেক্ষা করছিল। একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম দিয়ে শুধু একটি পতাকা বা মানচিত্রই নয় বঙ্গবন্ধু এ জমিনের মানুষকে তাদের শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তিও দিয়েছিলেন। অবশ্য স্বাধীনতার আগেই তিনি পরিণত হয়েছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতায় যার প্রমাণ, যখন আমরা দেখি, পাকিস্তান সরকার থাকার পরও একটা সময়ে এসে পূর্ব পাকিস্তান চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায়।
পৃথিবীতে কিছু রাজনীতিবিদ আছেন যাদের নামের সঙ্গে তার দেশ একাত্ম হয়ে আছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলা, চায়নায় মাও সেতুং, রাশিয়ায় লেনিন, ভিয়েতনামে হো চি মিন, তুরস্কে কামাল আতাতুর্ক, যুগোশ্লাভিয়ায় মার্শাল টিটো আর বাংলাদেশে শেখ মুজিব। এসব দেশের নাম আসলে অবধারিতভাবেই এসব ব্যক্তির নামও আসে। এসব ব্যক্তির দীর্ঘ সংগ্রাম ও বিপ্লব, ত্যাগ এবং আপসহীন মানসিকতার কারণেই পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নিয়েছে দেশগুলো।
মৌলিক জায়গায় মিল থাকলেও এদের একেকজনের ভূমিকা একেক ধরনের। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের ব্যপ্তি ও বৈশিষ্ট স্বতন্ত্র। বাঙালি এমন এক জাতি যারা বারবার পরাধীন ছিল। কখনও ব্রিটিশ, কখনও মুঘল আর সর্বশেষ পাকিস্তানি হানাদারদের দ্বারা শোষিত হয়েছে তারা। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি শুরু হয়েছিল পাকিস্তানি শাসনের বাস্তবতা মেনেই। কিন্তু ভারত ভেঙে পাকিস্তান হওয়ার পর তিনি যখন দেখলেন ধীরে ধীরে কেড়ে নেয়া হচ্ছে বাঙালির অধিকার, চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে শোষণ-বঞ্চনার জগদ্দল পাথর, তিনি অন্যভাবে চিন্তা করলেন। তার সুপ্তচিন্তা স্বাধীন বাংলাদেশের সত্তা আস্তে আস্তে প্রসারিত হতে শুরু করল। সে অনুযায়ী তিনি পদক্ষেপও নিতে শুরু করলেন। যার ছাপ আমরা দেখি মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন ও পরে তা ভেঙে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা এবং ছয় দফার ঘোষণায়। তার লক্ষ্যে তিনি ছিলেন অবিচল, অটল। তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা একে একে অনেকেই তাকে ছেড়ে যান। কেউ কেউ ভিন্ন দল গঠন করে তার বিরোধিতাও করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু পিছ পা হননি। সে অর্থে তাকে প্রথমে লড়তে হয়েছে তার রাজনৈতিক সহযাত্রীদের সঙ্গেই। আর পরে পাকিস্তানিদের সঙ্গে। ঘরের শত্র“দের জয় করেই বাইরের শত্রুদের তাড়াতে হয়েছে তাকে। এর আরও সুস্পষ্ট প্রমাণ দেখা যায়, যখন ছয় দফার প্রশ্নে তার নিজ দলেই বিভেদ তৈরি হয়। জাতির পিতা তার আত্মজীবনীতে নিজেই লিখে গেছেন সে কথা।
বস্তুত বঙ্গবন্ধুকে একের পর এক ধাপ পার হতে হয়েছে স্বাধীনতার পথে। সেই ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ’৬৯-এর গণ আন্দোলন, ’৭০-এর নির্বাচন এবং সবশেষে মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে প্রথমে স্বাধিকার আন্দোলনে এবং চূড়ান্ত পর্বে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ দেন। এ সবগুলো ধাপ জয় করেই তিনি দেশ স্বাধীন করেছেন। এখানেই তিনি অনন্য, অবিনশ্বর।
শেকসপিয়রের ভাষায়, এ জগতে কেউ কেউ জন্মগতভাবে মহান, কেউ মহত্ত্বের লক্ষণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন আবার কেউ স্বীয় প্রচেষ্টায় মহানুভবতা অর্জন করেন। বঙ্গবন্ধু স্বীয় প্রচেষ্টায় হয়ে উঠেন বঙ্গবন্ধু। দেশের জনগণের অন্তর্নিহিত শক্তির ওপর অপার আস্থা ও বিশ্বাস, মানুষের প্রতি নিঃশর্ত ভালোবাসা মমত্ববোধ, সহমর্মিতার বিরল এক দৃষ্টান্ত তিনি।
প্রকৃত অর্থে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা। তার দীর্ঘদিনের নেতৃত্বেই বাঙালি জাতি অনুপ্রাণিত ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ তথা পাকিস্তানি আধিপত্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করেছে আমাদের স্বদেশ ভূমিকে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্যোক্তা বঙ্গবন্ধু মুজিব ছিলেন আদর্শে জাতীয়তাবাদী ও বিশ্বাসে গণতন্ত্রী। তাই তো তিনি কর্মী থেকে হয়েছেন নেতা, আর নেতা থেকে হয়েছেন জননেতা, জননেতা থেকে হয়েছেন জাতির জনক। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা দিয়ে একটি দলের নেতা থেকে হয়েছেন দেশনায়ক।